“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৩০ মে, ২০১৫

উনিশ তুমি কার ????


   
(লেখাটি  উধারবন্দ মাতৃভাষা ঐক্যমঞ্চ স্মরণিকা "তর্পণ" এ প্রকাশিত; ৪ ই জ্যৈষ্ঠ,১৪২২ -১৯ শে মে ২০১৫   -  ----জয়শ্রী ভূষণ ।)

     “ ......... জানো নি দিদি, গত কাইলকে হঠাৎ আমার ছুটো মেয়ের মুখো শুনি সিলেটি। যে বিশ্রী লাগছে শুনতে। আমি কইছি তাইরে পচা কথা বলে না। তার পরে বুঝাইলাম যে সিলেটি কথা বোলবে না...এমনে তো বুঝছও নি, আমার দুই মেয়েরেই সেন্ট্রেল স্কুলও দিছি, বাংলা জানে না একটুও, বেশির ভাগ সময় হিন্দিতেও মাতে, আমরাও জানো তো ঘরো আমার ভাইয়ের লগে হিন্দিতেই মাতি, আর আমার তো কিতা কইতাম , শিলচর জঘন্য লাগে, রাস্তা ঘাট ভাঙ্গা, কিছু নাই, খালি আমার জামাইর লাগিয়া , চান্স পাইলেই গৌহাটি যাওয়া গিয়ার ইচ্ছা ......” ...... প্রত্যুত্তরে ওপাশ থেকে ভেসে এল আরেক জনের গলা... “ ........ অয় বে, আমার তো ছেলে মেয়ে দুইজনরে ইতার লাগিয়াই হলিক্রসো দিলাম। আমার মেয়ে তো বাংলা পড়ার প্রশ্নই উঠে না, আর তাই অবশ্য সিলেটি উলেটি মরলেও মাতে না, কিন্তু আমার ছেলেটারে লইয়া পারছি না, আমরার গলির বাচ্চা ইতা বে, ওই যে সরকারী বাংলা স্কুলো পড়ে, অত ছুটোলুক বুচছসনি ইতার লগে থাকিয়াওতো অতা বাজে মাত শিখের। সামনের বার ভাবছি শিলচরের বাইরে পাঠাই দিমু, বেঙ্গালুর দিতাম ভাবছি, কিন্তু চাকরির লাগিয়া ঠেকি গেছি, ভাবছি ভলান্টারি রিটায়ারমেনট লইয়া একবারে কলিকাতা নাইলে বেঙ্গালুর যাইমু গিয়া ......... অফিসের টেবিলে মাথা নিচু করে খুব মন দিয়ে আমি একটি জরুরি ফাইলে কাজে ব্যস্ত, তবুও দুই মহিলা সহকর্মী এই কথাগুলো কানে যেন সূচের মত ফুটলো। আর পারছি না, মুখটা তুলে সোজা হয়ে বসলাম, আর আমার পিত্তিটা জ্বলে উঠলো। মনে মনে বলে উঠলাম, এই হচ্ছে, উনিশের শহর, একাদশ ভাষা শহিদের শহর। আর তোমরা হচ্ছ তাদের উত্তরাধিকারী। মনে মনে রাগে গাটা রি রি করে উঠেছিল। এই অঞ্চলেই বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য একবার নয় বার বার রক্ত দিতে হয়েছে, ১৯৬১, ১৯৭২ , ১৯৮৬ এবং ১৯৯৬...তে , কিন্তু কেউ মনে রাখেনি। যারা উপরোক্ত অভিব্যক্তি ব্যক্ত করছিলেন, যে ভাষায় ওরা কথা বলছিল,যে ভাষায় ওদের মা বাবা চৌদ্দপুরুষ কথা বলেন সেই ভাষাকে সম্মান তো দূর, নিজের ছেলে মেয়েরা ভুলে কখনো সেই ভাষায় কথা বললে লজ্জা বোধ করেন, উনারা ছিলেন শিলচারিয়ান । কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। নীরব ঘৃণাই ছিল আমার ভাবাবেগ।
       
           
  একটু পরেই আমাদের ডাক এল নীচের তলায়। ওই দিন আমাদের অফিসের শীর্ষ কর্তার শেষ দিন, উনি পশ্চিম বঙ্গের মানুষ, আবার অনেক দিন পরে উত্তর পূর্ব ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গে বদলি হয়েছেন, তাই ফেয়ারওয়েল সভায় সবাই জমায়েত হলাম। স্যার আমাদের সবার খুব প্রিয় একজন ছিলেন, খুব কাজের, এরকম অফিসার, ভদ্র, অমায়িক এবং একই সাথে কাজে খুব ভালো সচরাচর আমরা কেউই খুব একটা পাইনি। সবাই কিছু না কিছু বলছিলেন নিজের মত করে উনার প্রতি শ্রদ্ধা ও নিজেদের ভালো লাগার কথা গুলি। এখানে আমাদের শিলচরের অফিসে বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন ভাষীর মানুষ চাকুরিরত। একজন নতুন সবেমাত্র একবছর হয়েছে চাকুরির। অসমিয়া ছেলে যার সাথে বিদায়ী স্যারের খুবই ভাল সম্পর্ক, কিছু বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করল এবং উঠে দাঁড়াল। সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে অবাঙ্গালিরা হিন্দিতেই কথা বলে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ছেলেটি সাবলীল ভাবে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় খুবই মধুর সরস ও মার্জিত ভাবে ওর বক্তব্য উপস্থাপন করল। আমরা সবাই খুব উপভোগ করলাম ওর অভিজ্ঞতা ও ভালোলাগা। স্যারও বললেন খুব সুন্দর করে অবশ্যই বাংলায়, বললেন শিলচরের তথা কাছাড়ের কথা, এখানকার মানুষের কথা, উনার কাজে স্বাচ্ছন্দ্য এবং অফিস পরিচালনায় সহায়তার জন্য আমাদের সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন। আমি নীরবে উপরের আর নীচের বৈপরীত্যে আকস্মিক ভাবে হলেও নিরাশায়ও আশাবাদী হলাম।
      
         
     উপরের ঘটনার প্রায় তিন বছর কেটে গেছে, ইতিমধ্যে অনেক বার উনিশ, একুশ আমরা ধূমধাম করে পালন করেছি, পয়লা বৈশাখ ও ২৫ শে বৈশাখ এ অনেক অনুষ্ঠান ও হয়েছে। সব মা বাবারাই স্কুলের টিউশন এর ফাঁকে যদি সময় থাকে তবেই স্বল্প সময়ের জন্য বাচ্চাদের তৈরি করে মঞ্চে অনুষ্ঠান করিয়ে আবার সেই স্কুলের পড়াশোনা ও ভবিষ্যতে দিল্লি বেঙালুরুতে  পাড়ি দেবার জন্য প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু তারপর............???
          ১৯৯৮ থেকে প্রতি বছর ভারতীয় গণনাট্য সংগঠন শিলচর শাখা ১৭ই আগস্ট ১৯৭২ এ দ্বাদশ ভাষা শহিদ বিজন চক্রবর্তী (বাচ্চু) কে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করে থাকে, এবং প্রতি বছর নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যাতে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে পারে বা জানতে পারে। একটি খুব অন্য ধরণের বিশেষ অনুষ্ঠান মাতৃভাষায় আকস্মিক বক্তৃতাএবং এই অনুষ্ঠান বা প্রতিযোগিতা শুধু বাংলাভাষীর জন্য নয়, সব ভাষাভাষীর জন্য আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের সব ভাষিক গোষ্ঠীর ছাত্র ছাত্রীরা যাতে নিজেদের ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে নির্দ্বিধায় অনর্গল কথা বলতে পারে সেই ভাবনা থেকেই এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। খুবই যত্ন করে এ অঞ্চলের সব সংখ্যা লঘু ভাষিক গোষ্ঠী যেমন মনিপুরি, নাগা,নেপালি , মিজো, মাড়োয়ারি, হিন্দুস্তানি, বিহারি ইত্যাদি দের অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া সত্ত্বেও খুবই আশ্চর্যের এবং একই সাথে খুবই দুঃখের যে এত বছর ধরে এই আয়োজন জানিয়ে গেল বেশির ভাগ বাচ্চারা এবং বড় বাচ্চারা বিষয়গত ভাবে কথা বলতে সাবলীল ইংরেজি অথবা হিন্দিতে। তার থেকেই মারাত্মক যে চিত্রটি ফুটে উঠল তা হল বেশির ভাগ বাচ্চারাই নিজের মাতৃভাষায় মাইকে কথা বলতে লজ্জা পায়, অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এর থেকে ভয়ংকর অপ্রিয় সত্য আর কী হতে পারে সব থেকে বেশি খারাপ লাগত যখন বাংলা ভাষার জন্য শহিদ বাচ্চু চক্রবর্তীর স্মরণ অনুষ্ঠানে কোন বাংলা ভাষী ছাত্র ইংরেজিতে কথা বলতে আগ্রহ দেখায়। গত বছর থেকে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন বন্ধ করা হয়েছে, কারণ নিজেদের মাতৃ ভাষায় একটু সময় নিজের ভাষায় কথা বলানোতে এই প্রতিযোগিতা মূলত অপারগ।
         
      
  ৯ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ ২০১৫ ---- শিলচর বীক্ষণ আয়োজিত সিনেমা ওয়ার্কশপ হয়ে গেল। ৭ দিনের এই ওয়ার্কশপে ২০ জন অংশ গ্রহণকারীদের দুটো ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়ে ছিল। বাঙালি ছাড়াও মনিপুরি, অসমিয়া অংশ গ্রহণকারীরাও কী সুন্দর ও গুছিয়ে বাংলা বলতে পারে তা আমাকে উজ্জীবিত করেছে যেভাবে, সেইভাবে, আমাদের এতদঞ্চলের বিশেষ করে শিলচরের ছেলে বা মেয়েদের বাংলা ভাষায় কথা বলার যে রুচিশীলতার অভাব ও নিজেকে বাংলা জানি না ও পারি না... বলতে যে গৌরবান্বিত বোধ করা ও ঔদ্ধত্য সত্যি ব্যথার ,লজ্জার এবং খুবই চিন্তার বিষয়। ওয়ার্কশপের শেষে কিছু দিন পর, বীক্ষণের আয়োজিত, এক সম্মিলিত আড্ডায়, আসাম ইউনিভার্সিটিতে মাসকম বিভাগের পড়ুয়া অর্ঘদীপ বরুয়া ও চিত্রাঙ্গদা সিংহরা এই ওয়ার্কশপ এর অভিজ্ঞতা যখন নির্ভুল এবং শুদ্ধ বাংলায় বর্ণনা করল, আমার মনের মধ্যের প্রশ্ন চিহ্ন গুলো আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কাঠঠোকরা যেমন ঠুকে ঠুকে বিশাল মহীরুহ কে খোকলা করে দেয়, আমাদের ভাষা ও আমাদের অঞ্চলের প্রতি আমাদের অভিভাবক ও ছেলে মেয়েদের যে তাচ্ছিল্য , অবহেলা ও অনাদর, ১ নয় ১৫ শহিদ এর এই উপত্যকার আত্মবলিদানকেই না উপহাস করে বসে, খোকলা করে দেয় আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও এই উপত্যকার সমূলে উৎপাটন ঘটে ????
        
        
  মুষ্টিমেয় কিছু সংগঠন, এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মীরা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের সক্রিয় সদস্য সংগঠন ও সদস্যবৃন্দ এবং শুধু মাত্র একাংশ সচেতন নাগরিক বৃন্দগণ এ উপত্যকার এই ভাষা জনিত এই সমস্যা নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। বাকিদের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। উপরোক্ত ক্যাচ ক্যাচালি পড়ে পাঠকরা হয়ত ভাবছেন, এত কিছু হচ্ছে ভাষা নিয়ে, নাটক কবিতা, উনিশে মে, তবুও আমার মত অলেখক কি হাবি জাবি লিখে সবার পরিশ্রমে জল ঢালছি। সত্যি কি হাবি জাবি??? এত কিছুর পরও ... এত বছর পরেও ...আমাদের ভাষার প্রতি আমাদের অঞ্চলের প্রতি মূল স্রোতের একাংশ ছাড়া, বাকিদের কি আমরা ভাষা, ভাষা শহিদ, ১৯,২১,৬১,৭২,৮৬ এই শব্দ, এই সংখ্যা গুলির সাথে পরিচিতি ঘটাতে পেরেছি, সখ্যতা গড়ে উঠেছে, যদি ওঠেনি তবে কেন? এই প্রশ্ন গুলি কি খুবই অবান্তর??????
         
          
  কিছুদিন আগে শুনেছিলাম যে হিন্দি ও ইংরেজি ছাড়াও আরও একটি ভাষা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে পাঠ্য হিসেবে যোগ করা হবে। অনেক বছর আগেও আমি কথাটি শুনেছিলাম, এবং আঞ্চলিক ভাষা-- যেমন এ অঞ্চলের ভাষা বাংলা তাও পড়তে হবে। খবর পেলাম, অনেক অভিভাবক নাকি এর বিরোধিতা করেছেন এই অজুহাতে যে পড়ার চাপ বেড়ে যাবে। অথচ জার্মান ভাষা পড়তে অনেকেরই আপত্তি নেই। কাউকেই দোষারোপ নয়, যখনই আমরা কোন দিকে তর্জনী উঠাই, বাকি আঙ্গুল গুলি আমাদের নিজেদের দিকেই উঠে । তাই আমরা যারা সাংস্কৃতিক কর্ম কাণ্ডে জড়িত, ভাষা ও ভাষা জনিত কার্যকলাপে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছি, আমাদের আত্ম সমালোচনার দরকার কি? আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই উপত্যকার বাইরে চাই, না এখানেই ওদের লড়াই করে বাঁচতে থাকার কৌশল ও বিদ্যার অভ্যাস শুরু করব????? একটু ভাববার অবকাশ অবশ্যই চাই। আমার এই প্রশ্ন গুলো আমার নিজেকেও। উত্তরের অপেক্ষায় শুধু আমি নই...... উনিশের উত্তরণ ও এই উত্তরের উপরই নির্ভর করবে......... প্রশ্ন খুব কঠিন মনে হচ্ছে......????? ...... আমরা আমাদের কথ্য ভাষা সিলেটি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, আমাদের শিকড়, আমাদের অঞ্চল, আমাদের বঞ্চনাকে, যেদিন নিজের বলে ভাবব... বাকি উত্তর গুলোর পথ ও আমরা একদিন খুঁজে পাবই...যেদিন আমরা সবাই মিলে পথে নামব...... পথেই হবে আমাদের পথ চেনা......। কিন্তু কবে????? ......উত্তরের অপেক্ষায় আরও কত উনিশ একুশ পেরোতে হবে.........আর কত দূর আমাদের চলতে হবে...... সময়ের কাছে অপেক্ষায় চেয়ে থাকা...ততদিন আমাদের পথ চলা থামবে না...।।

কোন মন্তব্য নেই: