“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০১৫

আউল ক্রীক সেতুর ঘটনা

(C)Image:ছবি

                                                                    
(    একদিকে আব্রাহাম লিংকন এর ইউনিয়ন আর অন্যদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলি নিয়ে জেফারসন ডেভিসের কনফেডারেসি  বা সাউথ । ১৮৬১ থেকে ১৮৮৫ র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে ইউনিয়ন জয়ী হয় ।সিভিল ওয়ার শেষে দাসপ্রথা সমাপ্ত হয় এবং অন্য অনেক গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যায় আমেরিকার উত্তরাংশ।  ইউনাইটেড স্টেটস এক শক্তপোক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয় । জয়ীপক্ষ ফেডারেল আর্মির সেকেন্ড লেফটেনেন্ট এমব্রোস বিয়ার্সের এই বিখ্যাত ছোটগল্প "An Occurrence at Owl Creek Bridge" বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ হয়ে আছে । একাত্তর বছর বয়সে তিনি উধাও হয়ে যান । কেউ কেউ বলে ঘাতক হাতে মৃত্যু হয় । তিনসুকিয়ার কাগজ 'উজানে'র আগামী শারদ সংখ্যাতে এই অনুবাদ প্রকাশিত হবে। ---- রণবীর পুরকায়স্থ )
                   ত্তর আলাবামার একটি রেল সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ, আনতদৃষ্টিতে কুড়িফুট নীচে খরস্রোতা জলরাশির দিকে সে তাকিয়ে রয়েছে । মানুষটির হাত দুটো তার পিছনে কব্জি দুটোতে দড়ি দিয়ে বাঁধা । একটি রশি তার গলায় শক্ত করে প্যাঁচানো । তার মাথার উপর একটি শক্তপোক্ত আড়কাঠের সঙ্গে বাঁধা দড়িটি ঝুলে রয়েছে তার হাঁটুর সমানে সমানে । রেলের ধাতব লাইন ধরে রাখার পাটাতনের উপর কিছু খুচরো তক্তা পেতে দেওয়া হয়েছে তার ও তার ঘাতকদের পা রাখার জন্য। ফেডারেল আর্মির দুজন সাধারণ সৈনিক মোতায়েন রয়েছে এক সার্জেন্টের আদেশে, যিনি হয়তো অসামরিক জীবনে কোন শহর বা মহকুমার উপশাসক ছিলেন । স্বল্প দূরে আর একটি অস্থায়ী পাটাতনের উপর তার পদবিসুলভ উর্দিপরা একজন সশস্ত্র অফিসার দাঁড়িয়ে আছে, সে ক্যাপ্টেন ।  সেতুর দুপারে দুজন প্রহরী তাদের বন্দুক তাক করা অবস্থায় দাঁড়ানো, বন্দুক  বাঁ কাঁধের উপর উলম্ব,   হাতটি বুকের উপর থেকে ঘোড়ার উপর রাখা । এক পোশাকি এবং অস্বাভাবিক  অবস্থান।তারা শরীরকে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে । দেখে মনে হচ্ছে না সেতুর মাঝখানে কী ঘটছে তা জানা তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, তারা শুধু তাদের তির্যক অবস্থানে তক্তার পাদানির দুদিককে অবরুদ্ধ করে রাখছে ।

    দূরের দিকে দুজনের মধ্যে একজন প্রহরী ছাড়া আর কাউকেই  দেখা যাচ্ছে না, রেলপথ  সোজা একশ গজ পর্যন্ত বনের দিকে গেছে, তারপর বাঁক ঘুরে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে । নিঃসন্দেহে দূরে আরো একটি চৌকি আছে । নদীর অপর প্রান্তে খোলা মাঠ।সামান্য খাঁড়াই ভূমিতে লম্বালম্বি গাছের  গুঁড়ির বেড়া দেওয়া, বন্দুকের নলের জন্য অনেক ফুটো করা। এর মধ্যে একটি বড় ছিদ্রের ভিতর দিয়ে  পিতলের কামানের মুখ বেরিয়ে আছে যা সেতুর নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করছে । সেতু আর দুর্গের মাঝখানের ঢালু জমিতে রয়েছে দর্শকেরা, এক কোম্পানি পদাতিক সৈন্য ‘বিশ্রাম’ অবস্থায় মোতায়েন রয়েছে । বন্দুকের কুঁদা মাটির দিকে।  নলগুলি ডানকাঁধের দিকে সামান্য হেলানো, হাতদুটো বাটের উপর আড়াআড়ি রাখা । লেফটেন্যান্ট পদাধিকারী একজন সারির ডানদিকে, তার তরোয়ালের তীক্ষ্ণ দিকটি ভূমিগত, আর তার বাম হাতটিও ডান হাতের উপর বিশ্রামে ন্যস্ত । সেতুর মাঝখানে চারজনের দলটি ছাড়া কেউই নড়ছে না । সেতুর দিকে তাকানো সেনা দলটির দৃষ্টিও পাথুরে, নিশ্চল । নদীটির দিকে মুখকরা প্রহরী দুজনও যেন সেতুর শোভাবর্ধনকারী ভাস্কর্য । ক্যাপ্টেন লোকটি দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ অধীনস্থদের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করেছে কিন্তু কোন নির্দেশ দিচ্ছে না । মৃত্যু এমনই এক মহান অতিথি যখন আসে তার আগমন-বার্তা যথাবিহিত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে সবাই , এমন কী যারা এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত তারাও । সামরিক রীতিকানুনের শিষ্টাচারে নিশ্চুপ আর নীরব থাকাই অমিলের রকমফের এখানে ।

   যাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য বেঁধে রাখা হয়েছে তার বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ বছর হবে । সে একজন অসামরিক ব্যক্তি, তার স্বভাবচরিত্র বিবেচনা করলে বুঝাই যায় সে এক তুলোর বাগান মালিক । তার চেহারার আদলও সুন্দর, খাড়া নাক, শক্তপোক্ত মুখমণ্ডল ও চওড়া কপাল । যেখান থেকে সোজা পিছনের দিকে চিরুনি করা দীর্ঘ কালো চুল তার কানের পিছনে মানানসই দীর্ঘ আলখাল্লার কলারের উপর গিয়ে পড়েছে । তার একটি গোঁফ এবং খোঁচাখোচা দাড়ি রয়েছে কিন্তু কোন জুলফি টুলফি নেই। তার চোখগুলি ডাগর ডাগর এবং ঘন কালো । মুখে  এমন দয়ালু ও  অনির্বচনীয়  অভিব্যক্তি, যে  ভাবাই যায় না তার কাঁধের উপর ফাঁসির দড়ি ঝুলছে । স্পষ্টতই এটা কোন সাধারণ হত্যা নয় । উদারনৈতিক সামরিক আইনে সমাজের অনেক ধরণের মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার ধারা রয়েছে এবং যেখানে ভদ্রলোকদেরও বাদ দেওয়া হয় নি ।

   সব প্রস্তুতি শেষ, দুজন সাধারণ সৈনিক একপাশে সরে যায় এবং তারা যার উপর দাঁড়িয়েছিল সেই কাঠের তক্তাও সরিয়ে নেয় । সার্জেন্ট ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় ও স্যালুট করে । এবং সেই  অফিসারের ঠিক পিছনে স্থান করে নেয়, ফলত সেও এককদম ঘুরে যায় । এসব স্থান পরিবর্তনের ফলে দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত মানুষ আর সার্জেন্ট একই তক্তার দুইপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে যা সেতুর তিনটি রেল ধরে রাখা আড়কাঠের ব্যবধানে স্থিত । অসামরিক লোকটি একেবারে শেষপ্রান্তে। কিন্তু পুরো নয়, চতুর্থ  পাটাতনের কাছাকাছি । এই কাঠের টুকরোটি ক্যাপ্টেন এর ওজন সঠিক ধরে রেখেছিল, সেটি এখন সার্জেন্টের কবলে । প্রথমজনের কাছ থেকে সংকেত পেলেই সে একপাশে সরে যাবে আড়কাঠের তক্তাও উল্টে যাবে এবং ফাঁসির আসামি লোকটিও দুই পাটাতনের মাঝখান দিয়ে নীচে পড়ে যাবে । অতি সরল এবং কার্যকরী তার এই বিচারের ব্যবস্থাপনা প্রশংসাযোগ্য তো বটেই । তার মুখ ঢাকা হয়নি এমনকি চোখেও কোন পট্টি বাঁধা হয় নি । সে এক মুহূর্তের জন্য তার নড়বড়ে পায়ের দিকে তাকায়, তারপর স্থিরদৃষ্টিতে বিস্ময়ে তার পায়ের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া উত্তাল জলরাশিকে দেখে । নৃত্যরত একটুকরো কুটো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবং তার চোখ কাঠের টুকরোটির  স্রোতে বয়ে যাওয়া দেখতে থাকে । মনে হয় যেন কী ধীরে বইছে  জল ! কী অলস জলধারাবাহী এই নদী !

     সে তার শেষ ভাবনাচিন্তাকে  স্ত্রী এবং সন্তানে কেন্দ্রীভূত করতে চোখ বন্ধ করে । এই জল প্রভাতী সূর্যের আলোয় সোনার বরণ । অদূরে কুয়াশাভাঙা ঢিবির নীচে নদীর পারের দূরবর্তী দুর্গ, সেনাদল, একটুকরো জলপ্রবাহ এসবই তাকে বিরক্ত এবং বিহ্বল করছে । এখন আবার সে আর  এক নতুন উৎপাতের মুখোমুখি হয় । প্রিয়জনদের চিন্তার মাঝখানে একটা শব্দ যা সে অবহেলা করতে পারে না , বুঝতেও পারে না কিসের ধ্বনি। তীক্ষ্ণ ধাতব ঘর্ষণজাত শব্দ যেন কামানের হাতুড়ি পড়ছে নেহাইর উপর। যার  ধ্বনি একই বশিষ্ট্যে বেজে যাচ্ছে বারবার । সে অবাক বিস্ময়ে ভাবে এটা কী।এটা কী অপরিমেয় দূরত্বের , না খুব কাছের। মনে হচ্ছে যেন দুটোই । নির্দিষ্ট গতিতে বাজছে কিন্তু এত ধীরলয়ে যেন কেউ মৃত্যুঘণ্টা বাজাচ্ছে । সে প্রতিটি ঘা এর জন্য অপেক্ষা করে অধৈর্যে । সে জানে কেন এ অপেক্ষা। কিসের আশঙ্কা । নীরবতার দূরত্ব দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে আর  এই দেরী তাকে পাগল করে তোলে । এই বিশাল বিরল ব্যবধানে শব্দের শক্তি ও তীক্ষ্ণতা যেন বেড়ে যাচ্ছে অনেকগুণ । তার কানের উপর ছুরিকাঘাতের মতো আঘাত করছে শব্দ। সে ভয় পাচ্ছে, সে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে । সে যা শুনছে তা  তার ঘড়ির স্পন্দন । 

      সে আবার তার বন্ধ চোখ মেলে নীচে বয়ে যাওয়া জলরাশি দেখে। আমি যদি আমার হাত দুটো খুলতে পারতাম, সে ভাবে। আমি এই দড়ি দড়া খুলে  নদীতে ঝাঁপ মেরে দিতাম । ঝাঁপ দিয়ে আমি বুলেটের হাত থেকে তো বাঁচতে পারতাম । আর প্রাণপণ সাঁতরে ওপারে পৌঁছে যেতাম । জঙ্গলের  ভিতর দিয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে যেতাম । আমার বাড়ি, ধন্যবাদ ভগবান, আমার পরিজনরা এখনও তাদের সেনাবাহিনীর হিসেবের বাইরে । আমার স্ত্রী এবং সন্তানরা এখনও আক্রমণকারীদের থেকে অনেক দূরে ।

      এইসব ভাবনাগুলি যখন এখানে শব্দরূপ পাচ্ছে, ফাঁসির আসামীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এবং তা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ক্যাপ্টেন সার্জেন্টের দিকে ইশারা করে । সার্জেন্ট একদিকে সরে যায় ।





(২)

       পেটন ফারকুহার একজন সচ্ছল তুলোর বাগানমালিক। বেশ  প্রাচীন এবং সুসম্মানের অধিকারী এক  আলাবামা পরিবারে তার জন্ম । নিজে দাসমালিক হওয়ায় অন্য দাসমালিকদের মতো সে একজন রাজনীতিবিদও বটে।  এবং স্বাভাবিকভাবে  একজন খাঁটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ।সে  আমেরিকার দক্ষিণাংশের  অধিকারের জন্য নিবেদিত প্রাণ ।এখানে বাহুল্য মনে হতে পারে তবু জানা  দরকার,  ওদের স্বেচ্ছাচারী চরিত্রগত অবস্থার জন্য সে সামরিক বাহিনীর চাকরি নিতে চায়নি । যদিও ওরা  শেষপর্যন্ত অসম যুদ্ধে পরাস্ত হয় করিন্থ হাতছাড়া হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে । সে অসম্মানজনক অক্ষমতায় রাগে, আর  রুদ্ধ ক্ষমতা প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে । সৈনিকের মহত  জীবন, স্বাতন্ত্র্য ও  সম্মানের জন্য অপেক্ষায় থাকে । সে জানত সুযোগ আসবেই এবং তা আসেও যুদ্ধকালীন সময়ে । ইতিমধ্যে সে তার পক্ষে করনীয় সব রকম কাজই করেছে । দক্ষিণের স্বাধীনতার জন্য কোন কাজই ছোট নয় জেনে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । কোন ঝুঁকিই এমন বিপদসংকুল নয় একজন অসামরিক ব্যক্তির কাছে যে মনের দিক থেকে  সৈনিকের মতো সঙ্গতিপূর্ণ এবং খুব বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন না হয়েও সম্মতি দেয়।  প্রেমে এবং যুদ্ধে সব কিছুই ঠিকঠাক এই মারাত্মক সরল প্রবাদবাক্য নির্ভর করে ।

      একদিন বিকেলে ফারকুহার এবং তার স্ত্রী বাগানবাড়ির  মুখে একটি মরচেধরা বেঞ্চে বসেছিল, এক ধূসর উর্দিপরা  ঘোড়সাওয়ার সৈনিক তাদের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে জল খেতে চাইল । শ্রীমতী ফারকুহার খুব খুশিমনে নিজহাতে তাকে জলপান করালো । যখন সে জল আনতে ভিতরে যায় তখন তার স্বামী সেই ধূসর ঘোড়সাওয়ারকে আগ্রহভাবে যুদ্ধের খবর জিজ্ঞেস করে ।

      “ইয়াঙ্কিরা রেলপথ মেরামত করছে” মানুষটি বলল, “এবং আরো অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে । তারা আউল ক্রীক সেতু পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সব ঠিক ঠাক করে উত্তরপারে একটা কাঠের দুর্গও  বানিয়ে নিয়েছে । ওখানকার সামরিক অধিকর্তা কিন্তু একটি অধ্যাদেশ জারি করে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে, আদেশে  বলা হয়েছে যে কোন অসামরিক ব্যক্তিকে যদি রেলপথ তার সেতু, সুড়ঙ্গ বা রেলগাড়িতে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কিংবা বাধার সৃষ্টি করতে দেখা যায় তবে তাকে কালবিলম্ব না করে বিনাবিচারে ফাঁসি দেওয়া হবে, আমি নিজে দেখেছি অধ্যাদেশ ।” 

      “আউল ক্রীক সেতু এখান থেকে কতদূর হবে ?” ফারকুহার প্রশ্ন করে,

       “প্রায় ত্রিশমাইল ।”

       “খাঁড়ির এদিকে কোন সেনা নেই ?” 

       “রেললাইনের পাশে আধমাইল দূরে একটা ফাঁড়ি চৌকি আছে । আর একটিমাত্র প্রহরী সেতুর শেষপ্রান্তে ।”

       “মনে করো একজন অসামরিক লোক কিম্বা  ফাঁসি যেতে চায় এমন খ্যাপা কেউ ফাঁড়িচৌকি ফাঁকি দিয়ে প্রহরীর অসতর্কতায় যদি  চলে যায় সংরক্ষিত অঞ্চলে ।” ফারকুহার হাসতে হাসতে বলে, 

       “তার কী হবে ?”

        সৈনিকটি তির্যকভাবে জবাব দেয় ‘মাসখানেক আগে আমি ওখানে ছিলাম ।’ সে বলে, “ আমি গত শীতের সময় দেখেছি ওখানে সেতুর খিলানে অনেক কাঠকুটোর পাহাড় জমে আছে । এখন ওগুলো জ্বলবে পাটখড়ির মতো ।”

        গৃহকর্ত্রী ইতিমধ্যে জল নিয়ে ফিরেছেন, যা সৈনিকটি পান করে । সে অতি ভদ্রভাবে তাকে ধন্যবাদ দেয়, তার স্বামীকেও শরীর নুইয়ে অভিবাদন জানায় এবং ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় । একঘণ্টা পর, রাত হওয়ার পর, সে আবার বাগানে সামনে দিয়ে ফিরে যায়। উত্তরের দিকেই সে যায়, যেদিক থেকে সে এসেছিল । সে ছিল একজন ফেডারেল গুপ্তচর । 



(৩)

  পেটন ফারকুহার যখন সেতু থেকে সোজা নীচের দিকে পড়ে যায় তখন তার চৈতন্য লোপ পায় এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষের মতো পড়ে থাকে । এরকম অবস্থা থেকে সে অনেক পরে জেগে ওঠার পর কণ্ঠে এক ব্যথার তীক্ষ্ণ চাপ অনুভব করে।  শেষে এক দমবন্ধ অবস্থায় প্রগাঢ় এবং  তীব্র ব্যথা তার কাঁধ ও গলা থেকে নামছিল তার শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেয়ে । ব্যথাগুলি তার শরীরের শাখাপ্রশাখায় ধুকপুকিয়ে শব্দ করে যাচ্ছে অকল্পনীয় দ্রুততায় ।মনে হচ্ছে যেন দ্রুত ধাবমান আগুনের স্রোত অসহ্য তাপমাত্রায় তাকে দহন করছে । আর তার মাথায়, তার চেতনায় কিছুই নেই ।কি এক জটপাকানো সম্পূর্ণতার ভার । এসব ব্যথার সঙ্গে তার  ভাবনা চিন্তার কোন ছাপ নেই । তার প্রকৃতিগত বুদ্ধিবৃত্তিও  ইতিমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।  তার এখন শুধু অনুভব করার শক্তি অবশিষ্ট রয়েছে যা এক পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা তার কাছে । সে শুধু অনুভব সচেতন । সে এক উজ্জ্বল মেঘের আলোয় ঘিরে আছে, যার মধ্যে আছে তার জ্বলন্ত হৃদয়, অবয়বহীন ও  অবাস্তব। সে অচিন্তনীয় ঘূর্ণাবর্তে পাক খেয়ে চলেছে বিশাল এক ঘড়ির দোলকের মতো । তখন সহসা এক সঙ্গে দুরন্ত তাৎক্ষণিকতায় বিশাল জলরাশির মতো শব্দ করে তার ভিতরকার আলো ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয় ।এক সন্ত্রস্ত গর্জন তার কানে বাজে আর চরাচর অন্ধকার ও  শীতল হয়ে যায় । তার চিন্তার শক্তি আবার ফিরে আসে ।সে বুঝতে পারে দড়ি ছিঁড়ে গেছে এবং সে নদীতে পড়ে  গেছে । অতিরিক্ত কোন দমবন্ধ অবস্থা নয়, ঘাড়ের উপর ফাঁস লাগানোর দড়িটা ইতিমধ্যেই তার শ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে এবং ফুসফুস থেকেও জল বেরিয়ে গেছে । নদীর মাঝখানে ফাঁসিতে মৃত্যু।  তার কাছে বিষয়টা খুব হাস্যকর মনে হয় । সে চোখ খোলে অন্ধকারে আর দেখে তার উপর একটুকরো মৃদু আলোর রশ্মি। কিন্তু অনেক  দূরের, অগম্য অপ্রবেশ্য। সে ডুবেই যাচ্ছে , কারণ আলো অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা বিন্দুতে পর্যবসিত হচ্ছে । তারপর আবার বাড়তে থাকে এবং উজ্জ্বলতর হয় এবং সে বুঝতে পারে সে জাগছে, জলের উপরে উঠছে, বিরক্তি  সহকারেই সে বুঝতে পারে কারণ সেতো বেশ স্বস্তিজনক অবস্থায়ই আছে এখন । “ফাঁসি দেওয়া এবং জলে ডুবানো” সে ভাবে   “ব্যাপারটা খুব খারাপ নয় । কিন্তু আমি  কিছুতেই গুলি খেয়ে মরতে চাই না ।  না গুলির আঘাতে নয় ; ওটা ন্যায়সঙ্গত নয় ।”

          খুব ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা নয়, কিন্তু তার হাতের একটা তীব্র ব্যথা জানান দেয় সে তার হাত মুক্ত করতে চাইছে । সে তার লড়াই এ মনোনিবেশ করে, যেমন একজন অলস মানুষ জাদুকরের কসরত দেখে অবাক হয় , কী ঘটবে তার প্রত্যাশা ছাড়াই । কী দারুণ প্রচেষ্টা ! কী দুর্দান্ত, কী অমানুষিক শক্তি ! আহ কী দারুণ নৈপুণ্য ! সাবাস, বেশ তো!  রশারশি খুলে যায়, তার হাত দুটো আলাদা হয় এবং উপরের দিকে ভেসে ওঠে, হাতগুলো টিমটিমে আলোর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয় । সে নবীন উৎসাহে দেখে একটাকে,  তারপর অন্যটা দিয়ে কাঁধের উপর থেকে দড়িটা সরিয়ে দেয়।  তারপর ওটাকে ছিঁড়ে সজোরে একদিকে সরিয়ে দেয় । চাঁদের আলো জলের উপর প্রতিবিম্বিত হওয়ায় মনে হয় জলসর্প হেলেদুলে যাচ্ছে । “ওগুলো যেমন আছে রেখে দাও,  ওগুলো যেমন আছে রেখে দাও’ সে ভাবে এই কথাগুলি যেন কেউ তার হাতদুটোকে বলছে । কারণ দড়ির বাঁধন খুলার পর সে অমানুষিক ব্যথায় কাতর হয়েছে যা সে এর আগে কখনো  অনুভব করে নি । তার ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা, মস্তিষ্কে আগুন।  তার হৃদয় যেটা খুব দুর্বল ভাবে দপদপ করছে সেও একটা মস্ত বড় লাফ দিয়ে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে । তার সমস্ত শরীরের হাড় মজ্জা নড়বড়ে হয়ে গেছে, পেশিগুলি ছিঁড়ে যাচ্ছে সহানুভূতিহীন ব্যথায় । কিন্তু তার অবাধ্য হাতগুলি তার আদেশের কোন মূল্য দেয়  না । তারা জলের উপর নিম্নমুখী সাঁতার কাটতে থাকে যাতে সে উপরে ভেসে উঠতে পারে । সে অনুভব করে তার মাথা উঠে আসছে, তার চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সূর্যরশ্মিতে, তার বুক ফুলে উঠছে প্রশ্বাসের দুলুনিতে। এবং শ্রেষ্ঠ ও  চূড়ান্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে তার ফুসফুসে ভরে যায় অনেক শুকনো বাতাস। সে যা সঙ্গে সঙ্গে বের করে দেয় এক তীক্ষ্ণ চীৎকারে । 

         সে এখন তার ইন্দ্রিয়ের সম্পূর্ণ অধিকারে । তারা অবশ্যই অতিপ্রাকৃত ভাবে শান্ত এবং সচকিত । কিছু কিছু বিষয় তাকে এত বিরক্ত করছে যে তার জৈবিক প্রণালী দুম করে অতি তীক্ষ্ণধি এবং পরিশুদ্ধ হয়ে গেছে ।  তারা সব কিছু দেখতে পারছে শুনতে পারছে নিরবচ্ছিন্ন ,যা  তারা এর আগে  পারে নি । সে বুঝতে পারছে যে জলের ফোঁটা তার মুখের উপর পড়ছে এবং যখন পড়ছে তখন প্রতিটি ফোঁটার আলাদা শব্দ সে শুনতে পারছে । সে নদীর ওপারে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। দেখেছে প্রতিটি গাছপালা , তাদের উপর প্রত্যেকটি পোকা মাকড়, ঘাসফড়িং,  সুন্দর দেখতে সব মাছি, ধূসর মাকড়সার জাল এডাল থেকে ওডালে বিস্তৃত । সে প্রতিটি ঘাসপাতার উপর পড়া স্বচ্ছ শিশিরবিন্দুগুলি পর্যন্ত দেখতে পারছে । ঘূর্ণিজলের উপর নাচতে থাকা ডাঁশমশার ডানা ঝাপটানো, জলমাকড়সার লম্বা লম্বা পায়ের ঝাঁপ, দাঁড়টানার মতো শব্দ করে নৌকো বাইছে যেন।সব মিলিয়ে এক সঙ্গীতের মূর্ছনা ।  একটি মাছ তার চোখের নীচ দিয়ে চলে গেল এবং সে শুনল জল আলাদা করে তার শরীরী চলে যাওয়ার শব্দ ।

       সে নদী থেকে উপরে উঠে এলো, এক মুহূর্তে দৃশ্যমান দুনিয়া মনে হল যেন ঘুরছে একটা ছোট্ট পাকে, সে নিজে তার প্রধান কেন্দ্রে । এবং সে দেখে এক সেতু, দুর্গ । সেতুর উপর সৈনিকরা , ক্যাপ্টেন সার্জেন্ট ও দুজন সাধারণ প্রহরী , তার ঘাতক দল ।  তারা নীল আকাশের গায়ে ছায়া ছায়া হয়ে আছে । তারা চিৎকার করছে তার দিকে তাকিয়ে । ক্যাপ্টেন তার পিস্তল বের করছে, কিন্তু চালাচ্ছে না, অন্যরা অস্ত্রহীন । তাদের চলাচল অস্পষ্ট এবং বীভৎস, তাদের দেখতেও লাগছে বিশাল ।

      হঠাৎ সে একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পায় এবং কিছু একটা ছরাত শব্দে জল ভেদ করে যায় তার মাথার কয়েক ইঞ্চির মধ্যে । তার মুখের উপর ঝাঁঝারির জলের মতো ছড়িয়ে যায় । সে আবার দ্বিতীয় গুলির শব্দ শুনে এবং দেখে একটি প্রহরী তার কাঁধে বন্দুক নিয়ে ঘুরছে । তার নল থেকে নীল রঙের ধোঁয়া বেরোচ্ছে । জলের মধ্যে থাকা মানুষটি দেখে সেতুর উপরে লোকটার চোখ ঘুরছে , তার বন্দুকের আওতার ভিতর যা আছে সব দেখছে । সে দেখল লোকটার চোখ পাঁশুটে এবং তার মনে পড়ে সে কোথাও পড়েছে পিংলা চোখের মানুষের নিশানা পাকা হয় এবং সব বিখ্যাত লক্ষ্যভেদীরাই ওরকম । সে যাই হোক এটা তো ব্যর্থ হল ।

    একটা উল্টো স্রোত ফারকুহারকে অর্ধেক ঘুরিয়ে দেয়, সে আবার দুর্গের অপর পারে জঙ্গলের দিকে তাকায় । একটা স্পষ্ট উচ্চস্বর একঘেয়ে গানের মতো বেজে ওঠে তার পিছনে জল ভেদ করে ।  অন্যসব অস্পষ্ট শব্দ ভেদ করে এমনকি বুদবুদের শব্দ যা ক্রমাগত তার কানে বাজছে সব কিছু ছাপিয়ে যাচ্ছে । যদিও সে কোন সৈনিক নয়, সে অনেকবার এরকম শিবির দেখে জেনেছে ঐ শব্দের উৎস, সুচিন্তিত নীরস শব্দভেদী মন্ত্রের মতো গমগমে শব্দের অর্থ । পারে দাঁড়ানো লেফটেনেন্ট তার প্রভাতী কাজকর্মে মগ্ন । কী শীতলতায় এবং নির্মমভাবে স্পষ্ট শান্ত স্বরক্ষেপে সময়কে শাসন করে সতর্কতা জারি করে মানুষটি নিজের ভিতর শান্তি উপলব্ধি করে। কী নিখুঁত মাপা বিরাম নিয়ে গড়িয়ে পড়েছে সেইসব নিষ্ঠুর শব্দগুলি,

     “সাবধান কোম্পানি!  কাঁধে বন্দুক তুলে নাও ! প্রস্তুত হও ! তাক করো ।  গুলি করো” !

   ফারকুহার ডুব দেয়। যত গভীরে পারে সে ডুব দেয় । নায়াগ্রার মতো জল তার কানে গর্জন করে ওঠে । সে শুনতে পায় স্তিমিত বর্জনির্ঘোষের মতো গোলাগুলির শব্দ, আবার সে ভেসে ওঠে, উজ্জ্বল ধাতব আলোকরশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়।  এক এক করে পড়ছে, ধীরলয়ে দুলে দুলে যাচ্ছে নীচের দিকে । কোনো কোনটি  তার মুখ কিংবা হাত স্পর্শ করছে, তারপর গড়িয়ে পড়ছে তাদের অবতরণের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে । একটা তার গলবন্ধনীতে, একটা কাঁধে নামে । এটা একটু অস্বস্তিকর তপ্ত এবং সে সেটা টেনে বের করে ।

   সে যখনই পারের দিকে ওঠে শ্বাস নেওয়ার আশায়, দেখে সে অনেকক্ষণই জলের নীচে রয়েছে, প্রত্যক্ষ কল্পনায় সে ভাটির টানে বেশ দূরে গিয়ে সুরক্ষিত আছে । সৈনিকেরা বন্দুকে গুলিভরা প্রায় শেষ করে এনেছে, সবকটা ধাতব নল পরিষ্কার করার ডাণ্ডাগুলি সূর্যালোকে ঝলসে ওঠে যেহেতু তারা বন্দুকের নল থেকে বের করে আকাশের দিকে ঘুরায় এবং আবার তার নির্দিষ্ট স্থানে ঢুকিয়ে রাখে । দুজন প্রহরী আবার গুলি ছোড়ে স্বাধীনভাবে এবং অকার্যকর ভাবে ।

        

           অপহত মানুষটি সব দেখে তার কাঁধের ওপর থেকে ।  সে এখন স্রোতের পক্ষে প্রাণপণ সাঁতরে চলেছে । তার মস্তিষ্কও তার হাত এবং পায়ের মতো তেজীয়ান ।  সে এখনও ভাবতেও পারছে বিদ্যুৎগতিতে ।

‘অফিসারটি’ সে যুক্তি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ‘এত তৎপর গোলন্দাজ দ্বিতীয় বার আর এই ভুল করবে না । একটি গুলিকে একবার এড়িয়ে যাওয়া সহজ । সে নিশ্চয় ইতিমধ্যে  যে যেমন পারে গুলি করার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে । ভগবান সহায় হও, আমি সবগুলি এড়িয়ে যেতে পারব না ।”

      তার দু’গজের ব্যবধানে একটি ভীতিপ্রদ জলের ছিটের সঙ্গে উচ্চকিত তেড়ে আসা শব্দ ক্রমশ  হ্রাস পায়, যা তার মনে হয় দুর্গ থেকে বেরিয়ে বাতাসে ভ্রমণ করে নদীর জলের গভীরে একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে । একটি জলের তরঙ্গ চাদরের মতো উড়ে এসে তাকে আচ্ছাদিত করে দেয়। অন্ধ করে দেয়, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে । তার মানে এই খেলায় কামানও ব্যবহৃত হচ্ছে । সে যখন তার মাথা এই তুমুল আলোড়ন থেকে মুক্ত করে, সে শুনতে পায় গতিভ্রষ্ট গুলি চলে গেছে বাতাস ভেদ করে অনেক দূরে এবং তা ঐ দূরের জঙ্গলের গাছপালা ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিয়েছে ।

    “তারা একাজ আবার করবে না ।” সে ভাবে “ পরের বার তারা ছররা দিয়ে গুলি করবে । আমাকে তাদের বন্দুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে । ধোঁয়াই আমাকে জানান দেবে। গুলি আসবে অনেক দেরি করে, এ গোলাগুলির পিছন পিছন ছোটে । এটি একটি ভাল বন্দুক বটে ।”

   হঠাৎ তার মনে হয় সে ঘুরছে আর ঘুরছে, লাট্টুর মতো পাক খাচ্ছে । এই জল, নদীর পার, জঙ্গল  এখন অনেক দূরের। সেতু দুর্গ এবং মানুষগুলিও সব অস্পষ্ট এবং একাকার । বস্তুগুলিকে শুধু তার রং দিয়ে চেনা যাচ্ছে । বৃত্তাকার কিংবা লম্বাকৃতি কিছু ইতস্তত রং এসবই সে দেখছে । সে একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে আছে এবং ঘুরছে একই তীব্রতায় একই জায়গায়। এরকম অস্বস্তিকর অবস্থায় থেকে সে অসুস্থ বোধ করছে । কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে উড়ে গিয়ে পড়ে পাথরের উপর, নদীর বাঁদিকে । দক্ষিণপারের একটা শুকনো জায়গা যেখান থেকে তার শত্রুরা তাকে দেখতে পাবে না । হঠাৎ এই গতি, তার এক হাত পাথরে ঘষে যাওয়ায় সে থামে, আনন্দে কেঁদেই ফেলে । সে তার আঙুল দিয়ে বালি খুঁড়ে এবং মুঠো করে তারই উপর ছুঁড়ে দেয় যাতে একটা অন্তত শব্দ বর্ষিত হয় । এ গুলোকে দেখতে হিরে চুনি পান্নার মতো লাগছে। সে ভাবে আর কী কী আছে সুন্দর যার মতো লাগছে এগুলি । পারের গাছগুলিও তার বাগানের মতো বিশাল, সে ওগুলোর সারিবদ্ধ ভাবে সেজে থাকার একটা বিশেষত্বও লক্ষ করে ।ওদের ফুলের গন্ধও শোঁকে । একটা আশ্চর্য গোলাপি আভা তাদের ডালপালার ভিতর দিয়ে ইওলিয়ার বীণা থেকে নির্গত সঙ্গীতের মতো বাতাসের দোলায় তাদের ডালপালা থেকে নির্গত হচ্ছে । তার পলায়নকে নিখুঁত করার কোন সদিচ্ছাই এখন তার নেই। সে নিশ্চিন্তে এখানে এই অপার্থিব পরিবেশে শুয়ে থাকতে চায় যতক্ষণ না তাকে কেউ সরিয়ে নিচ্ছে ।

       একটা শাঁ শা এবং ঝনঝনানো ছররার শব্দ তার মাথা থেকে অনেক উপর গাছের ডালের উপর দিয়ে চলে যাওয়ায় তার স্বপ্ন ভেঙে যায় । বিভ্রান্ত কামানদার  তার দিকে ক্রমাগত গোলা ছুড়ে যেন তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে । সে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায়।  দৌড়ে যায় ঢালু পারে এবং ঝাঁপ দেয় জঙ্গলের ভিতর ।

        সারাটা দিন  সে ঘুরে বেড়ায়। মাথার উপর সূর্য গোল হয়, তবু সে দৌড়য় । জঙ্গলের কোনো  শেষ নেই। কোথাও সে থামার পথ পায় না, একটা কাঠুরের বুনো পথ পর্যন্ত নেই । সে জানতই না যে এরকম একটা বনাঞ্চলে সে বাস করত । একটা অস্বাভাবিক অবাস্তব কিছু সে অনুভব করে ।

        রাতের দিকে সে ক্লান্ত, ক্ষতপদ এবং ক্ষুধায় মুমূর্ষু হয়ে পড়ে । স্ত্রীও ছেলেমেয়ের কথা ভাবে । শেষ পর্যন্ত সে একটা পথ খুঁজে পায় যা তাকে সঠিক দিশা বাৎলে দেয় । এটা শহুরে পথের মতো বড় এবং সোজা । তাও  মনে হয় এখানে কেউ  হাঁটে না, কোনোদিন হাঁটেনি । খুব বেশি না হলেও কুকুরের ডাকে বুঝা যাচ্ছে মনুষ্যবসতি আছে কাছাকাছি । গাছের কালো গুঁড়িগুলি রাস্তার পাশে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুদিকে, যেন দিগন্তে গিয়ে শেষ হয়েছে এক বিন্দুতে। যেন চিত্রানুপাতিক দৃশ্যের অঙ্কন শেখানো হচ্ছে । যখন সে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মাথার উপর আকাশ দেখে, তারাগুলিকে বড় অপরিচিত লাগে, এবং এক আশ্চর্য তারকাপুঞ্জেও বিভক্ত মনে হয় । সে নিশ্চিত ওদের ওরকম জড়ো হওয়ার কোন গোপন এবং অশুভ অভিসন্ধি আছে । জঙ্গলের দুদিকে সে শুনতে পায় একই কোলাহল, যার মধ্যে একবার দুবার এবং বারবার সে স্পষ্টভাবে শুনতে পায় এক অপরিচিত কণ্ঠের ফিসফিসানি ।

     তার কাঁধে ভীষণ ব্যথা । সে হাত উঠিয়ে অনুভব করতে গিয়ে টের পায় মারাত্মক ভাবে ফুলে গেছে । সে জানে ওখানে একটা গোল কালো দাগ আছে যেখানে দড়িটা বাঁধা ছিল । তার চোখ ঝাপসা হয়ে আছে । কিছুতেই বন্ধ করতে পারছে না । জিহ্বা তেষ্টায় ফুলে গেছে। উত্তেজনা কমাতে সে দাঁতের পাটির মাঝখান দিয়ে বের করে ঠাণ্ডা বাতাসে কিছুক্ষণ মেলে দেয় জিভ । কী মোলায়েম ভাবে ঘাসগুলি গালিচার মতো কুমারী পথের উপর বিছানো রয়েছে । সে আর পথের কোন অনুভব পাচ্ছে না পায়ের নীচে ।

     নিশ্চিতভাবে তার এত কষ্টের মধ্যেও সে ঘুমিয়ে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে, কারণ সে এখন অন্য দৃশ্যে চলে গেছে। বোধহয় সে এক বিকারের ঘোর থেকে সদ্য উঠে এসেছে । সে তার বাড়ির দোর গোঁড়ায়  দাঁড়িয়ে আছে । সে যেমন ছেড়ে গেছিল তেমনই তো আছে , সবই সুন্দর এবং উজ্জ্বল হয়ে আছে প্রভাতী সূর্যালোকে । সে তো সারারাত পথ হেঁটেছে । সে যখন ধাক্কা দিয়ে গেট খুলে প্রশস্ত সাদা রাস্তা  দিয়ে ঢুকছে, সে দেখে নারীর কাপড় বাতাসে উড়ছে, তার স্ত্রীকে দেখতে বেশ শান্ত ও মিষ্টি লাগছে । বারান্দা থেকে হাসিমুখে নেমে আসছে তাকে দেখতে । সিঁড়ির নীচে সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে এক অনির্বচনীয় আনন্দে।  কি অপরূপ তার  সৌন্দর্য আর  গাম্ভীর্য । আহ ! সে কী সুন্দর ! সে উৎসাহে আনন্দে এগিয়ে যায়, হাত বাড়িয়ে দেয় । সে যখনই তাকে অনুভব করতে যায় এক বিরাট ধাক্কা তার ঘাড়ের পিছনে । অন্ধ করা এক সাদা আলো জ্বলে ওঠে, যার শব্দ কামানের গোলার মতো। তারপর সব অন্ধকার ও নিস্তব্ধ ।

    পেটন ফারকুহার মৃত। তার দেহ, ভাঙা কাঁধ নিয়ে মৃদু দুলেছে এদিক থেকে ওদিকে আউল ক্রীক সেতুর নীচে কাঠের গুঁড়ির তলায় ।

    







কোন মন্তব্য নেই: