“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০১৫

ক্রসিং ব্রীজেসঃ এক সৎ , অভিসন্ধিহীন যাত্রা


     ৩ মে, ২০১৫ যুগশঙ্খ, রবিবারের বৈঠকে লেখকের নাম ছাড়া প্রকাশিত
।। মৃন্ময় দেব ।।
   

দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনের ঠিক প্রাক-মুহূর্তে ভাজপা’র ভিশন ডকুমেন্টে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রসঙ্গে Immigrants from north-east শব্দ-বন্ধের ব্যবহার নিয়ে হাওয়া বেশ গরম হয়েছে। ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের প্রেক্ষিতে  উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থান তথা এখানকার মানুষের পরিচয় নিয়ে নানান প্রশ্ন ও সংশয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও  ঘটেছে স্বাভাবিক কারণেই। অনেক অবাঞ্ছিত প্রশ্নচিহ্ন অঙ্কিত হয়েছে ভাবুক মনের আনাচে-কানাচে। এসব সবারই জানা, নতুন করে বলার নয়। তবু এখানে এ প্রসঙ্গের অবতারণার এক ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে।
          না, কোনও রাজনৈতিক নিবন্ধের প্রস্তাবনা হিসাবে উপরের কথাগুলো বলা হয়নি। কথাগুলো  মনে এসেছে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অরুণাচল প্রদেশের  Sange Dorjee Thongdok  নির্মিত  Crossing Bridges সিনেমাটি দেখতে দেখতে। এই অসাধারণ সিনেমাটি যারা দেখেছেন তারা অবশ্যই আমার সাথে একমত হবেন যে আত্মপরিচয় সংক্রান্ত অনিবার্য এবং জরুরি কিছু প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ ফিল্মটির অস্থি-মজ্জায় জড়িয়ে আছে। অথচ এই ভিন্ন গোত্রের অসামান্য ফিল্মটির বিষয়ে অনেকেই জানেন না, এমনকি সিনেমা-প্রেমীদের অনেকেও! এ নিয়ে আমাদের এই অঞ্চলেও তেমন আলোচনা লক্ষ্য করা যায়নি সেভাবে। এটা শুধু দুর্ভাগ্যের নয়, লজ্জারও। উত্তর-পূর্বাঞ্চল প্রসঙ্গে মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যে অবহেলা-উদাসীনতার অভিযোগ নিয়ে আমরা সতত সোচ্চার, সেই আমরাই কি যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে ফিরে তাকাই আমাদের ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতি ? দর্শকের উদ্দেশ্যে এই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিতেও ইতস্তত করেন না ফিল্মের পরিচালক।    
            আমাদের সিনেমা দেখার এ পর্যন্ত অর্জিত যাবতীয় অভিজ্ঞতা মুখ থুবড়ে পড়ে Crossing Bridges  দেখতে গিয়ে। কীরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি তার সামান্যতম পূর্বানুমান দীক্ষিত দর্শকের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। না, এর নেপথ্যে নেই নির্মিতির কোনো কেতাদুরস্ত কায়দা, কিংবা দর্শককে বোকা বানানোর ফিল্মি চাতুরি। নেই নাটকীয় উপাদান, রোমাঞ্চকর কোনো  উন্মোচনও নেই। তবু, দেখতে দেখতে অরুণাচল প্রদেশের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে যেতে হয়  সহজ সরল জীবনযাত্রার গহনে। এক অভূতপূর্ব প্রশান্তি সিনেমাটির অনন্য সম্পদ। ফিল্মের কাহিনি বলতে মহানগরের এক কর্মচ্যুত যুবকের ঘরে ফেরা ও শেকড় খুঁজে পাওয়ার মর্মস্পর্শী মানবিক বিবরণ। যাত্রা বলাই সঙ্গত, নিজস্ব শেকড়ের দিকে এক অভিসন্ধিহীন যাত্রা। আর সে যাত্রার অনুষঙ্গে  Crossing Bridges  নামকরণও এক ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে। 
            ওয়েব ডিজাইনার তাসি (Tashi) এক বছর যাবৎ মুম্বাইতে বেকারজীবন কাটানোর পর অনন্যোপায় হয়েই গ্রামে ফিরে আসে,  যে গ্রামের সঙ্গে তার সংযোগ ছিন্ন হয়েছে বছর আটেক। গ্রামের মন্থর জীবন পদ্ধতিতে অসহায় বোধ করে তাসি, যদিও তার পরিবারের সবার ইচ্ছে সে গ্রামেই থাকুক, খামারের দেখাশোনা করুক। তাসি অপেক্ষা করে আইনজীবী বন্ধু অমিতের ফোনের, যে তাকে নতুন কর্ম সংস্থানের সুসংবাদ জানাবে। গ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। কেবল বিশেষ এক স্থানে, পাহাড় চুড়োয় বৌদ্ধ মঠের কাছে তা পাওয়া যায়। মুম্বাই মহানগরের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামটির প্রান্তিক অবস্থান এতেই প্রতিষ্ঠা পায়। তাসি স্বভাবত হাঁপিয়ে ওঠে,  সময়  কাটানোর জন্য একটা ব্যাটারি চালিত টেলিভিশন (যেহেতু গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি থাকে দু’দফায় মাত্র ঘণ্টা দুয়েক) কিনে নিয়ে আসে বন্ধুর সহায়তায়। তাসির বাবা শুরুতে বিরক্তি প্রকাশ করলেও ক্রমে টিভির নেশা তাকেই পেয়ে বসে। এ নিয়ে মৃদু কৌতুকও উপভোগ্য। 
           এরই মধ্যে তাসি, গ্রামের স্কুলে পরিবর্ত-শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়, কিছুদিনের জন্য। শিশুদের কারো  কারো সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে  হিমসিম খায়, প্রশ্ন জাগে নিজের মনেও। সহকর্মী মেয়েটির (অনিলা) সাথে হৃদ্যতা বাড়ে। জানা যায়, মুম্বাইতে  চাকরি হারানোর সূত্রে তাসি তার প্রেমিকাকেও খুইয়েছে। মহানগরে সবকিছু খুইয়ে ফিরে আসা তাসি একটু একটু করে ক্রমশ গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে থাকে। ল্যাপটপে চ্যাপলিনের সিনেমা দেখিয়ে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বড় আপনার জন হয়ে ওঠে সে। অন্যতর অর্থ খুঁজে পেতে শুরু করে জীবনের। প্রায় অলক্ষ্যে, গোপনে এই অন্তর্বিপ্লব ঘটতে  থাকে। যেন, বদলটা হয় অন্ধকারে। একদিন অনিলাও চলে যায় অন্যত্র, কিন্তু তাসির অন্তরে অন্য আলো জ্বেলে দিয়ে যায়। পাহাড়ি নদীর উপর গাছের গুঁড়ি ফেলে তৈরি ব্রিজ অন্যের হাত ধরে পার হতো অনভ্যস্ত তাসি, অথচ সেই  ব্রিজের উপর দিয়েই এখন সে স্বচ্ছন্দে ও অনায়াসে নদী পার হয় । গ্রামের মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সংযুক্তি ঘটে তার, খুঁজে পায় অস্তিত্বের শিকড়, আত্ম-আবিষ্কারের অনুষঙ্গ । অমিতের কাছ  থেকে সুসংবাদ ও ডাক এলেও তাই আর সাড়া দিতে পারে না তাসি, মহানগরের  মায়াবী হাতছানি (গ্রামের মানুষের লৌকিক বিশ্বাস অনুসারেই যেন) এখন আর প্রলুব্ধ করে না তাকে। সে খুঁজে পেয়েছে তার হারানো স্বদেশ, স্বভূমি। 
            ফিল্ম শুরু হয় দারুণ এক লঙ শট দিয়ে। একটি নিঃসঙ্গ ব্রিজের দৃশ্য। মুহূর্ত কয়েক পরেই, ব্রিজের ওপারে পাহাড়ের গা  ঘেঁষে, অসামান্য এক নিসর্গ দৃশ্যের ভেতর অনুপ্রবিষ্ট পরিবহন নিগমের রঙচটা বাসটিকে ধীর গতিতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।  বাসের জানলায় তাসির মুখ। শুরুতেই একটা মুড তৈরি করে দেন পরিচালক, অবলীলায় ১০২ মিনিটের যাত্রার সঙ্গী করে নেন দর্শককে। সাত আট বছর আগে ছেড়ে যাওয়া নিস্তরঙ্গ নিষ্কলুষ গ্রামটিতে তাসি প্রবেশ করে পর্যটকের মতন। ক্যামেরা স্থির ও ঋজু ভঙ্গিতে ধরে গ্রামের প্রায় স্থবির জীবনযাত্রাকে। মায়ের দেওয়া চা বিস্বাদ লাগে তাসি-র, গ্রামের জীবন ও সংস্কৃতি অচেনা মনে হয়। স্মৃতিভ্রষ্ট সে, স্বর্গচ্যুত। (দর্শকের আশা আকাঙ্ক্ষায় জল ঢেলে দিয়েই) পর্দায় এর অতিরিক্ত ও ‘দারুণ’ কিছু ঘটে না। কোনো উত্তেজক মুহূর্ত, কোনো নাটকীয়তা খুঁজে পাবেন না দর্শক। গ্রামের মানুষগুলোর ঘটনা বিহীন একঘেয়ে জীবনযাত্রার টুকরো-টাকরা ছবি, লৌকিক বিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কারের  পাশাপাশি এক চিলতে অস্ফুট প্রেম, ইত্যাদি উপাদান সম্বল করেই তাসির রূপান্তরের ইতিবৃত্ত বিবৃত হয় সহজ সাদামাটা ভাষায়। ভঙ্গি দিয়ে ভোলানোর বিন্দুমাত্র প্রয়াস নেই, এমনই সরাসরি, সোজা-সাপটা ন্যারেশন। তা সত্ত্বেও পরের দৃশ্যটি সম্পর্কে অগ্রিম অনুমান একেবারেই অসম্ভব। পরিচালকের স্বকীয়তা এখানেই।  
             অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি এ ছবির সম্পদ। এই কৃতিত্বের দাবিদার অবশ্যই পূজা গুপ্তে। Canon 5D ক্যামেরায় শ্যুট করা এ  ছবি। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা যথাযথ। অরুণাচলের মন মাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। প্রকৃতি এ ছবিতে পটভূমি মাত্র নয়, জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে যেন। ১০২ মিনিট দৈর্ঘ্যের এ ছবি ভীষণ স্বল্প-বাক, নৈসর্গিক প্রশান্তি খর্ব হয় তেমন মুখরতা সচেতন ভাবেই বর্জিত। খুব ছোট অথচ অর্থবহ সব সংলাপ। অরুণাচলের আঞ্চলিক ডায়লেক্টে (Shertukpen) তৈরি প্রথম ফিচার ফিল্ম এটি। একেবারেই স্বল্প বাজেটের। যতটা জানা গেছে, দায়বদ্ধতা থেকেই আর্থিক দায়ও বহন করেছেন দর্জির পরিবার। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিনেতার বদলে না-অভিনেতাদের দ্বারাই রূপায়িত হয়েছে অধিকাংশ চরিত্র।             
             আমি স্থির নিশ্চিত, ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে এই অব্দি যারা পাঠ করেছেন তারা নির্ঘাৎ ভাবছেন যে এর মধ্যে এমন ‘আহা মরি’ কী-ই বা আছে। না, কাহিনির যে প্লট উপরে বর্ণিত হয়েছে তার চিত্রায়নেও, সিনেমায়, আপনারা খুঁজে পাবেন না কোনো পরিচিত ফর্মুলা, অথবা কোনো ধ্রুপদী উৎকর্ষের নিদর্শন। কোন নাটকীয় মুহূর্ত, মেলোড্রামা, আবেগের উচ্ছল ক্ষণ, কিংবা তাক লাগিয়ে দেবার মতো বিচ্ছিন্ন কোন অসাধারণ শট অথবা কম্পোজিশন।  কিন্তু পেয়ে যাবেন অপলক তাকিয়ে দেখার অমল অবকাশ। নিতান্ত সহজ ও সরল, অথচ সাবলীল এক ফিল্মি ভাষায় জটিল জীবনের জলছবি এঁকে যান Dorjee , SRFTI (Satyajit Ray Film Institute), Kolkata প্রত্যাগত এই তরুণটি ! সমগ্র ছবিটি জুড়ে থাকে অনুভবী ক্যামেরার মরমি পরশ। রাতের কলি যেমন অজানিতে ভোরের ফুল হয়ে ফোটে, আর আমরা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখি, এও ঠিক সেরকম। আমাদের দৃষ্টির সামনে অথচ আমাদের অজানিতেই, যেন এক সামুদ্রিক সমগ্রতা নিয়ে, এক প্রাণময় প্রশান্তি নিয়ে পরতে পরতে উন্মোচিত হতে থাকে অপাপবিদ্ধ প্রকৃতি ও জীবন। হতবাক করে দেয়   দর্শককে। এ কেবল মুগ্ধ ও মোহিত হওয়া নয়, তারও অতিরিক্ত কিছু, অন্যতর কিছু। এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পাঠক, মার্জনা করবেন, সে অভিজ্ঞতার শাব্দিক অনুবাদ বর্তমান কলমচির সাধ্যাতীত। তবু, নিবন্ধ রচনার এই ব্যর্থ প্রয়াসের পেছনে যুক্তি শুধু এই যে,  ঘটনাচক্রে ঘরের পাশে ধানের শীষে যে শিশির বিন্দু দেখেছি তার সংবাদ সংবেদনশীল হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তার অতিরিক্ত কিছু নয় !   


কোন মন্তব্য নেই: