“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫

এক যে ছিল দেশ




(দেবাশিস তরফদার আমাদের এক প্রধান কবি এবং কথাশিল্পী। নিন্দে প্রশংসাতে অবিচলিত এক নীরব নিষ্ঠাবান লেখক তিনি।এর  জন্যেই হয়তো এই সময়ের  বহু পাঠক এমন কি লেখকও তাঁকে চেনেন কম।   ছন্দে , ভাষায়, বিষয়ে তাঁর তাঁর মতো বৈচিত্র অতি কম লেখকে নজর পড়বে। বাংলা সাহিত্যের পূর্বোত্তরীয়   "ভাবান্দোলনে'র তিনি এক অন্যতম প্রবক্তা  বললেও ভুল হবে না। তাঁর এই কবিতাটি আছে ২০০০ সনের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তাঁর বই "মূর্তিকর'-এর শেষে । "বারোমাস্যা' প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলা বিশেষ করে সিলেট কাছাড়ের একটি জনপ্রিয় সাহিত্য পরম্পরা। তিনি সেই পরম্পরারই উত্তরাধিকার স্বীকার করে নিয়ে "পাঁচালি'র ভাষা যেমন হয় , অনেকটাই "গুরুচণ্ডালি' অত্যন্ত সচেতন ভাষাতে একটি বারোমাস্যাই এখানে লিখেছেন। নবীন কবিদের দেবাশিস তরফদার না পড়া থাকলে এক বিশাল ক্ষতি বলেই আমার মনে হয়। তাই ভালো লাগা, ব্যতিক্রমী এই কবিতাটি এখানে তুলে দিলাম।--সুশান্ত কর )


(C)Image:ছবি

















বৈশাখ গো নবীন আম,          কাঁচা কোমল বীচি
তাঁতীপাড়ার গুণ্ডী সীমা          লুটিয়া  নিয়া যায়
না রহিল একটি আম            শূন্য গাছতলায়

হঠাৎ সেদিন বৈকালবেলা,       আইল ঝড় , ভাঙল খেলা
বেণুমাসী ব্যাকুল হৈল ,          হাঁসগুলি কোথায়
‘আ চৈ চৈ , আ তৈ তৈ           ঘরে ফিরিয়া আয়’

ভাঙল ডাল, গাছের মুণ্ড,         দাদুর বাগান লণ্ডভণ্ড
শীতল জল, বরফ শিল          ছাতে ঝরঝরায়
কাঁচা আম বাটিয়া তারা            ভর্তা করি খায়

বৈশাখে গো রাতে ঘাম,          খড়খড়াইল পাছার চাম
রিয়াসৎ আলি কঞ্চি কাটে,       বাঁশবেড়া বানায়
নব কামলা নারিকল কাটে       জলপিপাসা পায়

বেলা হ’ল আসল রেল,         মাথায় জবাকুসুম তেল
নাভিতে দিয়া সর্ষ তেল,       পুষ্করিণী যায়
ভস করিয়া ভাসিয়া উঠে,      আবার ডুব লাগায়

তেলের কড়াই উনান-চড়া,      রান্ধ মৌসী শাকের বড়া
মকা মাছের টক করিও,         মৌসা স্নানে যায়
টকটকাইছে পেণ্ডুলাম           দেড়টা বেজে যায়

পাখীর মা গো পাখীর মা,     অধিক লবণ দিও না
শুঁটকি মাছে মিষ্টি লাউ,       হাত লেহিয়া খায়
শীতলভাতে জল ঢালিয়া    লেবুর গন্ধে জুড়ায়

বাজে দুপুর তিনটা বেলা,     হাতে বীচন , জানালা খোলা
জবা গাছের টকটকে রোদ    চক্ষু যেন ধাঁধায়
অনুরোধের গান শুনিয়ে     রেডিও বেজে যায়

তালের পাতার বীচনিখানি ,   দিদিমার হাত ঘুমপাড়ানী
ছাদের ঘরে জালাল পায়রা    বেজান বকবকায়
লেপা মাটি শীতল পাটী        পাখীর মা ঘুমায়

হ’ল বিকাল চারটা বেলা,       হকিস্টিক , কবাডি খেলা
পেয়ারাগাছে জুড়াল রৌদ্র ,    বেণী দুলিয়ে যায়
এলাটিং বেলাটিং রাজামশাই   একটি বালিকা চায়

কখন হ’ল সন্ধ্যাবাতি      শঙ্খ কর্তাল ধূপ আরতি
রীনামাসী ঝর্ণামাসী        উঠানে চট পাতায়
কত গল্প ফুরাইল না      তারা ঝিকমিকায়

বৈশাখে গো নবীন আম ,    কাকে নষ্ট করে
আর আছে মহা চোরনী      তাঁতীপাড়ার সীমা
বাকী আম হঠাৎ ঝড়ে       ছেৎরে গাছতলায়














জ্যৈষ্ঠমাসে শুকাল ঘাস       খালে জল কোথায়
তাতে আবার মহিষগুলি      পেট ডুবিয়ে থাকে
গরম লালা ঝরছে দেখ’      কালো মহিষের নাকে
গাছে গাছে সিন্দূরী আম,     কালো ভ্রমর এক থোকা জাম
ভুতিমাসীর কালো ছেলেরা    আমকাঁঠালের শাখে
জামের রসে গাছের তল      বেগুনী হয়ে থাকে

ভূতিমাসীর ছোট ছেলে,      অনবরত খালে বিলে
বাদলমামার তিনকোণী জাল  ,   তাই দিয়ে খাল ছাঁকে
ছোট ছোট রূপালী পুঁঠি         ধরা পড়েছে ঝাঁকে

জ্যৈষ্ঠমাসে কর্ম নাই,              খাই দাই , পাড়া বেড়াই
জামের ডালে বোলতার বাসা,     ঢিল দিও না চাকে
কাঁসার বাটি , দাদুর জাম,       লবণ দিয়ে মাখে

আমার বড় খাই খাই,         খাওয়ার কথায় লজ্জা নাই
ডুমো ডুমো ভীমরুল মাছি    কোথায় গোপন থাকে
ল্যাংড়া আম কাটতে মাত্র     ভনভনাইছে ঝাঁকে

ভুতিমাসীর বড় ছেলে          হাত চুবিয়ে সর্ষ তেলে
পেট ফাড়িয়া কাঁঠাল ভাঙে ,   কোয়া খুলিয়া রাখে
বাকী রইল কাঁঠালবীচি,        লাগবে কচুশাকে

জ্যৈষ্ঠমাসে বুক শুকায়    ,    নব কামলা গামছা ভিজায়
ল্যাংটা ছেলে ঝাঁপায় বৃথা      পুষ্করিণীর পাঁকে
শ্যাওলাজলে সারাটা দিন      গা ডুবিয়ে থাকে

ষষ্ঠীপূজা , ব্যস্ত মা,           চ্যাঙের ছা, ব্যাঙের ছা
ময়দা দিয়ে গ’ড়ে রাখে    ঠাকুর ঘরের তাকে
ধানদূর্বা , প্রদীপ চন্দন ,     প্রণাম কর মা-কে

বর্ষা নাই গো বর্ষা নাই,          ঝর্ণামাসীর নিদ্রা নাই
তাতে আবার ভরদুপুরে        ভূতিমাসীর ডাকে
বুক কেঁপে যায়, মাসীর ছেলে    ডুবে রয়েছে পাঁকে

জৈষ্ঠমাসে প্রাণ শুকাল,     নদীতে নাই জল
কালো কালো ষণ্ডা মহিষ     কাতর হয়ে আছে
সারাদুপুর খালের জলে     পেট ডুবিয়ে থাকে


(C)Image:ছবি












হঠাৎ সেদিন খেলার শেষে    পশ্চিম আকাশ  কালো
‘গরু  ফিরাও গরু ফিরাও’    বেণুমাসীর শঙ্কা
বালিকার দল উড়ন্ত কেশ     ঊর্ধশ্বাসে পালায়

আষাঢ় মাসে শান্ত মন,     ঘরে থাকে আপনজন
টিনের চালে মধুঝরণ,     চোখ বুজিয়া আসে
জল জমেছে জবাতলায়    জল জমেছে ঘাসে

দেখতে দেখতে সারা আকাশ     অমাবস্যা! কী সর্বনাশ
পুকুরপাড়ে কলার পাতা          লুটিয়া পড়ে ত্রাসে
ঘনকালো মেঘের ফেনা         আকাশে অট্টহাসে

ক্রমে ক্রমে দৃষ্টি অন্ধ ,          দোকান বন্ধ, রেশন বন্ধ
নাণ্টুমামা ছাতাবিহীন            দৌড়তে দৌড়তে আসে
মিলুর বাবা কোথায় গেছেন    এমন ঝড়বাতাসে

জানালা দিয়ে দেখি আষাঢ়      স্নান করেছে পাতাবাহার
বৃষ্টিভিজা জবার আলোয়        উঠানখানি হাসে
রূপসী হ’ল লতাপাতা,          নবীন আষাঢ় মাসে

সময় জানালা বন্ধ করার,     তবু ফুটা ভেণ্টিলেটার
ছিটা ছিটা বৃষ্টির জল          ঘরের ভিতর আসে
টিনের ছাদে গড় গড় গড়     জল পড়ে উল্লাসে

রূপসী হ’ল বালিকাগুলি       দিল চুলের বেণীখুলি
গীতামাসী গান ধরিল           ‘অন্তর উদাসে’
‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না মন’   বৃষ্টি বেড়ে আসে

পরের দিন যে সকাল বেলা      উঠানে জল নৌকাখেলা
সিঁড়িতে সব কাঁঠালপাতা         দুয়ারে ফুল ভাসে
হাঁটুর উপর শাড়ী তুলিয়া          ঝর্ণামাসী আসে

বিকাল বেলা রথের মেলা        চাপা রশ্মি মেঘে ঢালা
ছোট ছোট ছেলেরা সব          চোখ টিপিয়া হাসে
রাধামাধবতলায় গেল             বাতাসা লুটের আশে

পেয়ারাগাছে রৌদ্র চড়ে            তারি মধ্যে বৃষ্টি পড়ে
মেঘে রৌদ্রে আলোয় ধূলোয়      বিকাল প’ড়ে আসে
কচুপাতায় মোতির মালা           সূর্যকণা ভাসে

আষাঢ় মাসে  জিরাও মন          ঘর রহ রে সোনাধন
টিনের চালে মধুঝরণ               শর্তা গুয়া পান
পানসখীরা মেঝের উপর           লেপটা হয়ে বসে





















শ্রাবণ মাসে কথা বন্ধ         সমস্তদিন শ্রবণ
কি বিহান কি দুপুরবেলা       সকল অন্ধকার
মেঘেমেঘে সন্ধ্যা আসে       রজনী শুধু ঝরণ

রজনী শুধু ভেকের সুর             যোজন যোজন অনেক দূর
ঝিল্লি ও ব্যাঙ , ঝিল্লি ও ব্যাঙ      শুধুই অনুরণন
মধ্যে মধ্যে উঠানে চোর           জল ছপ ছপ চলন

দেয়াল হলো শ্যাওলা-কালো     পচা পাতায় দেশ ভরিল
বাঁশের গায়ে কুঞ্জলিকা             হাত লেগেছে কখন
ঘিণিয়ে উঠে সারা শরীর          ঘিণিয়ে উঠে মন

কালো-বেগুনী কচুরিপানা        সবুজ সর সবুজ ফেনা
পুষ্করিণীর পাত-পচা জল        তাতে  সাপের আসন
ডাগর হ’ল লতাকচু                আঁধার হ’ল বন

শ্রাবণ নিশি আঁধার দিশি             জলজঙ্গল মিশামিশি
মাতামহীর ঝিম-লাগানী            খেই-হারানী কথন
চাঁদ সদাগর বিষহরি                সতীর স্বর্গগমন

লতায় সর্প  পাতায় সর্প             বিষহরির ভীষণ দর্প
ডূবন্ত ঘাস    ঢোঁড়া দাঁড়াস         কালনাগিনীর বন
আস্তীক , আস্তীক , নাম নিও না,     দেখ ঘরের কোণ

ঘন শ্রাবণ সন্ধ্যাবেলা               বেণুমাসীর পূজাপালা
পাঁচালী পড়ে ঝিমানি সুরে        উঠানে জল-ঝরণ
শনিদেবতার মতন আকাশ       কালিমাখা লণ্ঠন

আকাশ আলো আর হবে না       মাসীর শাড়ি শুকাবে না
বেয়াড়া হ’ল দূর্বাঘাস                কৃষ্ণকচুর বন
হঠাৎ হঠাৎ আঠাল জোঁক           শীঘ্র আন লবণ

শ্রাবণমাসে কথা বন্ধ                    শুধু শ্রবণ , শ্রবণ
জলের ডাক, ভেকের ডাক            বিহান সন্ধ্যা দুপুর
মেঘের ডাক ঝিঁঝির ডাক              চোরের মৃদু চলন











ভাদ্রমাস জল ঝরিল
তবু আকাশ থম ধরিল
খুলল ইস্কুল পাঠশালা               এবার ষান্মাসিকের পালা
ছাদ ফাটিয়ে রোদ চড়িল
ছুটির দিনে মেঘের গল্প            জ’মে ত ছিল অল্পস্বল্প
এবার মাস্টার কঠিন হ’ল
শান্তিমাসীর তাঁতের শাড়ী          জলে প’চে হয়েছে ভারী
এবার শাড়ী শুকিয়ে এল
তবু আকাশ অবিশ্বাস চমকে        বিজলী সর্বনাশ
হঠাৎ হঠাৎ আঁধার হ’ল

(C)Image:ছবি












আশ্বিন মাস শেফালী তলা         পায়ের তলা ভিজে
ঝরা  শেফালী মেহেন্দী ছাপ      ধরতে করুণ লাগে
ঘাসের জলে     রৌদ্র পড়ে      জানালাগুলি খোলে

উঠতে হবে বিহান বেলা         পাহারা দিব জবাতলা
তাঁতীপাড়ার  বেহায়া বেলা       ফুল চোরাতে এলে
ধর ফুলচোর, ধর ফুলচোর      তাড়াব দলে বলে

এখন আশ্বিন শীতল কাল         শুভ্র পশম মেষের পাল
সারাদুপুর আকাশ দেখা          উঠানে পাটী মেলে
শুমুল তুলা ফেনিয়ে ওঠে        নীল উঠানের কোলে

হলুদ শাড়ী সবুজ পাড়          সাদা ব্লাউজ চমৎকার
স্থলপদ্ম নবকলিকা              স্কুলবালিকা চলে
মোছা আকাশ মোছা বাতাস    পাতাবাহার দোলে


কখন এল ভোরের রাতে       যা দেবী সর্বভূতে
চোখ মুছিয়া চোখ মুছিয়া       জানালাগুলি খোলে
একটি নিমেষ দেখেছিলাম     শেফালীগাছের তলে

ষষ্ঠীর রাতে মন বসে না       ঘুমের ঘোরে বাদ্য শোনা
‘সুন্দরী গো দোহাই দোহায়’   শুধুই বেজে চলে
রোদ উঠিবে সানাই সুরে     কালকে প্রভাত হ’লে

অষ্টমী রাত ঢাকের কাঠি      আলতা কুঙ্কুম  পরিপাটি
কৃষ্ণ শাড়ী কৃষ্ণ কাজল         গরবী সখীদলে
একটি নিমেষ দেখেছিলাম    ঘাড় বেঁকানোর ছলে

ঝর্নামাসী ঝর্ণামাসী            বালুচরী না বেনারসী
কলকলানী মাসীরা সব       কই যেতেছে চলে
কখন এল     নবমী রাত     ধূপে চোখের জলে

আশ্বিন মাস শেফালীতলা      দেবতাদের পথচলা
হায় শেফালী মেহেন্দী ছাপ    ধরতে করুণ লাগে
মাড়িয়ে যাওয়া স্বর্গের ফুল    চেপে ধরেছি গালে












এল তারপর কোজাগরী        ভরসন্ধ্যায় উলু
বিভাদিদি শুক্লাদিদি পিটুলি    গুলে গুলে
রূপসী লতা রূপসী কুসুম     জাদুর পক্ষী আঁকে

আলিপনা আলিপনা বুকভরা কল্পনা
উঠানে আঁকে পদ্মফুল দাওয়ায় শঙ্খসারি
ভূতিমাসী পাঁচালি পড়ে   গমগম  করছে বাড়ী

সারাটি রাত চন্দ্রমালা        সুপারী গাছে কিরণ ঢালা
রূপা নেমেছে খালপুকুরে     উপুড় রূপার ঝারি
রূপালি মীন ঘাই দিয়ে যায়     রূপার পুচ্ছ নাড়ি

ঝর্ণামাসী শান্তিমাসী                সারাবেলা রয় উপাসী
কলার পাতে খিচুড়িভাত           লাবড়ামাখা করি
নারকেল কোরা নারকেলঝোরা   নিও কোচড় ভরি

আকাশ যেন রূপার থালা           নারকেল কোরা    দুধে ঢালা
কাশবরণী ধূ ধূ আকাশ              দীঘি শ্বেতাম্বরী
এমন রাতে পরীরা নামে           থানের কাপড় পরি

কোজাগরী কোজাগরী            রজনী ব’হে যায়
কার চাতালে দেবী আসেন      রূপার নথ নাড়ি
রূপসী লতা রূপসী কুসুম        জাদুর পক্ষীসারি

(C)Iamge:ছবি
















এখন দেখি ভোরের বেলা
মুক্তাবীচি ঘাসে ঢালা
গা শিরশির করে
দূরে পাহাড় ছায়াবরণ
আবছা, যেন মেঘের মতন
রৌদ্রে ছানি পড়ে
এখন অগ্রহায়ণ মাসে
ঝুড়ি ঝুড়ি সবজী আসে
কচি শালগম শিম
নেমে আসে ভূটানবালা
কাঁখে শিশু , পশমঝোলা
আর এনেছে হিম













পৌষ মাসে গো কনকফোটা       কাঁচা খড়ের রাশি
ভূতিমাসীর কালো ছেলেরা        গোহাল-বেড়া বাঁধে
গরুর গাড়ী খড়ের পাহাড়         উদাম গড়াগড়ি

এখন ছুটি নিঃশাসন ,           নীল কুয়াশার ভোরে
কিশোরদল  কিশোরীদল      শিশির থাকতে ওঠে
খড়ের চালে কাঁচা কিরণ      ঝর্ণা মাসীর বাড়ী

কিশোরদল  কিশোরীদল      নেট টাঙায় খেলে শাটল
না হারিবার না জিতিবার        দীর্ঘ শাটল খেলা
খেলতে খেলতে ফুটল আলো      শীতের সকাল বেলা

ছাড়া বাছুর কিশোরদল    মুহূর্মুহূ হাতে বল
মুহূর্মুহূ হাত ফসকায়       বল গড়িয়ে যায়
বারংবার  কিশোরীদল    ঐ বলটি কুড়ায়

দাদুর বাড়ী পাঁচিল তোলা    উঠানে ইঁট সুরকি ঢালা
রঙ কামলা রঙ এনেছে      চড়েছে  টিনের চালে
নব তার্পিন-তেলের গন্ধ     সিমেণ্টে জল ঢালে

কাঁচা কাঁচা কুলের বনে          কুড়িয়ে যায় আপন মনে
তাঁতী পাড়ার ধিঙ্গী মেয়ে         লজ্জাশরম নাই
এক গাড়ী খড় কেটে এনেছে   শুক্লাদিদির ভাই

কমলা-বাটা রোদের বর্ণ      দূরে পাহাড়ে শিখর-স্বর্ণ
ভারী ভারী কমলাঝুড়ি        পাহাড় থেকে আসে
ছড়িয়ে আছে কমলাখোসা    শিশির সদ্য ঘাসে

পিঠে রৌদ্র দুপুর বেলা        আচার-বয়াম চাতালে মেলা
রীনামাসী উল বুনে যায়      ঝর্নামাসী শেখে
রাঙাকাকা উলের বই         এনেছে বিলাত থেকে

কাক জাগেনি , ভোর সকালে     শান্তিমাসী বিরইন চালে
কাঁচা বাঁশের চুঙ্গা পিঠা            করেছে আয়োজন
ভুতিমাসীর কালো ছেলেদের     পাটিসাপটায় মন

পৌষ মাসে গো নবীন খড়ে      বুড়ীর বাড়ী বাঁধে
ভূতিমাসীর কালো ছেলেরা      চন্দ্রপুলি খায়
মাঘ সকালে বুড়ীর ঘর         আগুনে পুড়ে যায়


(C)Image:ছবি













১০
মাঘে আখাশ নীলই নীল    রৌদ্র হলুদ বাটা
রাত্রে নামে পাহাড়ী হিম    লেপে না কুলায়
দূরে শান্ত পাহাড় চূড়া      একটি চিল ঘোরে

শুক্লপক্ষ শ্রীপঞ্চমী             ভোরে উঠেছিলাম আমি
হিম সরোবর , অবগাহন ,  কাঁপতে কাঁপতে সারা
শুভ্র গেঞ্জি কাচা কাপড় ,     স্নান সেরেছে তারা

সর্বশুক্লা সরস্বতী            শ্বেত  পরিধান শ্বেত কিরীটি
হংসবর্ণ ভোরের আকাশ   পক্ষী মধুস্বরা
শান্তিমাসী ডালা সাজায়    সাদা কুসুম ভরা

বিল্বপত্র পুষ্পাঞ্জলি      জলছিটানো কোমল কলি
শঙ্খশুভ্র , শঙ্খশুভ্র      দুধে আলতা করা
শুক্লচরণ প্রভাতবরণ    পায়ে বকুল ঝরা

শুক্ল খৈ শুক্ল দহি                 শুক্ল আকাশ শুক্ল বহি
শুক্ল বিহান শুক্ল আলো          শুক্ল দুধের সরা
বালিকা –স্কুল জেগে উঠেছে   সদ্য শ্বেতাম্বরা

শুক্ল কাপড় আলতা-পাড়ী         নাবালিকার ব্লাউজ শাড়ী
কৈ নারিকেল চিনি চিঁড়া          বিতরে প্লেট-ভরা
সচন্দন কুসুমমালা                ঘর আলিপন করা

মাঘে আকাশ অতীব নীল        দূরে পাহাড় চূড়া
রাত্রে নামে পাহাড়ী শীত        লেপে না কুলায়
একটি নিমেষ দেখেছি তাকে     শুক্ল কাপড় পরা

(C)Image:ছবি












১১

ফাল্গুনমাস আমলকীডাল         যখন তখন কাঁপে
জানালা ছোট , রেডিও বাজে ,  সহসা বাতাস এসে
পর্দা ওড়ায়, গান বেজে যায়      ধূ ধূ দুপুর বেলা

পর্দা ওড়ায় , ঘর দেখা যায়      দূরে , টিলার ’পরে
মাদার ফুল না শিমুল ফুল       সবুজ টিনের বাড়ী
অনেক দূরের বাতাস আসে    যে বাতাস পাহাড়ী

সারা দুপুর ঝরা পাতা          আমলকীগাছ নোয়ায় মাথা
পাতা গুণিয়া পাতা গুণিয়া     ঘুমে লুটিয়া পড়ি
দূরের রৌদ্রে শুকাচ্ছে কার   সবুজ হলুদ শাড়ী

শাড়ী শুকায় শাড়ী শুকায়       বেলা বহিয়া যায়
চলে মন্থর ইঁটের ভারে         ক্লান্ত গরুর গাড়ী
উঠানে নাচে , নাচিতে থাকে  শালিকপাখীর সারি

শালিক শালিক তিনটি পাখী         আজকে অতিথি     আসবে নাকি
আপনমনে ধান খুঁটে যায়         চড়ুইনী সংসারী
সারা দুপুর কহিল কথা           ছাতের কবুতরী

ফাল্গুনমাস সকাল বেলা         হৈ রৈ রব আবীরতলা
রঙ ছিটিয়ে রঙ ছিটিয়ে          ফুরালো পিচকারী
এমন সময় রা-রা-রা –রা       আসতেছে ডাক ছাড়ি

বালিকার দল ভয়ে কাতর         ভয়ে পালায় এঘর ওঘর
কে যে হঠাৎ রঙ ছিটাবে          মলিন করবে শাড়ী
হা-রে-রে-রে আসছে কারা       এই বাড়ী ঐ বাড়ী

এল রঙীন কাহারা সব          এক মুহূর্তে কী উৎসব
মৃদু মৃদু মৃদঙ্গতাল               উদাম হাতচাপড়ি
‘আজ হোলি খেলব রে শ্যাম’   কেঁপে উঠেছে বাড়ী

বৌ-রা লুকায় ঝি-রা লুকায়      গীতামাসী লজ্জা যে পায়
বারোটা বাজে হয়েছে বেলা     দেরী হয়েছে ভারী
খেলা ফুরাইল নাইবে চল        রঙীন বস্ত্র ছাড়ি

রক্তবর্ণ সাবান ফেনা             দীঘল কেশের জট ঘোচে না
গা ঘেষিয়া গা ঘেষিয়া           সূর্য ঢ’লে যায়
রঙীন ফেনা বহিয়া চলে          ক্লান্ত কলতলায়

ফাল্গুন মাস পাল্লা খোলা       সহসা বাতাস এসে
পর্দা ওড়ায়  ঘর দেখা যায়    গান বাজিয়া চলে
পাতা গুণিয়া পাতা গুণিয়া      ঘুমে ঢলিয়া পড়ি


(C)Image:ছবি













১২
এখন তপ্ত চৈত্র মাস        কাঁচা কাঞ্চন বরণ
রেণু রেণু স্বর্ণ বউল         তাম্রাভ আমপাতা
সারা দুপুর কাকের কণ্ঠ    মন যে কাতর করে

চৈত্রমাসে দুপুর বেলা         দিদিমা বাড়ে ভাতের থালা
নিমের পাতা সুক্ত তিতা      মুগডালে আম পাড়ে
হা হা বাতাস ঢুকিয়া পড়ে    আঁধার রান্না ঘরে

চৈত্রমাসে তাপ নামেনা দিদিমা     ঘোঁটে বেলের পানা
দুপুরে সব হ’ল নীরব               তবু পুকুড় পাড়ে
একটি কোকিল একা কোকিল      ডাকে পাতার আড়ে

নিয়ত নড়ে হাতের পাখা      কোকিলের ডাক দুপুর ফাঁকা
নবীন চৈত্র, নবীন ঘাম         জানালা দিয়ে ঘরে
জবা গাছের উন্মনা ডাল      লুটিয়া লুটিয়া পড়ে

চৈত্রমাস বিকালবেলা        ঢাকের শব্দ , রাম-দা খেলা
ঘরে ঘরে হরপার্বতী         মুষ্টিভিক্ষা করে
বেণু মাসী চাল দিয়ে যায়    টিনের কৌটা ভ’রে

ধূলার চৈত্র , পাতার রাশি           ঘূর্ণী দ্বিপ্রহরে
ঝরা মুকুল , ছিন্ন ডাল               মথিত আম্রবন
“কাঁঠল পাক’---‘কাঁঠল পাক’”      পাখীর ডাক লহরে

ভিজল ধূলা , হ’ল গোধূলি          জুড়ালো গা , নাইতে চলি
জিরায় , আর তামাক খায়          দাদুরা আলাপ করে
বহিয়া গেল সাঁঝবাতাস            বৌ- কথা- কও- স্বরে ।।   

কোন মন্তব্য নেই: