“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫

ভালোবাসার আশ্রয়


সুমিত্রা পাল















ন্যমনস্ক সেই চাহনি
     যেন এক ভাঙ্গা পৃথিবী
বিপদের সাইরেন বেজে ওঠে শিরা উপশিরায়
উড়ে যায় শঙ্খচিল বৃত্ত অসম্পূর্ণ রেখে ।

ছন্দপতনের পরে আত্মমন্থন
সময় ঢেলে দেয় আরও অনেক সময় ...
হয়তো স্তরীভূত সব সময় পেরিয়ে
একসময় সেই চাহনি আঁকবে
     ভালোবাসার আশ্রয় ।
           -------------




শনিবার, ২৭ জুন, ২০১৫

দায়হীনতায়

।। শিবানী দে।।


(C)Image: ছবি







র্তে পড়ে কাঁদছিস ? হে সন্তান, উঠাবো তোরে সেই সাধ্য আছে ?
উদ্ধার করি বা যদি রাখব কোথায় ? এখানে যে কুয়ো আগে পিছে !
দায়হীনতার চোরাবালি তোর খেলবার মাঠে, গৃহকোণ মাঝে,
বিদ্যালয়ে, রাজপথে, মানুষের বানানো সমাজে ।
কোন দহে রুদ্ধ হবে, ডুবে যাবে নির্মল শৈশব তোর, তা কি জানি ?
ধর্ম বর্ণ ভাষা প্রান্ত---কত শত অন্ধকূপে আবদ্ধ আমরা সব প্রাণী ।
কোথা হতে দেব মুক্ত বায়ু প্রাণোৎসার, আলো সুবিমল এনে ?
মলিন অভুক্ত মুখে কাজ করে যাস ক্ষেতে, কলে, বাজারে দোকানে,‌
গলিতে, স্টেশনে কিংবা বীভৎস গণিকালয়ে----
শৈশব হারায় তোর বয়স্কের পঙ্কক্লেদ ঘূর্ণির আবিলে ।
অমৃতসন্ততি তুই, দৃষ্টি আলো অভিসারী,অঙ্গুলি আকাশ ছুঁতে চায়,
উজ্জ্বল স্বপ্নিল আঁখি, তোর হাসি কলভাষে অনাগত রয়েছে আশায় ।
আমাদের নির্ভরতা-হাত তবু কেড়ে নেয় পিছে থেকে বিশ্বাসের মই,
কাপুরুষতার কূপে ফেলে যাই আমাদের প্রজাতন্তুকেই !

শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০১৫

গীতার মাহাত্ম্য



।। সুমিত্রা পাল ।।


(C)Image:ছবি












প্তরথীর আর্য নিনাদ একা গাণ্ডিব
ঘন মায়াজালে সম্পৃক্ত সুকুমার ভাবনায়
গীতার শ্লোক ব্যাপ্ত করে
মহাবিশ্বের অবিনশ্বর রূপ

সৃষ্টি- স্থিতি- লয় এই চক্রে
পরিভ্রমিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
           জাগতিক সুখ দুঃখ
           সম্পর্কসূত্রের নিবিড় গ্রন্থনা অথবা টানাপোড়েন
           স্বাচ্ছন্দ্য মানবীয় মূল্যবোধের অভিব্যক্তি
           ভেসে যায় পাঞ্চজন্যের ফুঁৎকারে
কুরুক্ষেত্র আলোকিত হয়ে ওঠে ।


           ----------------



বুধবার, ২৪ জুন, ২০১৫

সিঁড়ি

।।  রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ ।।

(C)Imageঃছবি















সারারাত। সবকিছু সমার্থক। কথা। শুন্য খরা।
ছুটছি । পোড়া ল্যাপটপ।  মথুরার গল্প।
না। টুলবারে মৃত্যু। সিঁড়ি । লাল পালক।
শামুকের গনিত।  ভুল। ক্রিয়াকলাপ।  গোলাকার।
বাসি জল।  বাতাসে অটোগ্রাফ। বাচ্চা।  নদী।
অফসেট। প্রেম। পথপ্রান্তে বৃত্ত। চরকাকাটা চাঁদ।
প্রোফাইল।  স্পেস নে। হাসছে। প্রতিদিনের মোবাইল।
স্বপ্ন ।  ছায়াতে সংগ্রাম। মুক্তির প্রেক্ষাপট। 

অথচ জল

।। বিজয় ঘোষ ।।

(C)Image:ছবি















লের নাম ধরে ডাকি
জল রূপ পাল্টায়

বাড়ির ঠিকানায় বাড়ি আছে
অথচ জল শুধুই স্রোতস্বিনী

রূপ কথা

।। বিজয় ঘোষ ।।

 

(C)Image:ছবি


















মার মৃত্যুর পর  যা যা ঘটবে তাতে আমি থাকবো না ...
অথচ এটা আমারই মৃত্যু!
কোন এক বর্ষা রাতে অনন্ত বৃষ্টি পড়বে

যে চিতা-কাঠ জ্বলার কথা
তাতে মিশে যাবে বিন্দু বিন্দু জীয়নকাঠি

আমি মৃত্যুটা উপভোগ করব...

মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০১৫

আউল ক্রীক সেতুর ঘটনা

(C)Image:ছবি

                                                                    
(    একদিকে আব্রাহাম লিংকন এর ইউনিয়ন আর অন্যদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলি নিয়ে জেফারসন ডেভিসের কনফেডারেসি  বা সাউথ । ১৮৬১ থেকে ১৮৮৫ র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে ইউনিয়ন জয়ী হয় ।সিভিল ওয়ার শেষে দাসপ্রথা সমাপ্ত হয় এবং অন্য অনেক গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যায় আমেরিকার উত্তরাংশ।  ইউনাইটেড স্টেটস এক শক্তপোক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয় । জয়ীপক্ষ ফেডারেল আর্মির সেকেন্ড লেফটেনেন্ট এমব্রোস বিয়ার্সের এই বিখ্যাত ছোটগল্প "An Occurrence at Owl Creek Bridge" বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ হয়ে আছে । একাত্তর বছর বয়সে তিনি উধাও হয়ে যান । কেউ কেউ বলে ঘাতক হাতে মৃত্যু হয় । তিনসুকিয়ার কাগজ 'উজানে'র আগামী শারদ সংখ্যাতে এই অনুবাদ প্রকাশিত হবে। ---- রণবীর পুরকায়স্থ )
                   ত্তর আলাবামার একটি রেল সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ, আনতদৃষ্টিতে কুড়িফুট নীচে খরস্রোতা জলরাশির দিকে সে তাকিয়ে রয়েছে । মানুষটির হাত দুটো তার পিছনে কব্জি দুটোতে দড়ি দিয়ে বাঁধা । একটি রশি তার গলায় শক্ত করে প্যাঁচানো । তার মাথার উপর একটি শক্তপোক্ত আড়কাঠের সঙ্গে বাঁধা দড়িটি ঝুলে রয়েছে তার হাঁটুর সমানে সমানে । রেলের ধাতব লাইন ধরে রাখার পাটাতনের উপর কিছু খুচরো তক্তা পেতে দেওয়া হয়েছে তার ও তার ঘাতকদের পা রাখার জন্য। ফেডারেল আর্মির দুজন সাধারণ সৈনিক মোতায়েন রয়েছে এক সার্জেন্টের আদেশে, যিনি হয়তো অসামরিক জীবনে কোন শহর বা মহকুমার উপশাসক ছিলেন । স্বল্প দূরে আর একটি অস্থায়ী পাটাতনের উপর তার পদবিসুলভ উর্দিপরা একজন সশস্ত্র অফিসার দাঁড়িয়ে আছে, সে ক্যাপ্টেন ।  সেতুর দুপারে দুজন প্রহরী তাদের বন্দুক তাক করা অবস্থায় দাঁড়ানো, বন্দুক  বাঁ কাঁধের উপর উলম্ব,   হাতটি বুকের উপর থেকে ঘোড়ার উপর রাখা । এক পোশাকি এবং অস্বাভাবিক  অবস্থান।তারা শরীরকে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে । দেখে মনে হচ্ছে না সেতুর মাঝখানে কী ঘটছে তা জানা তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, তারা শুধু তাদের তির্যক অবস্থানে তক্তার পাদানির দুদিককে অবরুদ্ধ করে রাখছে ।

    দূরের দিকে দুজনের মধ্যে একজন প্রহরী ছাড়া আর কাউকেই  দেখা যাচ্ছে না, রেলপথ  সোজা একশ গজ পর্যন্ত বনের দিকে গেছে, তারপর বাঁক ঘুরে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে । নিঃসন্দেহে দূরে আরো একটি চৌকি আছে । নদীর অপর প্রান্তে খোলা মাঠ।সামান্য খাঁড়াই ভূমিতে লম্বালম্বি গাছের  গুঁড়ির বেড়া দেওয়া, বন্দুকের নলের জন্য অনেক ফুটো করা। এর মধ্যে একটি বড় ছিদ্রের ভিতর দিয়ে  পিতলের কামানের মুখ বেরিয়ে আছে যা সেতুর নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করছে । সেতু আর দুর্গের মাঝখানের ঢালু জমিতে রয়েছে দর্শকেরা, এক কোম্পানি পদাতিক সৈন্য ‘বিশ্রাম’ অবস্থায় মোতায়েন রয়েছে । বন্দুকের কুঁদা মাটির দিকে।  নলগুলি ডানকাঁধের দিকে সামান্য হেলানো, হাতদুটো বাটের উপর আড়াআড়ি রাখা । লেফটেন্যান্ট পদাধিকারী একজন সারির ডানদিকে, তার তরোয়ালের তীক্ষ্ণ দিকটি ভূমিগত, আর তার বাম হাতটিও ডান হাতের উপর বিশ্রামে ন্যস্ত । সেতুর মাঝখানে চারজনের দলটি ছাড়া কেউই নড়ছে না । সেতুর দিকে তাকানো সেনা দলটির দৃষ্টিও পাথুরে, নিশ্চল । নদীটির দিকে মুখকরা প্রহরী দুজনও যেন সেতুর শোভাবর্ধনকারী ভাস্কর্য । ক্যাপ্টেন লোকটি দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ অধীনস্থদের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করেছে কিন্তু কোন নির্দেশ দিচ্ছে না । মৃত্যু এমনই এক মহান অতিথি যখন আসে তার আগমন-বার্তা যথাবিহিত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে সবাই , এমন কী যারা এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত তারাও । সামরিক রীতিকানুনের শিষ্টাচারে নিশ্চুপ আর নীরব থাকাই অমিলের রকমফের এখানে ।

   যাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য বেঁধে রাখা হয়েছে তার বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ বছর হবে । সে একজন অসামরিক ব্যক্তি, তার স্বভাবচরিত্র বিবেচনা করলে বুঝাই যায় সে এক তুলোর বাগান মালিক । তার চেহারার আদলও সুন্দর, খাড়া নাক, শক্তপোক্ত মুখমণ্ডল ও চওড়া কপাল । যেখান থেকে সোজা পিছনের দিকে চিরুনি করা দীর্ঘ কালো চুল তার কানের পিছনে মানানসই দীর্ঘ আলখাল্লার কলারের উপর গিয়ে পড়েছে । তার একটি গোঁফ এবং খোঁচাখোচা দাড়ি রয়েছে কিন্তু কোন জুলফি টুলফি নেই। তার চোখগুলি ডাগর ডাগর এবং ঘন কালো । মুখে  এমন দয়ালু ও  অনির্বচনীয়  অভিব্যক্তি, যে  ভাবাই যায় না তার কাঁধের উপর ফাঁসির দড়ি ঝুলছে । স্পষ্টতই এটা কোন সাধারণ হত্যা নয় । উদারনৈতিক সামরিক আইনে সমাজের অনেক ধরণের মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার ধারা রয়েছে এবং যেখানে ভদ্রলোকদেরও বাদ দেওয়া হয় নি ।

   সব প্রস্তুতি শেষ, দুজন সাধারণ সৈনিক একপাশে সরে যায় এবং তারা যার উপর দাঁড়িয়েছিল সেই কাঠের তক্তাও সরিয়ে নেয় । সার্জেন্ট ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় ও স্যালুট করে । এবং সেই  অফিসারের ঠিক পিছনে স্থান করে নেয়, ফলত সেও এককদম ঘুরে যায় । এসব স্থান পরিবর্তনের ফলে দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত মানুষ আর সার্জেন্ট একই তক্তার দুইপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে যা সেতুর তিনটি রেল ধরে রাখা আড়কাঠের ব্যবধানে স্থিত । অসামরিক লোকটি একেবারে শেষপ্রান্তে। কিন্তু পুরো নয়, চতুর্থ  পাটাতনের কাছাকাছি । এই কাঠের টুকরোটি ক্যাপ্টেন এর ওজন সঠিক ধরে রেখেছিল, সেটি এখন সার্জেন্টের কবলে । প্রথমজনের কাছ থেকে সংকেত পেলেই সে একপাশে সরে যাবে আড়কাঠের তক্তাও উল্টে যাবে এবং ফাঁসির আসামি লোকটিও দুই পাটাতনের মাঝখান দিয়ে নীচে পড়ে যাবে । অতি সরল এবং কার্যকরী তার এই বিচারের ব্যবস্থাপনা প্রশংসাযোগ্য তো বটেই । তার মুখ ঢাকা হয়নি এমনকি চোখেও কোন পট্টি বাঁধা হয় নি । সে এক মুহূর্তের জন্য তার নড়বড়ে পায়ের দিকে তাকায়, তারপর স্থিরদৃষ্টিতে বিস্ময়ে তার পায়ের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া উত্তাল জলরাশিকে দেখে । নৃত্যরত একটুকরো কুটো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবং তার চোখ কাঠের টুকরোটির  স্রোতে বয়ে যাওয়া দেখতে থাকে । মনে হয় যেন কী ধীরে বইছে  জল ! কী অলস জলধারাবাহী এই নদী !

     সে তার শেষ ভাবনাচিন্তাকে  স্ত্রী এবং সন্তানে কেন্দ্রীভূত করতে চোখ বন্ধ করে । এই জল প্রভাতী সূর্যের আলোয় সোনার বরণ । অদূরে কুয়াশাভাঙা ঢিবির নীচে নদীর পারের দূরবর্তী দুর্গ, সেনাদল, একটুকরো জলপ্রবাহ এসবই তাকে বিরক্ত এবং বিহ্বল করছে । এখন আবার সে আর  এক নতুন উৎপাতের মুখোমুখি হয় । প্রিয়জনদের চিন্তার মাঝখানে একটা শব্দ যা সে অবহেলা করতে পারে না , বুঝতেও পারে না কিসের ধ্বনি। তীক্ষ্ণ ধাতব ঘর্ষণজাত শব্দ যেন কামানের হাতুড়ি পড়ছে নেহাইর উপর। যার  ধ্বনি একই বশিষ্ট্যে বেজে যাচ্ছে বারবার । সে অবাক বিস্ময়ে ভাবে এটা কী।এটা কী অপরিমেয় দূরত্বের , না খুব কাছের। মনে হচ্ছে যেন দুটোই । নির্দিষ্ট গতিতে বাজছে কিন্তু এত ধীরলয়ে যেন কেউ মৃত্যুঘণ্টা বাজাচ্ছে । সে প্রতিটি ঘা এর জন্য অপেক্ষা করে অধৈর্যে । সে জানে কেন এ অপেক্ষা। কিসের আশঙ্কা । নীরবতার দূরত্ব দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে আর  এই দেরী তাকে পাগল করে তোলে । এই বিশাল বিরল ব্যবধানে শব্দের শক্তি ও তীক্ষ্ণতা যেন বেড়ে যাচ্ছে অনেকগুণ । তার কানের উপর ছুরিকাঘাতের মতো আঘাত করছে শব্দ। সে ভয় পাচ্ছে, সে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে । সে যা শুনছে তা  তার ঘড়ির স্পন্দন । 

      সে আবার তার বন্ধ চোখ মেলে নীচে বয়ে যাওয়া জলরাশি দেখে। আমি যদি আমার হাত দুটো খুলতে পারতাম, সে ভাবে। আমি এই দড়ি দড়া খুলে  নদীতে ঝাঁপ মেরে দিতাম । ঝাঁপ দিয়ে আমি বুলেটের হাত থেকে তো বাঁচতে পারতাম । আর প্রাণপণ সাঁতরে ওপারে পৌঁছে যেতাম । জঙ্গলের  ভিতর দিয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে যেতাম । আমার বাড়ি, ধন্যবাদ ভগবান, আমার পরিজনরা এখনও তাদের সেনাবাহিনীর হিসেবের বাইরে । আমার স্ত্রী এবং সন্তানরা এখনও আক্রমণকারীদের থেকে অনেক দূরে ।

      এইসব ভাবনাগুলি যখন এখানে শব্দরূপ পাচ্ছে, ফাঁসির আসামীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এবং তা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ক্যাপ্টেন সার্জেন্টের দিকে ইশারা করে । সার্জেন্ট একদিকে সরে যায় ।





(২)

       পেটন ফারকুহার একজন সচ্ছল তুলোর বাগানমালিক। বেশ  প্রাচীন এবং সুসম্মানের অধিকারী এক  আলাবামা পরিবারে তার জন্ম । নিজে দাসমালিক হওয়ায় অন্য দাসমালিকদের মতো সে একজন রাজনীতিবিদও বটে।  এবং স্বাভাবিকভাবে  একজন খাঁটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ।সে  আমেরিকার দক্ষিণাংশের  অধিকারের জন্য নিবেদিত প্রাণ ।এখানে বাহুল্য মনে হতে পারে তবু জানা  দরকার,  ওদের স্বেচ্ছাচারী চরিত্রগত অবস্থার জন্য সে সামরিক বাহিনীর চাকরি নিতে চায়নি । যদিও ওরা  শেষপর্যন্ত অসম যুদ্ধে পরাস্ত হয় করিন্থ হাতছাড়া হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে । সে অসম্মানজনক অক্ষমতায় রাগে, আর  রুদ্ধ ক্ষমতা প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে । সৈনিকের মহত  জীবন, স্বাতন্ত্র্য ও  সম্মানের জন্য অপেক্ষায় থাকে । সে জানত সুযোগ আসবেই এবং তা আসেও যুদ্ধকালীন সময়ে । ইতিমধ্যে সে তার পক্ষে করনীয় সব রকম কাজই করেছে । দক্ষিণের স্বাধীনতার জন্য কোন কাজই ছোট নয় জেনে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । কোন ঝুঁকিই এমন বিপদসংকুল নয় একজন অসামরিক ব্যক্তির কাছে যে মনের দিক থেকে  সৈনিকের মতো সঙ্গতিপূর্ণ এবং খুব বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন না হয়েও সম্মতি দেয়।  প্রেমে এবং যুদ্ধে সব কিছুই ঠিকঠাক এই মারাত্মক সরল প্রবাদবাক্য নির্ভর করে ।

      একদিন বিকেলে ফারকুহার এবং তার স্ত্রী বাগানবাড়ির  মুখে একটি মরচেধরা বেঞ্চে বসেছিল, এক ধূসর উর্দিপরা  ঘোড়সাওয়ার সৈনিক তাদের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে জল খেতে চাইল । শ্রীমতী ফারকুহার খুব খুশিমনে নিজহাতে তাকে জলপান করালো । যখন সে জল আনতে ভিতরে যায় তখন তার স্বামী সেই ধূসর ঘোড়সাওয়ারকে আগ্রহভাবে যুদ্ধের খবর জিজ্ঞেস করে ।

      “ইয়াঙ্কিরা রেলপথ মেরামত করছে” মানুষটি বলল, “এবং আরো অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে । তারা আউল ক্রীক সেতু পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সব ঠিক ঠাক করে উত্তরপারে একটা কাঠের দুর্গও  বানিয়ে নিয়েছে । ওখানকার সামরিক অধিকর্তা কিন্তু একটি অধ্যাদেশ জারি করে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে, আদেশে  বলা হয়েছে যে কোন অসামরিক ব্যক্তিকে যদি রেলপথ তার সেতু, সুড়ঙ্গ বা রেলগাড়িতে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কিংবা বাধার সৃষ্টি করতে দেখা যায় তবে তাকে কালবিলম্ব না করে বিনাবিচারে ফাঁসি দেওয়া হবে, আমি নিজে দেখেছি অধ্যাদেশ ।” 

      “আউল ক্রীক সেতু এখান থেকে কতদূর হবে ?” ফারকুহার প্রশ্ন করে,

       “প্রায় ত্রিশমাইল ।”

       “খাঁড়ির এদিকে কোন সেনা নেই ?” 

       “রেললাইনের পাশে আধমাইল দূরে একটা ফাঁড়ি চৌকি আছে । আর একটিমাত্র প্রহরী সেতুর শেষপ্রান্তে ।”

       “মনে করো একজন অসামরিক লোক কিম্বা  ফাঁসি যেতে চায় এমন খ্যাপা কেউ ফাঁড়িচৌকি ফাঁকি দিয়ে প্রহরীর অসতর্কতায় যদি  চলে যায় সংরক্ষিত অঞ্চলে ।” ফারকুহার হাসতে হাসতে বলে, 

       “তার কী হবে ?”

        সৈনিকটি তির্যকভাবে জবাব দেয় ‘মাসখানেক আগে আমি ওখানে ছিলাম ।’ সে বলে, “ আমি গত শীতের সময় দেখেছি ওখানে সেতুর খিলানে অনেক কাঠকুটোর পাহাড় জমে আছে । এখন ওগুলো জ্বলবে পাটখড়ির মতো ।”

        গৃহকর্ত্রী ইতিমধ্যে জল নিয়ে ফিরেছেন, যা সৈনিকটি পান করে । সে অতি ভদ্রভাবে তাকে ধন্যবাদ দেয়, তার স্বামীকেও শরীর নুইয়ে অভিবাদন জানায় এবং ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় । একঘণ্টা পর, রাত হওয়ার পর, সে আবার বাগানে সামনে দিয়ে ফিরে যায়। উত্তরের দিকেই সে যায়, যেদিক থেকে সে এসেছিল । সে ছিল একজন ফেডারেল গুপ্তচর । 



(৩)

  পেটন ফারকুহার যখন সেতু থেকে সোজা নীচের দিকে পড়ে যায় তখন তার চৈতন্য লোপ পায় এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষের মতো পড়ে থাকে । এরকম অবস্থা থেকে সে অনেক পরে জেগে ওঠার পর কণ্ঠে এক ব্যথার তীক্ষ্ণ চাপ অনুভব করে।  শেষে এক দমবন্ধ অবস্থায় প্রগাঢ় এবং  তীব্র ব্যথা তার কাঁধ ও গলা থেকে নামছিল তার শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেয়ে । ব্যথাগুলি তার শরীরের শাখাপ্রশাখায় ধুকপুকিয়ে শব্দ করে যাচ্ছে অকল্পনীয় দ্রুততায় ।মনে হচ্ছে যেন দ্রুত ধাবমান আগুনের স্রোত অসহ্য তাপমাত্রায় তাকে দহন করছে । আর তার মাথায়, তার চেতনায় কিছুই নেই ।কি এক জটপাকানো সম্পূর্ণতার ভার । এসব ব্যথার সঙ্গে তার  ভাবনা চিন্তার কোন ছাপ নেই । তার প্রকৃতিগত বুদ্ধিবৃত্তিও  ইতিমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।  তার এখন শুধু অনুভব করার শক্তি অবশিষ্ট রয়েছে যা এক পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা তার কাছে । সে শুধু অনুভব সচেতন । সে এক উজ্জ্বল মেঘের আলোয় ঘিরে আছে, যার মধ্যে আছে তার জ্বলন্ত হৃদয়, অবয়বহীন ও  অবাস্তব। সে অচিন্তনীয় ঘূর্ণাবর্তে পাক খেয়ে চলেছে বিশাল এক ঘড়ির দোলকের মতো । তখন সহসা এক সঙ্গে দুরন্ত তাৎক্ষণিকতায় বিশাল জলরাশির মতো শব্দ করে তার ভিতরকার আলো ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয় ।এক সন্ত্রস্ত গর্জন তার কানে বাজে আর চরাচর অন্ধকার ও  শীতল হয়ে যায় । তার চিন্তার শক্তি আবার ফিরে আসে ।সে বুঝতে পারে দড়ি ছিঁড়ে গেছে এবং সে নদীতে পড়ে  গেছে । অতিরিক্ত কোন দমবন্ধ অবস্থা নয়, ঘাড়ের উপর ফাঁস লাগানোর দড়িটা ইতিমধ্যেই তার শ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে এবং ফুসফুস থেকেও জল বেরিয়ে গেছে । নদীর মাঝখানে ফাঁসিতে মৃত্যু।  তার কাছে বিষয়টা খুব হাস্যকর মনে হয় । সে চোখ খোলে অন্ধকারে আর দেখে তার উপর একটুকরো মৃদু আলোর রশ্মি। কিন্তু অনেক  দূরের, অগম্য অপ্রবেশ্য। সে ডুবেই যাচ্ছে , কারণ আলো অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা বিন্দুতে পর্যবসিত হচ্ছে । তারপর আবার বাড়তে থাকে এবং উজ্জ্বলতর হয় এবং সে বুঝতে পারে সে জাগছে, জলের উপরে উঠছে, বিরক্তি  সহকারেই সে বুঝতে পারে কারণ সেতো বেশ স্বস্তিজনক অবস্থায়ই আছে এখন । “ফাঁসি দেওয়া এবং জলে ডুবানো” সে ভাবে   “ব্যাপারটা খুব খারাপ নয় । কিন্তু আমি  কিছুতেই গুলি খেয়ে মরতে চাই না ।  না গুলির আঘাতে নয় ; ওটা ন্যায়সঙ্গত নয় ।”

          খুব ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা নয়, কিন্তু তার হাতের একটা তীব্র ব্যথা জানান দেয় সে তার হাত মুক্ত করতে চাইছে । সে তার লড়াই এ মনোনিবেশ করে, যেমন একজন অলস মানুষ জাদুকরের কসরত দেখে অবাক হয় , কী ঘটবে তার প্রত্যাশা ছাড়াই । কী দারুণ প্রচেষ্টা ! কী দুর্দান্ত, কী অমানুষিক শক্তি ! আহ কী দারুণ নৈপুণ্য ! সাবাস, বেশ তো!  রশারশি খুলে যায়, তার হাত দুটো আলাদা হয় এবং উপরের দিকে ভেসে ওঠে, হাতগুলো টিমটিমে আলোর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয় । সে নবীন উৎসাহে দেখে একটাকে,  তারপর অন্যটা দিয়ে কাঁধের উপর থেকে দড়িটা সরিয়ে দেয়।  তারপর ওটাকে ছিঁড়ে সজোরে একদিকে সরিয়ে দেয় । চাঁদের আলো জলের উপর প্রতিবিম্বিত হওয়ায় মনে হয় জলসর্প হেলেদুলে যাচ্ছে । “ওগুলো যেমন আছে রেখে দাও,  ওগুলো যেমন আছে রেখে দাও’ সে ভাবে এই কথাগুলি যেন কেউ তার হাতদুটোকে বলছে । কারণ দড়ির বাঁধন খুলার পর সে অমানুষিক ব্যথায় কাতর হয়েছে যা সে এর আগে কখনো  অনুভব করে নি । তার ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা, মস্তিষ্কে আগুন।  তার হৃদয় যেটা খুব দুর্বল ভাবে দপদপ করছে সেও একটা মস্ত বড় লাফ দিয়ে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে । তার সমস্ত শরীরের হাড় মজ্জা নড়বড়ে হয়ে গেছে, পেশিগুলি ছিঁড়ে যাচ্ছে সহানুভূতিহীন ব্যথায় । কিন্তু তার অবাধ্য হাতগুলি তার আদেশের কোন মূল্য দেয়  না । তারা জলের উপর নিম্নমুখী সাঁতার কাটতে থাকে যাতে সে উপরে ভেসে উঠতে পারে । সে অনুভব করে তার মাথা উঠে আসছে, তার চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সূর্যরশ্মিতে, তার বুক ফুলে উঠছে প্রশ্বাসের দুলুনিতে। এবং শ্রেষ্ঠ ও  চূড়ান্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে তার ফুসফুসে ভরে যায় অনেক শুকনো বাতাস। সে যা সঙ্গে সঙ্গে বের করে দেয় এক তীক্ষ্ণ চীৎকারে । 

         সে এখন তার ইন্দ্রিয়ের সম্পূর্ণ অধিকারে । তারা অবশ্যই অতিপ্রাকৃত ভাবে শান্ত এবং সচকিত । কিছু কিছু বিষয় তাকে এত বিরক্ত করছে যে তার জৈবিক প্রণালী দুম করে অতি তীক্ষ্ণধি এবং পরিশুদ্ধ হয়ে গেছে ।  তারা সব কিছু দেখতে পারছে শুনতে পারছে নিরবচ্ছিন্ন ,যা  তারা এর আগে  পারে নি । সে বুঝতে পারছে যে জলের ফোঁটা তার মুখের উপর পড়ছে এবং যখন পড়ছে তখন প্রতিটি ফোঁটার আলাদা শব্দ সে শুনতে পারছে । সে নদীর ওপারে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। দেখেছে প্রতিটি গাছপালা , তাদের উপর প্রত্যেকটি পোকা মাকড়, ঘাসফড়িং,  সুন্দর দেখতে সব মাছি, ধূসর মাকড়সার জাল এডাল থেকে ওডালে বিস্তৃত । সে প্রতিটি ঘাসপাতার উপর পড়া স্বচ্ছ শিশিরবিন্দুগুলি পর্যন্ত দেখতে পারছে । ঘূর্ণিজলের উপর নাচতে থাকা ডাঁশমশার ডানা ঝাপটানো, জলমাকড়সার লম্বা লম্বা পায়ের ঝাঁপ, দাঁড়টানার মতো শব্দ করে নৌকো বাইছে যেন।সব মিলিয়ে এক সঙ্গীতের মূর্ছনা ।  একটি মাছ তার চোখের নীচ দিয়ে চলে গেল এবং সে শুনল জল আলাদা করে তার শরীরী চলে যাওয়ার শব্দ ।

       সে নদী থেকে উপরে উঠে এলো, এক মুহূর্তে দৃশ্যমান দুনিয়া মনে হল যেন ঘুরছে একটা ছোট্ট পাকে, সে নিজে তার প্রধান কেন্দ্রে । এবং সে দেখে এক সেতু, দুর্গ । সেতুর উপর সৈনিকরা , ক্যাপ্টেন সার্জেন্ট ও দুজন সাধারণ প্রহরী , তার ঘাতক দল ।  তারা নীল আকাশের গায়ে ছায়া ছায়া হয়ে আছে । তারা চিৎকার করছে তার দিকে তাকিয়ে । ক্যাপ্টেন তার পিস্তল বের করছে, কিন্তু চালাচ্ছে না, অন্যরা অস্ত্রহীন । তাদের চলাচল অস্পষ্ট এবং বীভৎস, তাদের দেখতেও লাগছে বিশাল ।

      হঠাৎ সে একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পায় এবং কিছু একটা ছরাত শব্দে জল ভেদ করে যায় তার মাথার কয়েক ইঞ্চির মধ্যে । তার মুখের উপর ঝাঁঝারির জলের মতো ছড়িয়ে যায় । সে আবার দ্বিতীয় গুলির শব্দ শুনে এবং দেখে একটি প্রহরী তার কাঁধে বন্দুক নিয়ে ঘুরছে । তার নল থেকে নীল রঙের ধোঁয়া বেরোচ্ছে । জলের মধ্যে থাকা মানুষটি দেখে সেতুর উপরে লোকটার চোখ ঘুরছে , তার বন্দুকের আওতার ভিতর যা আছে সব দেখছে । সে দেখল লোকটার চোখ পাঁশুটে এবং তার মনে পড়ে সে কোথাও পড়েছে পিংলা চোখের মানুষের নিশানা পাকা হয় এবং সব বিখ্যাত লক্ষ্যভেদীরাই ওরকম । সে যাই হোক এটা তো ব্যর্থ হল ।

    একটা উল্টো স্রোত ফারকুহারকে অর্ধেক ঘুরিয়ে দেয়, সে আবার দুর্গের অপর পারে জঙ্গলের দিকে তাকায় । একটা স্পষ্ট উচ্চস্বর একঘেয়ে গানের মতো বেজে ওঠে তার পিছনে জল ভেদ করে ।  অন্যসব অস্পষ্ট শব্দ ভেদ করে এমনকি বুদবুদের শব্দ যা ক্রমাগত তার কানে বাজছে সব কিছু ছাপিয়ে যাচ্ছে । যদিও সে কোন সৈনিক নয়, সে অনেকবার এরকম শিবির দেখে জেনেছে ঐ শব্দের উৎস, সুচিন্তিত নীরস শব্দভেদী মন্ত্রের মতো গমগমে শব্দের অর্থ । পারে দাঁড়ানো লেফটেনেন্ট তার প্রভাতী কাজকর্মে মগ্ন । কী শীতলতায় এবং নির্মমভাবে স্পষ্ট শান্ত স্বরক্ষেপে সময়কে শাসন করে সতর্কতা জারি করে মানুষটি নিজের ভিতর শান্তি উপলব্ধি করে। কী নিখুঁত মাপা বিরাম নিয়ে গড়িয়ে পড়েছে সেইসব নিষ্ঠুর শব্দগুলি,

     “সাবধান কোম্পানি!  কাঁধে বন্দুক তুলে নাও ! প্রস্তুত হও ! তাক করো ।  গুলি করো” !

   ফারকুহার ডুব দেয়। যত গভীরে পারে সে ডুব দেয় । নায়াগ্রার মতো জল তার কানে গর্জন করে ওঠে । সে শুনতে পায় স্তিমিত বর্জনির্ঘোষের মতো গোলাগুলির শব্দ, আবার সে ভেসে ওঠে, উজ্জ্বল ধাতব আলোকরশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়।  এক এক করে পড়ছে, ধীরলয়ে দুলে দুলে যাচ্ছে নীচের দিকে । কোনো কোনটি  তার মুখ কিংবা হাত স্পর্শ করছে, তারপর গড়িয়ে পড়ছে তাদের অবতরণের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে । একটা তার গলবন্ধনীতে, একটা কাঁধে নামে । এটা একটু অস্বস্তিকর তপ্ত এবং সে সেটা টেনে বের করে ।

   সে যখনই পারের দিকে ওঠে শ্বাস নেওয়ার আশায়, দেখে সে অনেকক্ষণই জলের নীচে রয়েছে, প্রত্যক্ষ কল্পনায় সে ভাটির টানে বেশ দূরে গিয়ে সুরক্ষিত আছে । সৈনিকেরা বন্দুকে গুলিভরা প্রায় শেষ করে এনেছে, সবকটা ধাতব নল পরিষ্কার করার ডাণ্ডাগুলি সূর্যালোকে ঝলসে ওঠে যেহেতু তারা বন্দুকের নল থেকে বের করে আকাশের দিকে ঘুরায় এবং আবার তার নির্দিষ্ট স্থানে ঢুকিয়ে রাখে । দুজন প্রহরী আবার গুলি ছোড়ে স্বাধীনভাবে এবং অকার্যকর ভাবে ।

        

           অপহত মানুষটি সব দেখে তার কাঁধের ওপর থেকে ।  সে এখন স্রোতের পক্ষে প্রাণপণ সাঁতরে চলেছে । তার মস্তিষ্কও তার হাত এবং পায়ের মতো তেজীয়ান ।  সে এখনও ভাবতেও পারছে বিদ্যুৎগতিতে ।

‘অফিসারটি’ সে যুক্তি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ‘এত তৎপর গোলন্দাজ দ্বিতীয় বার আর এই ভুল করবে না । একটি গুলিকে একবার এড়িয়ে যাওয়া সহজ । সে নিশ্চয় ইতিমধ্যে  যে যেমন পারে গুলি করার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে । ভগবান সহায় হও, আমি সবগুলি এড়িয়ে যেতে পারব না ।”

      তার দু’গজের ব্যবধানে একটি ভীতিপ্রদ জলের ছিটের সঙ্গে উচ্চকিত তেড়ে আসা শব্দ ক্রমশ  হ্রাস পায়, যা তার মনে হয় দুর্গ থেকে বেরিয়ে বাতাসে ভ্রমণ করে নদীর জলের গভীরে একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে । একটি জলের তরঙ্গ চাদরের মতো উড়ে এসে তাকে আচ্ছাদিত করে দেয়। অন্ধ করে দেয়, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে । তার মানে এই খেলায় কামানও ব্যবহৃত হচ্ছে । সে যখন তার মাথা এই তুমুল আলোড়ন থেকে মুক্ত করে, সে শুনতে পায় গতিভ্রষ্ট গুলি চলে গেছে বাতাস ভেদ করে অনেক দূরে এবং তা ঐ দূরের জঙ্গলের গাছপালা ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিয়েছে ।

    “তারা একাজ আবার করবে না ।” সে ভাবে “ পরের বার তারা ছররা দিয়ে গুলি করবে । আমাকে তাদের বন্দুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে । ধোঁয়াই আমাকে জানান দেবে। গুলি আসবে অনেক দেরি করে, এ গোলাগুলির পিছন পিছন ছোটে । এটি একটি ভাল বন্দুক বটে ।”

   হঠাৎ তার মনে হয় সে ঘুরছে আর ঘুরছে, লাট্টুর মতো পাক খাচ্ছে । এই জল, নদীর পার, জঙ্গল  এখন অনেক দূরের। সেতু দুর্গ এবং মানুষগুলিও সব অস্পষ্ট এবং একাকার । বস্তুগুলিকে শুধু তার রং দিয়ে চেনা যাচ্ছে । বৃত্তাকার কিংবা লম্বাকৃতি কিছু ইতস্তত রং এসবই সে দেখছে । সে একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে আছে এবং ঘুরছে একই তীব্রতায় একই জায়গায়। এরকম অস্বস্তিকর অবস্থায় থেকে সে অসুস্থ বোধ করছে । কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে উড়ে গিয়ে পড়ে পাথরের উপর, নদীর বাঁদিকে । দক্ষিণপারের একটা শুকনো জায়গা যেখান থেকে তার শত্রুরা তাকে দেখতে পাবে না । হঠাৎ এই গতি, তার এক হাত পাথরে ঘষে যাওয়ায় সে থামে, আনন্দে কেঁদেই ফেলে । সে তার আঙুল দিয়ে বালি খুঁড়ে এবং মুঠো করে তারই উপর ছুঁড়ে দেয় যাতে একটা অন্তত শব্দ বর্ষিত হয় । এ গুলোকে দেখতে হিরে চুনি পান্নার মতো লাগছে। সে ভাবে আর কী কী আছে সুন্দর যার মতো লাগছে এগুলি । পারের গাছগুলিও তার বাগানের মতো বিশাল, সে ওগুলোর সারিবদ্ধ ভাবে সেজে থাকার একটা বিশেষত্বও লক্ষ করে ।ওদের ফুলের গন্ধও শোঁকে । একটা আশ্চর্য গোলাপি আভা তাদের ডালপালার ভিতর দিয়ে ইওলিয়ার বীণা থেকে নির্গত সঙ্গীতের মতো বাতাসের দোলায় তাদের ডালপালা থেকে নির্গত হচ্ছে । তার পলায়নকে নিখুঁত করার কোন সদিচ্ছাই এখন তার নেই। সে নিশ্চিন্তে এখানে এই অপার্থিব পরিবেশে শুয়ে থাকতে চায় যতক্ষণ না তাকে কেউ সরিয়ে নিচ্ছে ।

       একটা শাঁ শা এবং ঝনঝনানো ছররার শব্দ তার মাথা থেকে অনেক উপর গাছের ডালের উপর দিয়ে চলে যাওয়ায় তার স্বপ্ন ভেঙে যায় । বিভ্রান্ত কামানদার  তার দিকে ক্রমাগত গোলা ছুড়ে যেন তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে । সে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায়।  দৌড়ে যায় ঢালু পারে এবং ঝাঁপ দেয় জঙ্গলের ভিতর ।

        সারাটা দিন  সে ঘুরে বেড়ায়। মাথার উপর সূর্য গোল হয়, তবু সে দৌড়য় । জঙ্গলের কোনো  শেষ নেই। কোথাও সে থামার পথ পায় না, একটা কাঠুরের বুনো পথ পর্যন্ত নেই । সে জানতই না যে এরকম একটা বনাঞ্চলে সে বাস করত । একটা অস্বাভাবিক অবাস্তব কিছু সে অনুভব করে ।

        রাতের দিকে সে ক্লান্ত, ক্ষতপদ এবং ক্ষুধায় মুমূর্ষু হয়ে পড়ে । স্ত্রীও ছেলেমেয়ের কথা ভাবে । শেষ পর্যন্ত সে একটা পথ খুঁজে পায় যা তাকে সঠিক দিশা বাৎলে দেয় । এটা শহুরে পথের মতো বড় এবং সোজা । তাও  মনে হয় এখানে কেউ  হাঁটে না, কোনোদিন হাঁটেনি । খুব বেশি না হলেও কুকুরের ডাকে বুঝা যাচ্ছে মনুষ্যবসতি আছে কাছাকাছি । গাছের কালো গুঁড়িগুলি রাস্তার পাশে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুদিকে, যেন দিগন্তে গিয়ে শেষ হয়েছে এক বিন্দুতে। যেন চিত্রানুপাতিক দৃশ্যের অঙ্কন শেখানো হচ্ছে । যখন সে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মাথার উপর আকাশ দেখে, তারাগুলিকে বড় অপরিচিত লাগে, এবং এক আশ্চর্য তারকাপুঞ্জেও বিভক্ত মনে হয় । সে নিশ্চিত ওদের ওরকম জড়ো হওয়ার কোন গোপন এবং অশুভ অভিসন্ধি আছে । জঙ্গলের দুদিকে সে শুনতে পায় একই কোলাহল, যার মধ্যে একবার দুবার এবং বারবার সে স্পষ্টভাবে শুনতে পায় এক অপরিচিত কণ্ঠের ফিসফিসানি ।

     তার কাঁধে ভীষণ ব্যথা । সে হাত উঠিয়ে অনুভব করতে গিয়ে টের পায় মারাত্মক ভাবে ফুলে গেছে । সে জানে ওখানে একটা গোল কালো দাগ আছে যেখানে দড়িটা বাঁধা ছিল । তার চোখ ঝাপসা হয়ে আছে । কিছুতেই বন্ধ করতে পারছে না । জিহ্বা তেষ্টায় ফুলে গেছে। উত্তেজনা কমাতে সে দাঁতের পাটির মাঝখান দিয়ে বের করে ঠাণ্ডা বাতাসে কিছুক্ষণ মেলে দেয় জিভ । কী মোলায়েম ভাবে ঘাসগুলি গালিচার মতো কুমারী পথের উপর বিছানো রয়েছে । সে আর পথের কোন অনুভব পাচ্ছে না পায়ের নীচে ।

     নিশ্চিতভাবে তার এত কষ্টের মধ্যেও সে ঘুমিয়ে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে, কারণ সে এখন অন্য দৃশ্যে চলে গেছে। বোধহয় সে এক বিকারের ঘোর থেকে সদ্য উঠে এসেছে । সে তার বাড়ির দোর গোঁড়ায়  দাঁড়িয়ে আছে । সে যেমন ছেড়ে গেছিল তেমনই তো আছে , সবই সুন্দর এবং উজ্জ্বল হয়ে আছে প্রভাতী সূর্যালোকে । সে তো সারারাত পথ হেঁটেছে । সে যখন ধাক্কা দিয়ে গেট খুলে প্রশস্ত সাদা রাস্তা  দিয়ে ঢুকছে, সে দেখে নারীর কাপড় বাতাসে উড়ছে, তার স্ত্রীকে দেখতে বেশ শান্ত ও মিষ্টি লাগছে । বারান্দা থেকে হাসিমুখে নেমে আসছে তাকে দেখতে । সিঁড়ির নীচে সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে এক অনির্বচনীয় আনন্দে।  কি অপরূপ তার  সৌন্দর্য আর  গাম্ভীর্য । আহ ! সে কী সুন্দর ! সে উৎসাহে আনন্দে এগিয়ে যায়, হাত বাড়িয়ে দেয় । সে যখনই তাকে অনুভব করতে যায় এক বিরাট ধাক্কা তার ঘাড়ের পিছনে । অন্ধ করা এক সাদা আলো জ্বলে ওঠে, যার শব্দ কামানের গোলার মতো। তারপর সব অন্ধকার ও নিস্তব্ধ ।

    পেটন ফারকুহার মৃত। তার দেহ, ভাঙা কাঁধ নিয়ে মৃদু দুলেছে এদিক থেকে ওদিকে আউল ক্রীক সেতুর নীচে কাঠের গুঁড়ির তলায় ।

    







সোমবার, ২২ জুন, ২০১৫

পিতৃদিবসের কবিতা



।। দেবলীনা সেনগুপ্ত।। 














বাবা,
তোমার ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা,
তোমাকে দেখলেই
তোমার ছোঁয়া পেলেই
তোমার আদরের ডাক শুনলেই
যার অভিমানী মন
দুচোখ বেয়ে মুক্তো হয়ে
গলে গলে পড়ত ,
সে তেমনই আছে,
তেমনই আছে
তার সব ব্যথা আর অভিমান৷
গোত্রান্তরের রাতে,
তুমিই তো একফাঁকে বলেছিলে----
যা কিছু বদল ঘটুক
যা কিছু নতুন আসুক
অভিপ্রেত অনভিপ্রেত জীবনজুড়ে
সবটুকু হাসি দিয়ে ভরে দিতে
আলো দিয়ে মালা গেঁথে
গান দিয়ে সুরে সুরে
লক্ষী মেয়ের মত
সব কথা শুনেছি তোমার, মেনেছিও----
তবু মাঝে মাঝে
বড় সাধ হয়
সেই কচি বালিকার মত
বৃষ্টি আসুক দুচোখ ঝেঁপে
মনের আকাশ জুড়ে
তোমার মায়া পরশ পেয়ে
রামধনু রং আলো ছড়াক
নতুন করে-----

শনিবার, ২০ জুন, ২০১৫

প্রাইভেট টিউশনি ও শিক্ষা অধিকার আইন

।। সুদীপ নাথ।।

টা সর্বজনবিদিত যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ শিক্ষা প্রদান করা হলে, গৃহশিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা থাকার কথা নয়। তথাপি প্রাইভেট টিউশন ছাড়া আজকাল চলেই না। এই প্রাইভেট টিউশনির সুফল আর কুফল নিয়ে অনেক দিন থেকেই আমাদের রাজ্য সহ দেশের জনগণ বিশেষত পড়ুয়াদের মা-বাবারা চর্চা করেই যাচ্ছে। এই সমস্যা রাজ্যের হাইকোর্ট অব্দি গড়িয়েছে। এই সমস্যা কিন্তু আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের  বাইরেও এর চর্চা আছে। আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় প্রাইভেট টিউশনির সংস্কৃতি কখনোই ছিল না, কিন্তু এখন প্রায় সব দেশেই তার চল হয়েছে। তবে গৃহশিক্ষকতা নিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশ সম্প্রতি সর্বপ্রকার প্রাইভেট টিউশনি, এমনকি কোচিং সেন্টার বন্ধেও কঠোর আইন কার্যকর করেছে। কিন্তু আমাদের রাজ্যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে সরকারি ও সরকার নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে।  আইন আমাদের দেশেও আছে।  কিন্তু তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তা সকলেই দেখছেযার ফলে আমাদের দেশে জনগণ আইনের প্রতি সম্মান দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত আইনের শাসন পেতে চাইলে কথায় কথায় হাই কোর্টে যেতে হয়। এদিকে , ত্রিপুরার প্রায় একশ শতাংশ নাগরিক নাকি শিক্ষিত। এমতাবস্থায়, বিষয়ের গভীরে না গিয়ে উপায় নেই, যেখানে হাই কোর্ট ইতিমধ্যে নির্দেশিকা জারি করেছে। হাই কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশিকা নিয়ে, জনমনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ত্রিপুরায় এমন কোন ছাত্র-ছাত্রী খোঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে, যার গৃহশিক্ষক নেই।


(দৈনিক সংবাদ, ১৯ জুনে প্রকাশিত লেখা)
         এবার প্রথমেই আইনের দিকটা একটু দেখে নেয়া যাক। উদয়পুরে বহু বছর আগেই, স্থানীয় আদালত সরকারি শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়। এটা পরিষ্কার বুঝতে হবে যে, নিম্ন আদালত শুধুমাত্র আইন কার্যকরী হচ্ছে কিনা তা দেখতে পারে। এবং সেক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। আইন মোতাবেক কোন সরকারি শিক্ষক কোনদিনই প্রাইভেট টিউশনি করতে পারে না। এটা নূতন কিছুই নয়। যেকোনো সরকারের লাগু করা আচরণ বিধিতেই তা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। বর্তমানে চালু এই রাজ্যের বিধি TRIPURA STATE CIVIL SERVICES (CONDUCT) RULES 1988 এর   Rule 15(4) এ বলা আছে-  Unless otherwise provided by general of special orders of Government, no Government employee may accept any fee for any work done by him for any private or public body or any private persons without the sanction of the prescribed authorityএখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি ফি ছাড়া কেউ পড়ায়, তবে কি এই রুল কোন বাধা দেয় কিনা। এইখানে তখন Rule 3 চলে আসবে। যাতে বলা হয়েছে  Every Government Employee shall at all times maintain absolute integrity and devotion to duty



         এ তো গেল রাজ্যের বিধি নিয়ম। কিন্তু ২০১০ সালে দা রাইট অফ চিলড্রেন টু ফ্রি এন্ড কমপলসারি এডুকেশন এক্ট ২০০৯ (The Right of Children to Free and Compulsory Education (RTE) Act, 2009) সংক্ষেপে রাইট টু এডুকেশন এক্ট  লাগু হয়। সাথে সাথে, সমস্ত দেশেই প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা অধিকার আইনে গৃহ শিক্ষক নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছেএই আইনের 28 নম্বর ধারায় বলা হয়েছে No teacher shall engage himself or herself in private tuition or private teaching activity কিন্তু এই আইনের আওতায় ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়েসের ছেলেমেয়েরাই আসে। তার কম বা বেশি বয়েসের ছাত্রছাত্রীরা এই আইনের অধীন নয়। তবে তিন থেকে ছয় বছরের ছেলেমেয়ের জন্যে প্রি-প্রাইমারী শিক্ষার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আর এই আইনে স্কুল বলতে বোঝায় প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি যা এখানে এলিমেন্টারি এডুকেশন নামেই বিধৃত করা আছে। নবম শ্রেণি থেকে উপরের দিকে প্রাইভেট টিউশনি চলবে না এমন কথা বলা হয়নি। 

               এটা বহুল প্রচারিত যে, এই আইনেই ক্লাস এইট পর্যন্ত পরীক্ষা প্রথা তুলে দেয়া হয়েছে। কারণ এক থেকে চৌদ্দ বছর বয়েস অব্দি বয়েসের ছেলেমেয়েরাই ওয়ান থেকে এইট পর্যন্ত ক্লাসে পড়ে এবং পড়বে। এই আইন ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতও বেঁধে দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে-  ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতও বেঁধে দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে the Pupil Teacher Ratio (PTR) should be maintained at school level at 30:1 and 35:1 at primary and upper primary level, respectivelyএবং বলা হয়েছে প্রতিটা শিক্ষকের জন্যে একটা ক্লাস রুম বাধ্যতামূলক ( It also provides that there should be at least one classroom for every teacher)এই আইনে আরো বলা হয়েছে যে, সরকারের অনুমোদন না নিয়ে কেউ কোন ধরণের বিদ্যালয় চালাতে পারবে না। এতদিন বিদ্যালয় চালু করে অনুমোদন নিতে হত, কিন্তু এখন তা হবে না। এখন আর ব্যাঙের ছাতার মত বিদ্যালয় গড়ে তোলা যাবে না। তবে এই আইনে, ছয় বছরের নীচের দিকে কোন বিধি-নিষেধ করা হয় নি। চৌদ্দ বছরের উপরেও কোন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয় নি।

            এই আইন মোতাবেক প্রাইমারি স্কুলে মোট স্টুডেন্ট ষাট পর্যন্ত থাকলে দুজন শিক্ষক রাখতে হবে। তার উপরে নব্বই পর্যন্ত তিন জন, তার উপরে একশ কুড়ি পর্যন্ত চার জন, তার উপরে দুইশ পর্যন্ত পাঁচ জন শিক্ষক থাকতে হবে। দেড়শ ছাত্রের জন্যে একজন প্রধান শিক্ষকও রাখতে হবে। দুইশতের উপরে প্রতি চল্লিশ জন ছাত্র পিছু একজন শিক্ষক থাকতে হবে। আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি স্কুলে প্রতি পঁয়ত্রিশ ছাত্রের জন্যে একজন শিক্ষক যার মধ্যে বিজ্ঞান, অঙ্ক, সমাজবিদ্যা আর ভাষা নিয়ে বিষয় শিক্ষক আবশ্যিক। এই আইন অনুযায়ী প্রাইমারী স্কুলে দুইশ দিন ক্লাস এবং তার মধ্যে বছরে আটশ ঘণ্টা পড়াশোনাসিনিয়র বেসিকে দুইশ কুড়ি দিন ক্লাস এবং তার মধ্যে বছরে এক হাজার ঘণ্টা পড়াশোনা। আর প্রতি সপ্তাহে, পঁয়তাল্লিশটি ক্লাস হবে প্রস্তুতি সহ। এইসব যেকোনো বিধি নিয়ম নিয়ে কারও কোন অভিযোগ থাকলে তা রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনে জানাতে পারবেন। অন্যথায় সরকারের কাছেই অভিযোগ জানাবেন। এই আইনে অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য।

            এবার অতীতের দিকে একটু তাকানো যাক। ভারতবর্ষে অতীতে শিক্ষাদান ছিল ব্যক্তি কেন্দ্রিক। তাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে, পিতা-মাতা ও বাড়ির বড়দের থেকে যেখানে পরম্পরাগতভাবে চলে আসত জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞানার্জন-এর প্রক্রিয়াটিআরেকটি হচ্ছে, গুরুগৃহে শিক্ষালাভ করা, যেখানে অধ্যয়ন হত নৈতিকতা, দর্শন, ধর্ম, জীবনচর্চা ইত্যাদি এমনকি অস্ত্র শিক্ষা নিয়েওএটাই আমাদের দেশের প্রথম শিক্ষাঙ্গন তথা বিদ্যালয় হিসেবে চিহ্নিত। একটি পর্যায়ে এর থেকেই সমাবর্তন প্রথার সৃষ্টি হয়। রাজতন্ত্রের বিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে, রাজগৃহে প্রথম প্রাইভেট টিউশনি চালু হয়, রাজকন্যা ও রাজ পরিবারের অন্য মেয়েদের শিক্ষাকে সামনে রেখে। এইগুলোও প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ই বটে। পরবর্তীতে কিছু বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলেও, সেগুলো ছিল মূল স্রোতের বাইরে, যেমন নালন্দা। তবে তখনকার শিক্ষা বৈষয়িক সমৃদ্ধিতে খুব একটা কাজে আসত না।

             ঐ সময়ে গুরুদক্ষিণা প্রথা চালু ছিল, কিন্তু তখন তা পেশাদারী রূপ ধারণ করেনি। তখন শিক্ষাদান পণ্য হয়ে উঠেনি। তখন যথার্থই তা ছিল জ্ঞানার্জনকে সামনে রেখেই। কিন্তু সমাজ বিবর্তনের হাত ধরে, এখন শিক্ষাও একটা পণ্য। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে এদেশে নিয়ে আসে ব্রিটিশেরা, তাদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সাফল্যের সাথে ধরে রাখতে। এবার সেদিকেই চোখ ফেরানো যাক।

           দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বিদেশি শাসকগণ ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও উদাসীন। এরা দেশীয় শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় ও মূল্যহীন মনে করতেন। তারা চেষ্টা করতেন দেশীয় শিক্ষাকে কিভাবে এদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষার নামে ইংরেজি শিক্ষাকে এদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৮১৩ সালে সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতের জনগণের শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত এক লাখ টাকা কিভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় করা হবে, এ সম্পর্কে লর্ড ম্যাকলের প্রদত্ত মতামতই প্রথম পদক্ষেপ। তা নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি নামে অভিহিত। ম্যাকলের মতে, এমন এক শ্রেণীর লোক গড়তে হবে যারা তাদের দোভাষীর কাজ করবে। তারা হবে এমন এক শ্রেণীর লোক যারা রক্তে-বর্ণে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, নীতি ও বুদ্ধিতে ইংরেজ। এতে দেশীয় ভাষা, সাহিত্য, প্রাথমিক শিক্ষা শক্তিহীন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠনের পথনির্দেশনামূলক সুপারিশ পেশ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে অনেক শিক্ষা কমিশন সময়ে সময়ে গঠন করা হয়েছে

               ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠনের সর্বপ্রথম উদ্যোগ সূচিত হয় ১৮৫৪ সালে শিক্ষা উদ্যোগই বাংলায় আধুনিক গণশিক্ষার আইনি ভিত্তি রচনা করে। ইংরেজি ও মাতৃভাষার মাধ্যমে বাস্তবসম্মত জ্ঞানদানের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ছিল এর মুখ্য ফলশ্রুতি। তা ছিল বাংলায় মেয়েদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রচলনের সুপারিশ সম্বলিত অন্যতম প্রথম দলিল

           কিন্তু দীর্ঘদিন পরও পরিকল্পনাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায়, জনমনে অসন্তোষের সৃষ্টি হলে, ১৮৮২ সালে লর্ড রিপন ভারতের জন্য প্রথম শিক্ষা কমিশন বসান।
              ১৮৮২ সালে উইলিয়ম হান্টারকে চেয়ারম্যান করে প্রথম এই ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন সরকারি অনুদান ব্যবস্থার মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষা বেসরকারি উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেয়া, স্কুলে অভ্যন্তরীণ ও প্রবেশিকা পরীক্ষা চালু করা এবং মাধ্যমিক স্কুলে ট্রেইনড টিচার নিয়োগের সুপারিশ করে। হান্টার কমিশনই সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বলে বর্ণনা করে। প্রথম শিক্ষা কমিশন হিসেবে হান্টার কমিশন উপমহাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।   পরে ১৯০১ সালে লর্ড কার্জন একটি সরকারি সিদ্ধান্তের আদলে ১৯০৪ সালে তাঁর শিক্ষানীতি প্রকাশ করেন। এই শিক্ষানীতিতে হাইস্কুল পর্যায়ে, বিশেষত পাবলিক স্কুলে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ সম্প্রসারিত করা হয়।

               তারপরে, ১৯১৭ সালে একটি কমিশন গঠিত হয়। এ কমিশনকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনও বলা হয়। ভারতীয় শিক্ষা পরিকল্পনায় এটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল। মাধ্যমিক শিক্ষা সংস্কার এবং পরিকল্পনার জন্য এ কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপনসহ আরো অনেক সুপারিশ করেএই কমিশন ইন্টারমিডিয়েট পাসকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা বলে বিবেচিত করে। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য উচ্চ শিক্ষার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। এদেশের শিক্ষার ইতিহাসে এত মূল্যায়ন আর কোন রিপোর্টে নেই।



                 এরই ফলশ্রুতিতে, ১৯১৯-১৯২১ সালের শিক্ষা সংস্কারের আওতায় পৌরসভা এলাকায় ও গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয় এবং ১৯৩০ সালের বেঙ্গল প্রাইমারী এডুকেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে বঙ্গদেশে প্রথম সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলনের পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ১৯৩০ সালে প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগ গঠিত হয় এবং এই করে শুরু হয় শিক্ষাকে কেন্দ্রনির্ভর ও আমলা নিয়ন্ত্রিত করার প্রক্রিয়া।


ভারতে ব্রিটিশ আমলে যতগুলো শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছিল তন্মধ্যে সার্জেন্ট পরিকল্পনা ছিল গুণগত দিক থেকে তাদের জন্যে অত্যন্ত উপযোগীতা ছিল ৪০ বছরের (১৯৪৪-১৯৮৪)। এতে বলা হয় মোট শিক্ষা খাতে খরচের প্রায় ১১% আসবে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য উৎস থেকেঅবশিষ্ট প্রায় ৮৯% খরচ তোলা হবে জনগণের থেকে সরকারি ট্যাক্স/কর থেকে। এই পরিকল্পনায় প্রাথমিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা প্রভৃতির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। পরবর্তীতে এদেশের শিক্ষা পরিকল্পনার অনেক উপাদান সার্জেন্ট পরিকল্পনা থেকে নেওয়া হয়েছে।  





স্বাধীন ভারতের সংবিধানে ছিল প্রথম দশ বছরের মধ্যেই সকলের জন্যে শিক্ষাবাস্তবায়ন করা। কিন্তু তা সফল হয়নি। এর পরে একে একে তিন তিন খানা জাতীয় শিক্ষা কমিশন গড়া হয়েছে সেই ষাটের দশক থেকে। আর ১৯৮৬ সালে ঘোষিত হয় জাতীয় শিক্ষা নীতিতথা  National Education Policy 1986 কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে, এসবে কোন কাজ হয়নি। ব্যবসায়ীরা বিদ্যাকে তাদের অন্যান্য সমস্ত পণ্যের সাথে যুক্ত করে। নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর অব্দি সমস্ত স্তরেই থাবা বসায়। রমরমিয়ে তা বাড়তে বাড়তে সরকারি ঘোষিত নীতি আর পরিকল্পনাকে স্তব্ধ করার অভিপ্রায়ে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে প্রাইভেট টিউশনি। অভিভাবকেরা দিশেহারা হয়ে, যে যেমন পারে এদিক ওদিক ছুটতে গিয়ে বার বার হোচট খেয়ে খেয়ে, এই আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

ঠিক এমনই একটা প্রেক্ষাপটে, বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা, ব্যবসায়ীদের বিদ্যা ব্যবসা আর প্রাইভেট টিউশন নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে, কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা অধিকার আইন ২০০৯ বলবত করে। এই আইনের ধারা অনুযায়ী প্রাইভেট টিউশন বিলোপ করা হয়েছে কিন্তু তা ওয়ান থেকে এইট অব্দি। আমার মনে পড়ে, আমি একটা স্কুলে ত্রিপুরা গভর্ণমেণ্ট ডক্টরস এসোসিয়েশনএবং একটা এনজিওর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সন্তানের সার্বিক বিকাশে পিতা-মাতার ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্যে বলেছিলাম, ক্লাস এইট অব্দি প্রাইভেট শিক্ষক না রাখাই উচিত। ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল আমার কথাকে সমালোচনা করেছিল। কিন্তু আজ শিক্ষা অধিকার আইনে এটা বাস্তবায়িত হবার মুখে। আমি বলেছিলাম, ছোট বয়েসে প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়লে, যান্ত্রিকভাবে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। এতে স্টুডেন্টদের পক্ষে সাবজেক্ট ম্যাটারে মাথা খেলানোর অবকাশ থাকেনা বা কমে যায়। বুদ্ধির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা পরে বিপদ ডেকে আনতে পারে।

যাইহোক, গৃহশিক্ষকতার কুফল হিসেবে দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা তাদের নিজেদের প্রাইভেট ছাত্রদের সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিকে ভ্রূক্ষেপ করেন না। এতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতির পাশাপাশি শিশুমনে বিরূপ প্রভাব পড়েগৃহশিক্ষকতা করার মানসে শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিক মতো পাঠদান না করে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিজের উচ্চ অবস্থান ধরে রাখতে প্রাইভেটে বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা করে থাকেন। যাতে ওই শিক্ষকের কাছে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই পরীক্ষান্তে মেধা তালিকায় শীর্ষ স্থানগুলো দখল করতে পারে এবং ওই শিক্ষকের প্রাইভেট ব্যবসা জমজমাট হতে পারে। গৃহশিক্ষকতার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠীরা সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেয়ে প্রাইভেট টিচার কেন্দ্রিক চলাফেরার প্রবণতা থাকে।  এটা শিশু-কিশোরের মন ও মেধা বিকাশের অন্তরায়। স্কুলের একজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়লে ওই শিক্ষক ছাড়া অবশিষ্ট শিক্ষকেরা ওই শিক্ষার্থীকে আন্তরিকতার চোখে দেখেন না। এতে শিক্ষার্থীরা হীনমন্যতায় ভোগে। একাধিক বিষয়ে প্রাইভেট পড়ায়, একজন শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয়ের পরিমাণটা সহজেই অনুমেয়। আর এটা নিঃসন্দেহে অভিভাবকদের জন্য যে বোঝা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এদিকে, ত্রিপুরার প্রায় সব ক'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক নামমাত্র শিক্ষকের চাকুরিতে নিয়োজিত থাকলেও তাদের মূল পেশা হচ্ছে প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং, বীমা, ঠিকাদারি, দোকান, সাপ্লাই ইত্যাদি ব্যবসাসহ নানা প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকা। আর এসব কারণে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের ঠিকমতো পাঠদান না করে তাদের কাজে ব্যস্ত থাকেন। এমন শিক্ষকও আছেন, যারা সবসময় বিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিয়ে নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এতে করে স্কুলে শিক্ষার হার ও মান কমতে থাকে। এসব তো হচ্ছে বেআইনি কাজ। কিন্তু এই নূতন আইনে, ছাত্র-শিক্ষকের যে অনুপাত থাকা বাধ্যতামূলক, তা মানা হচ্ছে কতটুকু তা নিয়ে কিন্তু সরকার নীরব। আর আনুপাতিক সংখ্যক টিচার দিলেও, দশ শতাংশ লিভ ভ্যাকান্সির দিকটা কেউ ভেবেও দেখে না। প্রতি দশ হাজার কর্মচারী পিছু এক হাজার জন অতিরিক্ত নিয়োগ করতে হয়। আমলারা কেবল গোঁজামিল দিয়েই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে যেয়ে, নিজেদের জালেই জড়িয়ে পড়ছে। নাহলে এই আইন তৈরি হত না। এই আইন মোতাবেক শিক্ষকদের সেন্সাস, ডিজাষ্টার আর নির্বাচনের কাজ ব্যতিত অন্য কোন কাজে নিয়োগ করা যায় না। কিন্তু সেটা সরকার মানছে কিনা তা আমলারাই ভাল বলতে পারবেন। আর, সেনসাস ও নির্বাচনের কাজে পড়ানোর যতটুকু সময় কমে যাচ্ছে, তা পূরণ করার কী ব্যবস্থা সরকার নিচ্ছে, তা এখনো অজানা। এসব নিয়ে কোন বিবৃতি নেই সরকারের।



হাইকোর্ট কখনোই আইন এবং নীতি বিরুদ্ধ কিছু বলে না। হাই কোর্টের রায় এবং নির্দেশ নিয়ে কোন ওজর আপত্তি থাকলে যেকেউ রিভিউ পিটিশন বা নূতন করে রিট পিটিশন করতেই পারেন আইনের দ্বার সর্বদাই খোলা। সরকারের টালবাহানার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা যেতেই পারে। কোন আইন যা যুগোপযোগী নয়, তা পরিবর্তন করতে জনমত গড়ে তোলা যেতেই পারে। কিন্তু প্রচলিত আইন ভাঙতে সরকারকে চাপ দেয়া অন্যায়। চলুন এবার দেখে নিই প্রচলিত আইনেই এই টিউশনি চালু রাখা যায় কিনা।



আমরা দেখেছি, কোন সরকারি কর্মী ফি নিয়ে কোন প্রাইভেট সার্ভিস দিতে পারে না। তাহলে সরকারি ডাক্তাররা কিভাবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে ? আসলে TCS(Conduct) Rule 1988 এর   Rule 15(4)-ই বলা আছে সরকার সাধারণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কোন কাজ ফি নিয়ে করতে দিতে পারে এবং কর্মচারীরাও ব্যক্তিগতভাবে আবেদন করে ফি নিয়ে কোন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারে যার যেমন ইচ্ছে। এই জন্যেই ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস অবৈধ নয়। কিন্তু শিক্ষকদের বেলায় শিক্ষা অধিকার আইনে আজ প্রাইভেট টিউশনি অবৈধ, তবে তা অষ্টম শ্রেণি অব্দি সীমাবদ্ধ বলেই দেখা যাছেএমতাবস্থায়, সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং ব্যবসা অষ্টম শ্রেণি অব্দি বেআইনি হয়ে গেলেও, রাজ্য সরকার ইচ্ছে করলেই ডাক্তারদের মত শিক্ষকদেরও অনুমতি দিতে পারে বলেই মনে হয়এতে কোন সংশয়ের কারণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।



সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় বলেছে যে আমাদের দেশের একটি আইন পরিস্থিতির সাথে সাযুজ্য না থাকলে বাতিল করা যেতেই পারে ( A law which is not reasonable, fair and just may also be held to be violative of Article -14, Ref: AIR 1978 SC 597 also 1978 SCC(1)248)আরেকটি মামলায় বলেছে শিক্ষিত অশিক্ষিতের সত্তর শতাংশ নাগরিক আইনি অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় (Ref: Suk Das & another Vs Union Territory of Arunachal Pradesh 1986)এই দৃষ্টিকোণ থেকে ত্রিপুরার আপামর অভিভাবক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েই দেখবে বলেই মনে হয়। যদি কেউ মনে করেন যে হঠাৎ করে এইভাবে প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করে দিলে তাদের ছেলেমেয়েরা মারাত্মক অসুবিধায় পড়বে, তাহলে তারা আইনের দ্বারস্থ হতেই পারেন। যে ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরে সমাজ ও জন্মের পর থেকে ছেলেমেয়েরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, সেটা রাতারাতি বন্ধ করলে, কেউ যদি মনে করেন তাদের পড়াশোনায় ছেদ পড়তে পারে, তাহলে অভিযোগ জানাতেই পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, চিকিৎসকদের জন্যে মাষ্টার ডিগ্রি নিয়ে আদালত কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা বলে, সাময়িক ভাবে ম্যাডিকেল কলেজেগুলোকে তাদের নিজস্ব সাবেক ভর্তি প্রথা জারি রাখতে অনুমতি দিয়েছে। এখানেও এই ভাবে আবেদন জানানো যেতেই পারে, প্রাইভেট টিউশনি ধাপে ধাপে তোলার জন্যেআর ক্লাস নাইন থেকে কি করা দরকার জেনে নিতে পারেন যথাস্থান থেকেই।