“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৯ মে, ২০১৫

চেতনায় রাঙানো এ বিশ্বচরাচর



এটা কল্পনা করা নিশ্চয়ই অসমীচিন হবে না যে একদিন পদার্থবিজ্ঞানীরা আমাদের মনের রহস্য জেনে যাবেন। কারণ জগতের কোন কিছুই যে পদার্থজগতের নিয়মের বাইরে থাকতে পারে না একথা যুক্তিবাদী মানুষ মাত্রেই স্বীকার করে নেবেন। বিজ্ঞান একদিন প্রকৃতির মূল সূত্রকে আবিষ্কার করে ফেলবে সেদিন মানুষ এমন এক নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়ে যাবে যা এ যাবত ঈশ্বর সৃষ্ট বলেই মনে হয়। মানব চেতনা হয়ে যাবে প্রযুক্তির বিষয়। মানুষের জিনের মধ্যে হেরফের ঘটিয়ে এক ধরণের অতিমানব গোষ্ঠির জন্ম হবে যারা ইচ্ছে মতো যতদিন খুশি বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীতে অতি সক্রিয় চেতনার অধিকারি হয়ে। অর্থাৎ খোদার ওপর খোদকারি করে মানুষ ইচ্ছে মতো চেতনাকে পৌঁছে দেবে তার ঈপ্সিত স্তরে।
  সেই দিনও আসবে যেদিন মানুষ সেই যন্ত্র বানিয়ে ফেলবে যা আমাদের মস্তিষ্কের অণু-পরমাণু অথবা অতি-পরমাণ  কণিকার গতিবিধিকে সম্বল করে আমাদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাকে রেকর্ড করে ফেলবে। সেই রেকর্ডের মাধ্যমে অন্য কেউ আমার অভিজ্ঞতাকে তার পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারবে। সেদিন খ্যাত লোকদের অভিজ্ঞতার রেকর্ড বাজারে বিক্রি হবে যা দিয়ে আমরাও তাঁদের অভিজ্ঞতাকে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে একইভাবে অনুভব করতে পারবো। যদি রেকর্ডের গুণ উচ্চমানের হয় তবে বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই ভারচুয়েল অভিজ্ঞতার কোনো তফাৎ থাকবে না। প্রয়োজনে এই ভারচুয়েল এক্সপিরিয়েন্সের রেকর্ড থেকে দুঃখজনক বা একান্ত ব্যক্তিগত অংশকে বাদ দিয়েও বাজারে ছাড়া যাবে।
   এই ভারচুয়েল অভিজ্ঞতার ব্যাপারটা হলো যে আমাদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরের বস্তুকণিকার মধ্যে বাইরে থেকে গতি সঞ্চার করে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে হুবহু উপলব্ধি করিয়ে দেওয়া। মনে করা যাক কেউ একজন বিলাসবহুল একটি পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে সঙ্গীতময় পরিবেশে খুব ভাল খাওয়াদাওয়া করে এলেন। এই অভিজ্ঞতা হবার সময় তার মস্তিষ্কের বস্তুকণিকাগুলোর মধ্যে যে গতি সঞ্চার হয়েছিল তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে রেকর্ড করা হলো। এই অভিজ্ঞতায় আছে দৃষ্টি, ঘ্রাণ, শ্রবণ, স্বাদ ও স্পর্শ। এই সামগ্রিক অভিজ্ঞতার উৎস কিন্তু তার মস্তিষ্কের বস্তুকণিকার গতিবিধি। এমন কি মস্তিষ্কের মধ্যে যে সব রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটবে তাও আসলে অতি পরমাণু বস্তুকণিকার সংযোজন ও বিযুক্তিকরণ। মস্তিষ্কের এই প্রক্রিয়াকে রেকর্ড করে অন্যের মস্তিষ্কে অনুরূপ অভিজ্ঞতার সঞ্চার ঘটানো আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয় না। তাই আমাদের অভিজ্ঞতার এলবাম হয়ত আগামী দিনে ফটোগ্রাফিক এলবামের জায়গা করে নিতে পারে।
  আমরা যখন কোন কিছু দেখি তখন ঐ বস্তু থেকে আলোকরশ্মি এসে আমাদের চোখের রেটিনার মধ্যে পড়ে এবং রেটিনার মধ্যে এক ধরণের ফটোকেমিক্যাল রিয়েকশন ঘটে যা আমাদের মস্তিষ্কের বিশেষ জায়গায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই প্রতিক্রিয়াই আসলে আমাদের দৃষ্টির কারক। আমাদের সামনে যদি ঐ বস্তুটি না থাকে অথবা আমরা যদি চোখ বন্ধ করে থাকি অথচ যদি যান্ত্রিক উপায়ে আমাদের মস্তিষ্কে অনুরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা যায় তাহলেও আমার মনে হয় যে ওই বস্তুটিকে আমাদের না দেখতে পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়।
  আমাদের মস্তিষ্কই যদি না থাকে তাহলে অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো কোনো কাজেই লাগিবে না। কারণ আমরা আসলে চোখ দিয়ে দেখি না, কাণ দিয়ে শুনি না, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিই না, জিহবা দিয়ে স্বাদ বুঝি না বা ত্বক দিয়ে স্পর্শ অনুভব করি না। এ সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি শুধুমাত্র মস্তিষ্কে বার্তা পাঠায়। সমস্ত অনুভুতি হয় মস্তিষ্কে। যদি মস্তিষ্কের এই অনুভূতিকে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করা যায় তাহলে ফলস্বরূপ আমাদের কৃত্রিম অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে যাবে।
    এখন প্রশ্ন হলো যে আমাদের দৃষ্টির বাইরে কি আলো আছে? আলো যা আমরা দেখতে পাই তা আসলে এক ধরণের তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ যা আমাদের চোখের রেটিনার মধ্য দিয়ে সংকেত পাঠিয়ে মস্তিষ্কে যে অনুভূতির জন্ম দেয়, তাই। যদি চোখ কিংবা মস্তিষ্ক না থাকত তবে সেটাকে আলোক বলা সমীচিন হতো কি না তা ভেবে দেখার মতো। আসলে তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ও আমাদের চেতনা, এই দুয়ের সংমিশ্রনে আলোকের সৃষ্টি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘরে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যখন আমরা স্বপ্ন দেখি তখন কিন্তু কোন তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ আমাদের মস্তিষ্ককে উজ্জিবিত করে না। তবু আমরা স্বপ্ন দেখি এবং কি দেখলাম তা জেগে ওঠে বলতেও পারি। অর্থাৎ শুধুমাত্র চেতনা দিয়েও দেখা যায়। তবে মস্তিষ্কের ঐ বিশেষ অংশ যদি কোন কারণে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়েও আলোক সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
 রাস্তায় একটা পটকা ফাটলো। আমি ঘরে বসে সেই আওয়াজ শুনতে পেলাম। এখন প্রশ্ন হল যে শব্দটা কোথায় হলো? সাধারণভাবে আমরা বলব ‘রাস্তায়’। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে রাস্তায় কোন শব্দই হয়নি। রাস্তায় এক ধরণের বায়ুতরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘লঙ্গিচ্যুডিন্যাল ওয়েভ’। সেই বায়ুতরঙ্গের বৃত্তগুলি আকারে বড় হয়ে হয়ে আমার কর্ণকুহরে ঢুকে আঘাত করার ফলে যে বার্তা আমার মস্তিষ্কে পৌছেছে তারই নাম ‘শব্দ’। অর্থাৎ পটকাটা রাস্তায় ফাটলেও শব্দটা তৈরি হয়েছে আমার মস্তিষ্কে।
 এখন প্রশ্ন হলো যে আমার জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বাইরে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কি রকম? অথবা যখন এই বিশ্বে প্রাণের সঞ্চার ঘটেনি তখন প্রকৃতির রূপ কেমন ছিল? নিশ্চয়ই বর্ণহীন, গন্ধহীন, শব্দহীন, স্বাদহীন ও অস্পর্শীয়। যা গরম নয় আবার ঠান্ডাও নয়, শক্ত নয় আবার নরমও নয়, উজ্জ্বল নয় আবার বিবর্ণও নয়, বর্ণময় নয় আবার ফ্যাকাসেও নয়, শুকনো নয় আবার সিক্তও নয়, মিষ্টি নয় আবার তিক্তও নয়, নোনতা নয় আবার টকও নয়, সুগন্ধী নয়, দুর্গন্ধীও নয়, কর্কশ নয়, স্নিগ্ধও নয়। সর্বপরি এই প্রকৃতি ভালো নয় আবার মন্দও নয়। ঈশ্বর যদি ভালো হন তাহলে প্রাণিকূল থাকতে হবে যাদের জন্য তিনি ভালো। প্রাণিকূলবিহনে ঈশ্বর দয়ালু নন আবার নিষ্ঠুরও নন। কারণ নির্জীব বস্তুর ওপর নৈতিকতা আরোপ অর্থহীন। কাজেই ঈশ্বর যদি মানুষ সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তিনি এই কাজের মধ্য দিয়ে নিজের ওপর নৈতিক গুণাগুণ আরোপ করেছেন। তাইতো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর, তুমি তাই এসেছ নিচে। আমায় নইলে ত্রিভূবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।‘
  সৃষ্টিকর্তা সম্ভবত চাইতেন যে তার সৃষ্টি প্রশংসিত হোক। তাই তিনি নিষ্প্রান বস্তু মাঝারে চেতনার জন্ম দিয়েছেন। চেতনার রঙ মিশিয়ে তিনি তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গকে আলোকে রূপান্তরিত করেছেন। পরমাণুর কম্পনকে উষ্ণতায়, বায়ু তরঙ্গকে শব্দে, বাতাসের উদ্বায়ী (volatile) গ্যাসীয় পদার্থকে গন্ধে পরিণত করেছেন। সেই সঙ্গে বস্তুর প্রতিরোধ ক্ষমতাকে স্পর্শানুভূতিতে পরিণত করেছেন। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আসলে বস্তুজগত ও আমাদের চেতনার এক সংমিশ্রিত রূপ। অর্থাৎ প্রকৃতি আমাদের চেতনাকে যে ভাবে প্রভাবিত করে আমরা তাকে সেভাবেই জানি। আমাদের চেতনার বাইরে বস্তুজগত কেমন তা হয়ত আমরা কোনদিনও জানতে পারব না।
  বিশ্বকে যদি আমরা মায়া বলে ভাবি তার কারণ হলো প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম যখন আমরা তাকে প্রত্যক্ষ করি না। প্রকৃতিকে আমরা সবসময়েই আমাদের নিজেদের মতো করে প্রত্যক্ষ করি। তাই যা আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় তা হয়তো আমাদেরই সৃষ্ট এক জগৎ। যেভাবে প্রকৃতি আমাদের ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করছে আমাদের চেতনায় তারই এক প্রতিফলিত রূপ। তাই বলে চেতনার বাইরে বস্তুজগৎ নেই একথা কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ যদি কিছুই থাকত না তাহলে আমাদের দেখার কিংবা শোনার মধ্যে একটা commonness থাকত না। আমি যা দেখি অন্যও তাই দেখে, তাই বস্তুজগতের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। অর্থাৎ আমাদের অভিজ্ঞতায় বস্তুজগত হলো একধরণের ‘subjective understanding of the objective reality’। আমাদের চেতনার বাইরে যে জগৎ তা মানবিক অর্থে নির্গুণ। এই নির্গুণ যদি ব্রহ্ম হয়ে থাকে তাহলে তাহলে এই ব্রহ্ম হলো সত্য আর আমাদের মনের মধ্যে যে জগতের প্রতিফলন দেখি তা মিথ্যা অর্থাৎ মায়া অথবা virtual, আমরা এই ভারচুয়েলকেই ভালবাসি। তাই ভারচুয়েল অভিজ্ঞতাকে মেনে নিতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।

কোন মন্তব্য নেই: