“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৫

মাটি আর নারী

 (c)Photo:ছবি


















============
© সুনীতি দেবনাথ

সেদিন সেই যাযাবরী জীবনে শীতল সাইবেরিয়ায়...
পশুপালক তোমাদের সাথে আমিও তো ছিলাম
প্রান্তরের পর প্রান্তরে সবুজের সে কী তরঙ্গ উদ্দাম!
সেদিনও বরফ ঠাণ্ডায় যখন আমি কুঁকড়ে যেতাম,
তোমাদের সন্তানগুলিকে বুকে চেপে শেষ উষ্ণতা
বিন্দু বিন্দু ওদের দেহে সঞ্চালন করে দিতে হবে
সেই সত্য সবার উপরে জেনেছি মেনেছি।
আর ইউরাল পর্বতের অরণ্য থেকে
বুনো ঘোড়াকে বশ মানিয়ে এপার ওপার
পিঙ্গল চুল উড়িয়ে টগবগ টগবগ ছুটতে তোমরা।

এই করে একদিন সব ঘাস শেষ হতো
পরম্পরায় সন্তান সন্ততি বেড়ে পরিণাম খাদ্যাভাব
নতুন এলাকায় দিতে হতো পাড়ি
পশুর পাল যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র শিশু নারী সহ ,
নিঃসন্দেহে জানি যেসব নারীর দেহে জোয়ারের খেলা নেই
ভাঁটার টানে কুঁজো হয়ে প্রতীক্ষার শেষ দিন গুনে যেতো
বর্জিত হতো তারা খাদ্যহীন তাঁবুহীন সাথীহীন সে প্রান্তরে।
সেই সব নারী পৃথিবীর অনাদৃতা অবাঞ্ছিতা কন্যা মাত্র।
সেই আদিম পৃথিবীর নাবাল মৃত্তিকায় কত বৃদ্ধা জননীর দেহ
ইউরেশীয় চিল শকুন বুনো ধূর্ত শেয়ালেরা ছিঁড়েখুঁড়ে আহ্লাদে
 খেয়েছে, হাড়গোড় মিশে গেছে মৃত্তিকার স্তরে,
এসব করুণ গাথা ভূতাত্ত্বিক নৃতাত্ত্বিকের জ্ঞানের বিষয়।

গোষ্ঠীবদ্ধ জনসংখ্যা যখন লাগামছাড়া
অশ্বপৃষ্ঠে ছোট ছোট দলে পুরুষেরা ছুটলো
ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্য বিজয়ে, তখন তাদের দলে
পরিত্যক্ত আমি নারী, বিজয় এনে দেবে
নবীনা নারীদের
যোদ্ধা পুরুষের যুদ্ধক্ষেত্রে নারী বিবর্জিতা।
আর্যদের পূর্বপুরুষ এরা, এদেরই একটি শাখা
কালক্রমে পৌঁছে গিয়েছিল ইরান মরুর বুকে
রুক্ষ কঠোর জীবনে ওরা শক্ত পেশীর শরীরে
যুদ্ধ করে করে অপরিমেয় শক্তির আধার হলো।
ইঙ্গিতে ওদের ডাকছিল সুজলা সুফলা ভারতবর্ষ,
তাই অশ্বশক্তি অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান ওরা পৌঁছালো
গিরিপথ পেরিয়ে এদেশের অমল মধুর মাটিতে।
এবারও তাদের সাথে আমি নারী ঠাঁই পাইনি
ইতিহাস বলে।

ভূস্বর্গ কাশ্মীর দখল করে সিন্ধু অববাহিকায়
ইন্দোইরানীয় পুরুষ তোমরা উজ্জ্বল সূর্যালোকের মত
তেজোদীপ্ত আবির্ভাবে ক্ষমতার বলে বলীয়ান
পঞ্চ নদীর দেশ দখল করলে, দখল করলে আমাকে,
আমি অনার্য নারী সেদিন আর্য পুরুষের সম্পদ।
এভাবে ঠিক এমনি করে পুরুষ তুমি আমার সমগ্র সত্তাকে
একবার নয় বারবার দখল করেছো, সম্পদ বানিয়েছো।
যোদ্ধা পুরুষ অমিত শক্তিশালী মাটির দখল
নেবার সাথে সাথে ভূমিকন্যাদের দখল করেছো।
এ তোমার যুগ যুগের সঞ্চিত অপরাধ আর
ভূমিকন্যাদের অশ্রুসিক্ত জীবনের অপমান।
আমি আর আমার মত নারীরা যেন বোবা পশু,
পশুশিকারি মদমত্ত পুরুষ বন্য পশুর মতই
আমার দখলদারি চালিয়ে গেলে চিরটা কাল।
তোমাদের অশ্বখুরে উত্থিত ধুলোয় ঢেকে গেল
আমার চোখের জলের স্বপ্নমাখা উত্তাল তরঙ্গ।

বিজয়ী আর্য সারাটি উত্তর ভারত দখল নিয়ে
এলো জলজঙ্গলের দেশ রূপবতী বাংলায়।
আবারো ভূমিপুত্র নিহত বিতাড়িত হলো আর
কোমলকান্তা লাবনীমাখা ভূমিকন্যা অপহৃতা
লাঞ্ছিতা।
শ্যামলী বঙ্গকন্যার হাতে লোহার শিকল আর
পুরুষ দেহের রক্ত টিকায় ব্যক্তি পুরুষের চিহ্নিত
সম্পত্তি হলো নারী।
আজো এতদিনের এপারে এসে আমি নোয়া সিঁদুরের আনুগত্যের বন্ধন মুক্ত নারী হলাম না।
মাটি আর নারী বুঝি পুরুষের ঐতিহাসিক শাশ্বত সম্পদ!

কোন মন্তব্য নেই: