“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৫

রাঙিয়ে দিয়ে যাও।

।। দেবলীনা সেনগুপ্ত ।।

  
( ব্যতিক্রম, মার্চ ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)
          শী
তের চাদরটা যেন একটানে শহরের মুখ থেকে টেনে খুলে দিল শিমুল পলাশের দামাল দল। দ্বিধাহীন বসন্ত জাগ্রত দ্বারে । সারাদিন কাজকর্ম , কেজো রুটিন। তার মাঝেও অবাধ্য মন প্রায়ই উধাও আকাশের আঙিনায়, দখিনা বাতাসে লুটোপুটি খেয়ে একেবারে রঙিন চাঁদিয়াল যেন। আকাশের অসীম থেকে তাকে চার দেওয়ালের সীমায় টেনে নামাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে বৈকি। চোখ রাঙিয়েও শাসনে রাখা যাচ্ছে না। অবশ্য বসন্ত যে সমাগত , সে সমাচার সর্বপ্রথম দিয়েছিল টেবিলের ওপর রাখা অ্যান্টি –পক্সের হোমিওপ্যাথিক শিশি । তার থেকে চারটে সাদা গুলি মুখে ফেলেই ছুটে চলে গিয়েছিলাম ছাদে। শহরের আকাশ দেখার সেই তো মঞ্চ। দূরের কৃষ্ণচূড়া সব লালে লাল। ফাগুনের আগুনে । অবধারিত মনে পড়িয়ে দিল জালুকবাড়ি...বিশ্ববিদ্যালয়...আর সেই সঙ্গে কত গহীন গোপন হৃদয়-কাব্য। মধ্য চল্লিশেও গালের রঙে, গ্রীবার ভাঁজে লাগল কি বসন্ত পরশ? জাগল কি লাল আবির ছটা!!! ছি ছি কি লজ্জা ! মনের ভেতরের অষ্টাদশী ভ্রূভঙ্গিমা করে বলে ওঠে, ‘ওমা লজ্জা কিসের! গালে যদি রঙ না ধরবে, মন যদি না মাতাল হবে তবে সেই জাদুগর কেন ছড়াল এত এত রঙ আবিরে, পাতায়,  কুসুমে,কমলে, আকাশে বাতাসে?’
          বসন্তের হাত ধরেই তো চলে আসে বিহুগানের সুর, হুচরির তাল,ঢোল বাঁশির মাতন । ফুলাম গামোছায় প্রীতি বিনিময় শেষ হতে না হতেই রটে যায় তার আগমন বার্তা... বৈশাখ  আর বৈশাখ মানেই তো সেই রূপ-কল্পতরু, যিনি প্রতিনিয়ত আনন্দে অবগাহন করিয়ে দিয়ে যান, প্রতিটি নিপীড়িত মুহূর্তে একেবারে হাত ধরে পার করিয়ে দেন সীমার থেকে অসীমে, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে,’ আরও আরও প্রাণের তুফানে ভরপুর করে তোলেন বেঁচে থাকাকে।
               এ পর্যন্ত লিখে ছেলেকে প্রশ্ন করলাম, ‘ দেখ তো বাবা, কেমন হচ্ছে আমার বসন্ত-গাথা?’ দু একবার ঠেলাঠেলিতে চোখ বোলাল ঠিকই , তবে তাচ্ছিল্য গোপন থাকল না খুব একটা। অবশ্য গোপন করার চেষ্টাও করেনি। 
          -কিরে, বল কিছু । আমি উদগ্রীব ।
         -বলব আবার কী? ...একটু ঝাঁঝিয়েই ওঠে ...তোমার এসব খেপামি নিয়ে তুমিই থাক। ওসব বসন্ত-রং দেখার সময় আমার কোথায়?বিগত দশ বছর ধরে  তোমার ওই বসন্তদিনে আমি তো শুধু ক্লাস থেকে ক্লাসে ওঠার যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে চলেছি ।কত বছর দোল খেলিনি বলতো? দোলের আগের দিন পরীক্ষা, পরের দিন পরীক্ষা। জলে  ঠাণ্ডা লাগবে, আবিরে এলার্জি ,জ্বর বাঁধালে পরীক্ষা দেওয়া হবে না এসব জুজু কে দেখিয়েছে? ওই ফাল্গুন –চৈত্র আমি জানি না। আমার কাছে বসন্ত মানে মার্চ এপ্রিল ,আর তার মানে পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল, বুক দুরুদুরু, নতুন ক্লাস, রোল নম্বর... ব্যস।
       আমিও ব্যস। ছেলের গুগলিতে কুপোকাত। তবে হারই বা মানবো কেন! নিজের মনেই যুক্তি সাজাই নিজের মত করে। বলি, এও বসন্তের আর এক রস। হয়ত রৌদ্র-রস, বা বীভৎস রস  তবে রস তো বটে।
         সৌভাগ্যবশত: , আমার শৈশব বেলায় এসব যন্ত্রণা পোহাতে হয় নি । দোলের আনন্দে  মাতোয়ারা হতাম দুদিন ই। প্রথম দিন শুধুই নিষ্পাপ ও নিরাপদ আবির গুঁড়ো, আর পরের দিন যা-ইচ্ছে-তাই। আবির- কুমকুম-গুলাল-মেহেন্দি থেকে কাদাজল হয়ে সাদাজলে পৌঁছেও প্রাণশক্তির অভাব হত না। অবাক হয়ে দেখতাম, গুরু গম্ভীর  গুরুজনের দলও দৈনন্দিনের মুখোশ  খুলে রঙের নেশায় রঙিন । বাড়ি ফিরে স্নান সেরে ভাত খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল । সন্ধেবেলায় আবার আসর। মিষ্টিমুখের । সকালে যাদের মন রাঙানো হল, সন্ধ্যায় তাদের রসনা তৃপ্তির পালা। দুকলি গান, দু-ছত্র আবৃত্তি  দিয়েই হয়ত নীরবে নিভৃতে লেখা হয়ে গেল কোন যুগল হৃদয়ের জীবন বাসর কথা। এঁচোড়ে পক্ব ছিলাম হয়ত, তবে বোকাও ছিলাম। থাক। বোকাই ভাল। তারাই জগত সংসারকে বাসযোগ্য বানায়।
           ‘প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে ...’,সহসা পাশে থাকা চলভাষের গান বেজে উঠে কাছে ডাকে । লেখা-লেখা খেলাটা মুলতুবি রেখে চক্ষু মুদেই ফোন লাগাই কানে। ওপারের কণ্ঠস্বরে চোখ খুলে যায় আপনা থেকেই। অনুরোধের মোড়কে ভেসে আসে বসের নির্দেশ । আগামী অর্থ বর্ষের রাজ্যিক আয়- ব্যয়- স্থিতির  আনুমানিক হিসেবটিকে চূড়ান্ত রূপ দিতে হবে। সুতরাং ছুটির দিনেও জরুরি তলব । অতএব , ওঠাও দেহ, বাঁধো তল্পি, মন চল নিজ নিকেতনে । পেটের দায়। বসন্ত কাহিনী অর্ধসমাপ্ত রেখেই স্নান সেরে পাত পাড়ি। সেখানেও অবশ্য বসন্ত অপ্রত্যক্ষ থাকে না। এঁচোড় ঘণ্টে, কাঁচা আমের টক – ডালে বসন্তের মধুর রস। যা হোক, তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়ি কর্মস্থল উদ্দেশ্যে। বাসে সিটে হেলান দিয়ে বসার পর মৃদু তন্দ্রা ঘনায় । আচমকা কেঁপে উঠি কিছুক্ষণ পরে—চালক অবিবেচকের মত ব্রেক দিয়ে গাড়ি  থামিয়ে যাত্রী ওঠাচ্ছে। রেগে-মেগে কিছু বলতে গিয়েও থমকে যাই...এখানেও যে বসন্ত-জাদু। দুজন সুবেশা সুন্দরিকে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে তরুণ চালক ‘ আহা, ভন্টি আহা, রখাই থইছোঁ নহয় তোমালোকর বাবে, আহা’ । বাসের মিউ্জিক সিস্টেম এ তখন বাজছে ‘জানমনি , তোমার বাবে...। ’ উদ্গত রাগ গিলে ফেলে মুচকি হেসে ফেলি ।
           এভাবেই থাক বসন্ত তার নাগরিক রঙ নিয়েও। থাক পরীক্ষা, থাক অফিস, থাক টেবিলের ওপর খোলা হিসেবের খাতা। তার সঙ্গেই থাক খোলা জানালার ওপাশে ঝাঁকড়া কদমের ডালে , সবুজ পাতার নিবিড় আড়ালে বসন্তদূতের অবিরাম কুহুতান। শুধু মুছে যাক, খুনখারাবির লাল, বিশ্বের সভ্যতায় অথবা সভ্যতার বিশ্বে বন্ধ হোক হত্যার হোলি খেলা । আস্তিক –নাস্তিক, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সবার চেতন ও মননের রঙ এক হোক প্রাণের সৃষ্টিতে , প্রাণের রক্ষায়। তাহলেই যে কোন দিন, যে কোন জায়গায় , যে কোন হৃদয় নির্দ্বিধায় বলে উঠতে পারবে, ‘ফুল ফুটুক  না ফুটুক, আজ বসন্ত ।’



কোন মন্তব্য নেই: