“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২ জুন, ২০১৫

ব্ল্যাক হোল কোনও গর্ত নয়

।। রজতকান্তি দাস।।

মার এক বন্ধু আমাকে বলল যে সে একটি গল্প লিখছে। গল্পের বিষয় হলো সার্ন নামের সংস্থাটি যে সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে যে একটি ব্ল্যাক হোল তৈরি করে পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে। তবে এই বন্ধুকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। খোদ হলিউডের একটি সিনেমায় দেখেছিলাম যেখানে ব্ল্যাক হোলকে দেখানো হয়েছে মহাকাশে এক বিশাল গহ্বর যার মধ্য দিয়ে মহাকাশযান নিয়ে ঢুকে পড়েছেন একদল মহাকাশচারীরা। ব্ল্যাক হোল নিয়ে এ ধরণের আষাঢ়ে গল্পের বোধ হয় শেষ নেই। ইদানীং কালে ইন্টারস্টেলারনামের সিনেমাটি দর্শকদের মন কেড়েছে। তবে আমার মেয়ে সিনেমাটি দেখে এসে যা বলল তাতে সন্দেহ হয় এখানেও কি বিজ্ঞানকে নিয়ে এ ধরণের ছেলেখেলা হয়েছে। হলে হতেও পারে তবে আমি এই সিনেমাটি দেখিনি যখন তাই কিছু মন্তব্য করবো না। তবে ব্ল্যাক হোল নিয়ে উটপটাং কথাবার্তা এখানে ওখানে শুনি। তাই এ নিয়ে কিছু লিখতে প্রবৃত্ত হলাম।
            এই লেখাটি হয়ত অনেকেই পুরোটা পড়বেন না তাই শুরুতেই বলে রাখি যে ব্ল্যাক হোল হলো এক ধরণের গাণিতিক ধারণা মাত্র। এ যাবত ব্ল্যাক হোলের কোনও অস্তিত্ব আবিষ্কার হয় নি। তাই কোথাও ব্ল্যাক হোলের ছবিটবি দেখলে ধরে নেবেন যে ওটা কাল্পনিক ছবি।
          ব্ল্যাক হোল নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই।জন মাইকেল ও সাইমন লেপলাসের মতো দার্শনিকরা ব্ল্যাক হোলের চিন্তা করেছিলেন। ১৯১৬ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ারচাইল্ড প্রথম আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরির ভিত্তিতে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা বলেন। তবে মহাকাশে ব্ল্যাক থাকার সম্ভাবনা নিয়ে সু-পরিকল্পিতভাবে চিন্তাভাবনা শুরু হয় ষাটের দশক থেকেই যখন নিউট্রন নক্ষত্র আবিষ্কার হল। একই সঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখরের থিওরিও প্রতিষ্ঠা পেলো।
ব্ল্যাক হোল হল এক ধরণের মৃত নক্ষত্র। মৃত নক্ষত্র এই অর্থে যে এগুলোর পারমানবিক জ্বালানি ফুরিয়ে গিয়ে এখন নিষ্প্রভ। মহাকাশে নক্ষত্রের সংখ্যা হল একের পর ২৯টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায়, প্রায় তাই। তবে এটা অনুমানিক সংখ্যা। এর মধ্যে মৃত নক্ষত্রের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। এই মৃত নক্ষত্রগুলোর বেশির ভাগই হল হোয়াইট ডুয়ার্ফ বা শ্বেত বামন। তবে সংখ্যায় কম হলেও নিউট্রন নক্ষত্রও আছে প্রচুর পরিমাণে। এই নিউট্রন নক্ষত্রের ধারণা এক সময় বাতিল হয়ে গিয়েছিল পোলিস এক্সক্লুশন প্রিন্সিপলের জন্য। ১৯২৭ সালে এই ধারণাকে পুনরুদ্ধার করেন ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর। এর জন্য আমরা গর্বিত। তবে এখানে বিষয়টাকে একটু খোলসা করে না বললে কিছু বোঝা যাবে না। তাই পাঠকদের অনুরোধ এই প্রবন্ধটি একটু কষ্ট করে পড়ে ফেলুন। মনে হয় খারাপ লাগবে না।
            একটা জাজ্বল্যমান নক্ষত্রের যখন পারমানবিক জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যায় তখন স্বভাবতই সেটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। আমাদের সূর্যের একটা গুণ আছে যে সে তার জ্বালানি খরচ করে পরিমিতভাবে। তাই সূর্য তার সঞ্চিত জ্বালানি নিয়ে জ্বলতে পারে প্রায় এক হাজার কোটি বছর। অন্যদিকে সূর্যের চাইতে অনেক বড় মাপের নক্ষত্র আছে যেগুলো তিন-চারশ কোটি বছরেই তাদের জ্বালানি নিঃশেষ করে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। সূর্যের বর্তমান বয়েস প্রায় পাঁচশ কোটি বছর। আরও প্রায় এতটা বছর ধরে আকাশে এমনি করে জ্বলতে থাকবে। তবে জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাবার পর অন্যান্য নক্ষত্রের যে দশা হয়, সূর্যেরও একই দশা হবে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে লাল রঙ ধারণ করে আকারে বড় হতে থাকবে। এটাকে বলা হয় রেড জায়েন্টবা লোহিত দৈত্যসূর্যের যখন লোহিত দৈত্যের দশা হবে তখন সেটা আকারে এতটাই বড় হয়ে যাবে যে বুধ, শুক্র ও পৃথিবীর মতো কাছের গ্রহগুলো চলে যাবে সূর্যের পেটে। তবে ঐ সময় পৃথিবীতে কোন প্রাণ থাকবে না কারণ সূর্য যখন বড় হতে হতে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে পড়বে তখন পৃথিবীর সব জল শুকিয়ে যাবে। প্রবল উত্তাপ ও শুষ্ক এই পৃথিবী আর প্রাণ ধারণের উপযুক্ত থাকবে না।
          এই লোহিত দৈত্য নিজস্ব অভ্যন্তরীণ মাধ্যাকর্ষণের চাপে ক্রমশ সংকোচিত হতে থাকে। এই সংকোচনের ফলে তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও বাড়ে। কারণ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের ফর্মুলা অনুযায়ী বস্তুর ব্যাসার্ধের হ্রাস ঘটলে তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বাড়তে থাকে। তাই নক্ষত্রটির যতই সংকোচন ঘটে ততই আরো বেশি পরিমাণে মাধ্যাকর্ষণ বৃদ্ধির ফলে নক্ষত্রটি ক্রমাগত সংকোচিত হতে থাকে। আমরা জানি কোন জিনিসকে প্রসারিত করলে যেমন তাপমাত্রা কমতে থাকে, তেমনি সংকোচনের ফলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। যেমন সাইকেলের টায়ারে হাওয়া ভরার সময় বাতাসের সংকোচনের ফলে টায়ারটি গরম হয়ে যায়। তাই এই লোহিত দৈত্য নক্ষত্রটির ক্রমান্বয়ে সংকোচনের ফলে তাপমান যখন বাড়ে তখন এই উত্তাপের ফলে নক্ষত্রটি প্রসারিত হতে চায় কিন্তু নিজস্ব অভ্যন্তরীণ মাধ্যাকর্ষণের চাপে সংকোচন চাপও বাড়তে থাকে। তাই একটা সময় আসে যখন প্রসারণ চাপ বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরীণ মাধ্যাকর্ষণ চাপকে প্রতিহত করে নক্ষত্রটির বাইরের অংশ জ্বলন্ত অবস্থায় মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এটাকে বলা হয় সুপারনোভা। এই সুপারনোভা চলতে থাকে কয়েক মাস অব্ধি। এই সুপারনোভা দশায় নক্ষত্রটির বহির্ভাগ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই সময়ে নক্ষত্রটি যে আলো ছড়ায় তা শত শত সূর্যের সমান। তাছাড়া এই সুপারনোভার ফলে নক্ষত্রের সঞ্চিত উত্তাপও বেরিয়ে যায়। তাই যে অংশটি অবশিষ্ট থাকে তার সঞ্চিত তাপ বেশি থাকে না, তাই নক্ষত্রটির অভ্যন্তরীণ মাধ্যাকর্ষণের চাপে ক্রমাগত সংকোচনের পথে আর বাঁধা থাকে না। এখন প্রশ্ন হলো যে নক্ষত্রটি কি এরপর ক্রমান্বয়ে সংকোচিত হতে হতে এক সময় মহাকাশে মিলিয়ে যাবে।
               নক্ষত্রগুলোর ক্রমান্বয়ে সংকোচনের ফলে যে মাধ্যাকর্ষণ চাপ বাড়তে থাকে তাতে একসময় ইলেকট্রন অধঃপতন চাপ সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ যে চাপের ফলে ইলেকট্রনগুলো তাদের পরমাণু থেকে খসে যাবে। কিন্তু বাঁধ সাধল পোলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল। এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোন দুটো ইলেকট্রন একই সেটে থাকতে পারে না। তাই দেখা গেল যে এই এক্সক্লুশন প্রিন্সিপলই শেষ পর্যন্ত নক্ষত্রগুলোকে আরো অধিক সংকোচনের হাত থেকে রক্ষা করবে এবং এগুলো শেষ পর্যন্ত শ্বেত বামন হয়েই মহাকাশে থেকে যাবে। ১৯২৬ সালে এই তত্ত্বটি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী আর এইচ ফাউলার। এক সময়ে এই শ্বেত বামন নক্ষত্রগুলোই ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে সবচাইতে ঘনবস্তু। তা ফাউলারের এই তত্ত্বের ফাঁক বের করে দিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখরতিনি প্রমাণ করে দিলেন যে নক্ষত্রের ভর (mass) যদি ১.৪ সৌরভরের চাইতে বেশি হয় তাহলে নক্ষত্রটিতে যে মাধ্যাকর্ষণ চাপ সৃষ্টি হবে তার ফলে এর পরমাণুগুলোর মধ্য থেকে ইলেকট্রনগুলো খসে যাবে। পোলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল আর এগুলোকে ধরে রাখতে পারবে না। তবে নক্ষত্রটির ভর যদি ১.৪ সৌরভরের কম হয় তাহলে পোলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল অনুযায়ী নক্ষত্রটি আরো অধিক সংকোচনের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং শেষ পর্যন্ত শ্বেত বামন হয়েই থেকে যাবে। যেমন আমাদের সূর্যও একসময়ে শ্বেত বামন হয়েই থাকবে। মহাকাশে শ্বেত বামনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আমাদের এই ছায়াপথ নক্ষত্রপুঞ্জের প্রায় দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের মধ্যে প্রায় দশ শতাংশই শ্বেত বামন। তবে সূর্যের চাইতে ১০-১০০ গুণ বড় নক্ষত্রের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আর এই নক্ষত্রগুলোর পরমাণু জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাবার পর যদি সুপারনোভা হয়, তার পরও যে পরিমাণ বস্তু ঐ নক্ষত্রগুলোতে অবশিষ্ট থাকে তা সূর্যের চাইতে বহু গুণ বেশি। তাই এই নক্ষত্রগুলো শ্বেত বামন হয়ে যাবার পরও ক্রমাগত সংকোচিত হতে থাকে। আর যদি কোন মৃত নক্ষত্রের ভর সূর্যের চাইতে ৪.৫ গুণ বেশি হয় তাহলে এক সময় তা সংকোচিত হতে হতে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয়।
            একটি নক্ষত্র কতটা সংকোচিত হতে পারে তা আন্দাজ করা যায় তার পরমাণুগুলোর স্ট্রাকচার দেখে কারণ এই পরমাণুগুলোই হলো সমস্ত বস্তুর বিল্ডিং ব্লক। এই পরমাণু হলো ভীষণ রকম ফাঁকা। এর মাঝখানে সে নিউক্লিয়াস থাকে সেখানেই পরমাণুর সমস্ত ভর জমাট থাকে এবং এর চারদিকে ইলেকট্রনগুলো উপবৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে। তা এই পরমাণু কতটা ফাঁকা? মনে করা যাক একটি পরমাণুকে যদি আমরা কল্পনা করি একটি কনসার্ট হলের সমান যেখানে দশ-পনেরো হাজার মানুষ একসঙ্গে বসে সঙ্গীতের আনন্দ নিতে পারেন, তা হলে এই কনসার্ট হলের মাঝখানে যদি একটি সর্ষেদানা রাখা যায় তাহলে এই সর্ষেদানাটিকে আমরা বলতে পারি এর নিউক্লিয়াস। অর্থাৎ পরমাণু এতটাই ফাঁকা। তাই মাধ্যাকর্ষণের চাপে যখন কোন এক নক্ষত্রের পরমাণুগুলোর ইলেকট্রন খসে পড়ে যায় তখন নক্ষত্রটি হয়ে পড়ে অত্যন্ত ছোটবলা বাহুল্য এই সংকোচনের ফলে মাধ্যাকর্ষণও বেড়ে যায় ততোধিক হারে কারণ নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ নির্ভর করে তার বস্তুর পরিমাণ ও আয়তনের উপর। একই পরিমাণ বস্তু সমেত একটি বস্তুপিণ্ড যদি আয়তনে ছোট হয় তাহলে তার মাধ্যাকর্ষণ বেশি হবে।
               শ্বেত বামনের ঘনত্বই কোন বস্তুর ঘনত্বের শেষ পরিণতি, এই ধারণাই ছিল এক সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। একদল বিজ্ঞানী বললেন যে ইলেকট্রন সমুদ্রের মধ্যে যে নিউক্লিয়াসগুলো ভাসতে থাকে এর মধ্যে থাকে প্রোটন কণিকা যা পজিটিভ চার্জ সম্পন্ন, তাই পুরো একটি নিউক্লিয়াসও পজিটিভ চার্জ সম্পন্ন। একই ধরণের চার্জ যেহেতু একে ওপরকে বিকর্ষণ করে তাই এই নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পর সংলগ্ন না হয়ে নিজেদের মধ্যে কিছুটা জায়গা করে নেবে। এই মধ্যবর্তী পরিসর রক্ষা করার জন্যই শেষ পর্যন্ত নক্ষত্রগুলো শ্বেত বামন হয়েই থেকে যাবে। কিন্তু এই ধারণাও শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকল না। বিজ্ঞানীরা দেখলেন নক্ষত্রটির ভর যদি ২.৫ সৌরভরের চাইতে বেশি হয় তাহলে যে মাধ্যাকর্ষণ-চাপ সৃষ্টি হবে তার ফলে এর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াস-স্থিত প্রোটনের সঙ্গে মিলে গিয়ে নিউট্রন কণিকার সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ একসময়ে এই নক্ষত্রের মধ্যে শুধুমাত্র নিউট্রন কণিকাই থাকবে। এই নিউট্রন কণিকার মধ্যে যেহেতু কোন চার্জ নেই তাই মধ্যবর্তী পরিসরের দরকার হয় না এবং প্রবল মাধ্যাকর্ষণ-চাপের ফলে নক্ষত্রটি শূন্য আয়তন ও অসীম ঘনত্বের দিকে এগোতে থাকে। নক্ষত্রটিতে বস্তুর পরিমাণ যদি খুব বেশি হয় তাহলে এই অসীম ঘনত্বের দিকে এগোতে এগোতে কোন এক সময় নক্ষত্রটি ব্ল্যাক হোল হয়ে পড়ে।
             প্রশ্নটা হলো যে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর জিনিসটা কি? আর কি করেই বা কৃষ্ণ গহ্বর সৃষ্টি হয়? আমরা জানি যে কোন বস্তুকে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে তা আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসে। কিন্তু সবসময়ই যে ফিরে আসে তা কিন্তু নয়। প্রত্যেকটা গ্রহ কিংবা নক্ষত্রের একটি নিষ্ক্রমণ গতি বা escape velocity আছে যার চাইতে কম প্রাথমিক গতিতে কোন কিছুকে আকাশের দিকে ছুড়ে দিলে তা আবার গ্রহ কিংবা নক্ষত্রে ফিরে আসেকিন্তু এই নিষ্ক্রমণ গতির চাইতে বেশি প্রাথমিক গতিতে কোন কিছুকে আকাশের দিকে ছুড়ে দিলে তা মাধ্যাকর্ষণের মায়া অতিক্রম করে মহাকাশে পৌঁছে যায়। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই নিষ্ক্রমণ গতি হলো প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪০,০০০ কিঃমিঃএর চাইতে বেশি গতিতে কোন কিছুকে আকাশের দিকে ছুড়ে দিলে তা আর ফিরে আসবে না। এই escape velocity  প্রতিটি গ্রহ কিংবা নক্ষত্রের ক্ষেত্রে আলাদা। যেমন বৃহস্পতির ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় ২,২০,০০০ কিঃমিঃ। সূর্যের ক্ষেত্রে তা প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২২ লক্ষ কিঃমিঃ। এই escape velocity নির্ভর করে গ্রহ কিংবা নক্ষত্রটির মাধ্যাকর্ষণের ওপর। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ বেশি হলে এই নিষ্ক্রমণ গতিও বাড়বে। আমরা জানি যে সূর্যের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে পরমাণুর বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে। যার ফলে গনগনে উত্তপ্ত গ্যাসীয় পদার্থ সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু সূর্যের escape velocity বেশি হওয়ায় তা আবার সূর্যের মধ্যেই ফিরে যায়। যার ফলে সূর্যের চারদিকে এক ধরণের বলয় সৃষ্ট হয় যা পূর্ণ-গ্রহণের সময় দেখা যায়।  কিন্তু এই বিস্ফোরণের ফলে যে আলোকরশ্মি ও উত্তাপের বিকিরণ হয় তার গতি প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিঃমিঃ। অর্থাৎ সূর্যের নিষ্ক্রমণ গতির চাইতে অনেক বেশি। সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ এই বিকিরণকে ধরে রাখতে পারে না, তাই এই বিকিরণ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীতে থেকেও এই আলোক ও উত্তাপ আমরা পাই।
এই সূর্য যদি সংকোচিত হয়ে চারভাগের এক ভাগ ব্যাসার্ধের গোলকের মধ্যে চলে আসে তাহলে তার নিষ্ক্রমণ গতি বেড়ে হয়ে যাবে দ্বিগুণ। যদি একশ গুণ ছোট আয়তনের মধ্যে সংকোচিত করে ফেলা যায় তাহলে সূর্যের নিষ্ক্রমণ গতি বেড়ে হয়ে যাবে দশ গুণ। এভাবে খুব বৃহদাকার একটি নক্ষত্র যদি ক্রমাগত সংকোচিত হতে থাকে তাহলে তার নিষ্ক্রমণ গতি বাড়তে বাড়তে আলোর গতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। তখন এই নক্ষত্র থেকে এমন কি আলোকরশ্মিও বেরিয়ে আসতে পারবে না। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি যে আলোর গতিই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ সম্ভবপর গতিবেগ। কোনও কিছুরই গতি আলোকের চাইতে বেশি হতে পারবে না। তাই প্রবল মাধ্যাকর্ষণের মায়া কাটিয়ে কোন কিছুই এই নক্ষত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না, তা যে কোন ধরণের বস্তু কিংবা বিকিরণই হোক না কেন। এই অবস্থায় এই নক্ষত্রটিকে বলা হয় কৃষ্ণ গহ্বর কিংবা ব্ল্যাক হোল। ষাটের দশকে জন আর্চিবল্ড হুইলার এ ধরণের নক্ষত্রের এই নামটি দেন।

কোন মন্তব্য নেই: