“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আয়স কাল ০১




(C)Image:ছবি
(কিছুদিন আগে এই ব্লগে দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন' -এর একটা ছোট সমালোচনাভিত্তিক সংক্ষিপ্তসার লিখেছিলাম । উপন্যাসটির কাব্যিক ভাষা, বর্ণনার চিত্রকল্পআঙ্গিক   এবং  বিষয় বস্তু আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল। কিছু কিছু বাক্য ও বাক্যবন্ধ মনের মধ্যে অনুরণন করতে থাকত, মনে হত এই কথাগুলো বাংলায় বললে কেমন হত তাই ধীরে ধীরে বইটাই অনুবাদ করে ফেলেছিলাম, 'আয়স কাল' নাম দিয়ে । অনুবাদটি ধারাবাহিক ভাবে এই ব্লগে বেরোতে থাকবেহয়তো যথাযথ সময়ানুবর্তীতা মেনে হবেনা, কারণ টাইপ করাতে  আমি নিতান্তই শম্বুকগতি ।  আজ তার প্রথম  ভাগ --- শিবানী দে )

তোমার হয়তো মনে পড়বে, গ্যারেজের পাশে একটা সরু নিচু গলি ছিল, যেখানে তুমি এবং তোমার বন্ধুরা মাঝে মাঝে খেলা করতে । সে জায়গাটা এখন মৃত, পোড়ো, অকেজো, শুধু বাতাসে ওড়া পাতার জঞ্জাল স্তূপীকৃত হয়ে পচতে থাকে ।

গতকাল এই গলিরই শেষ মাথায় দেখতে পেলাম কার্ডবোর্ডের বাক্স ও প্লাস্টিক চাদরে তৈরি একটা ঝুপড়ি, ভেতরে একটা লোক কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায় রাস্তার লোক, লম্বা, রোগা, গায়ের চামড়া শুকনো, দাঁতগুলো ক্ষয়ে সাপের দাঁতের মতন, পরনে ধূসর ঢোলা স্যুট ও দোমড়ানো হ্যাট । হ্যাট পরেই সে ঘুমোচ্ছিল, হ্যাটের কিনারা কানের নিচেয় ভাঁজ করে গুঁজে রাখা । এরকম ভবঘুরেদের হামেশাই মিল স্ট্রিটের পার্কিং লটে দেখা যায়, যারা দোকানীদের থেকে ভিক্ষা করে, ফ্লাই-ওভারের নিচে বসে মদ খায়, ডাস্টবিনে ফেলা উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবন ধারণ করে । এদের কাছে অগাস্ট মাস হল সব চাইতে খারাপ মাস, কারণ তখন বর্ষাকাল । সুতোয় বাঁধা পুতুলের পায়ের মত  দুপা ছড়িয়ে চোয়ালটা ঈষৎ ফাঁক করে ভবঘুরে লোকটি ঘুমোচ্ছিল । তার আশপাশ পেচ্ছাব, মদ, ময়লা, স্যাঁতলাধরা পোশাক, আরো না জানি কি সবের বোঁটকা গন্ধে ভারি । এককথায়, অপরিচ্ছন্ন ।

একটু সময় এই দুর্গন্ধ নাকে নিতে নিতেই আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । এতদিন, এতদিন পরে, যেচে আমার কাছে একজন অভ্যাগত এসেছে ।

এটা হল সেই দিন যখন আমি ডাক্তার সাইফ্রেটের কাছ থেকে খবরটা পেয়েছিলাম । খবরটা ভাল ছিল না, কিন্তু সেটা আমার খবর, শুধু আমারই, তাকে অস্বীকার করবার উপায় নেই । এ হল সেই খবর, যাকে বুকের মধ্যে করে বাড়ি বয়ে নিয়ে যেতে হবে, কোন মাথা-নাড়া অস্বীকার কিংবা চোখের জল না ফেলেই । আমি বলেছিলাম, “ধন্যবাদ, ডাক্তারবাবু, আপনি খোলাখুলি কথাটা বলে  দিলেন, তাই ধন্যবাদ ।ডাক্তার বলল, “আমরা যতটুকু পারি, তার সবটাই করব । আমরা ব্যাপারটা একসঙ্গে ট্যাকল করব ।কিন্তু সহযোগিতাপূর্ণ মুখের আড়ালে, আমার মনে হচ্ছিল, সে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে । এবার নিজেই নিজেকে বাঁচাও ডাক্তারের শপথ জীবিতের প্রতি, মৃতের প্রতি নয় ।

কাঁপুনিটা শুরু হল যখন আমি গাড়ি থেকে নামলাম । গ্যারেজের দরজা বন্ধ করার সময় আমার সারা শরীর কাঁপছিল । কাঁপুনি থামাতে আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম, শক্ত করে হাতব্যাগের স্ট্র্যাপ মুঠোয় ধরলাম । ঠিক সেই সময়েই আমার চোখে পড়ল সেই বাক্সগুলো, আর তার ভেতরে শোয়া মানুষটা ।

গলার ঝাঁঝ নিয়ন্ত্রণ না করেই আমি জিগ্যেস করলাম, “এখানে কি করছ ? এখানে থাকতে পারবে না । এখান থেকে  যাও ।

লোকটা নড়ল না । শুয়ে শুয়েই তার নজর পরখ করছিল নিচে থেকে উপরে-----শীতের মোজা, নীল রঙের কোট, ভুলভাল ঝুলের স্কার্ট, পাকা চুল, পাতলা চুলের মধ্যে শিশুর গায়ের রঙের মত বুড়ির মাথার গোলাপি চামড়া উঁকি দিচ্ছে ।

তারপর সে তার পা গোটাল, এবং আরামসে উঠল । কোন বাক্যব্যয় না করে সে আমার দিকে পেছন ফিরে কালো প্লাস্টিকের ছাউনিটা খুলল, তারপর সেটাকে আধাআধি, তারপর চার ভাগে, তারপর আটভাগে ভাঁজ করল । একটা ব্যাগ,(যেটার গায়ে এয়ার কানাডা লিখা ছিল) বের করে সেটার জিপ বন্ধ করল । আমি দাঁড়িয়েই রইলাম । বাক্সগুলো, একটা খালি বোতল, আর পেচ্ছাবের গন্ধ সেখানে ফেলে রেখে সে আমার পাশ দিয়ে এগোলো । কোঁচকানো প্যান্টটা টেনে উপরে তুলল । সে চলে যাবার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম, তাই খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে শুনলাম, অন্যধারে ঝোপের মধ্যে প্লাস্টিক ছুঁড়ে ফেলার শব্দ ।

একঘণ্টার মধ্যে দুটো ব্যাপার : খবরটা, অনেক দিন থেকে যা ভয় পেয়ে আসছিলাম ; আর এই দর্শন, এই আবির্ভাব ! গৃধিনীকুলের নির্ভুল ও শীঘ্র আগমনের বার্তাবাহক, আমি কিভাবে ওদের রুখতে পারি ? কেপটাউনের কুড়ানি ওরা, যাদের সংখ্যা কখনোই কমে না । যারা খালিপায়ে চলে, ঠাণ্ডায় কখনো কাতর হয় না । খোলা আকাশের তলায় শুয়ে থাকলেও যাদের অসুখ করেনা । না খেয়ে থাকলেও যারা মরে না ভেতর থেকে মদ তাদের গরম রাখে। তাদের রক্তে সংক্রমণ ও পচনের জীবাণু তরল আগুনেই ধ্বংস হয় । কোন ভোজের পর উচ্ছিষ্ট এরাই খেয়ে পরিষ্কার করে । শুকনো পাখা, চকচকে নির্দয় চোখ মাছির মত । এরাই হবে আমার উত্তরাধিকারী ।

কী মন্থর পায়ে আমি এই শূন্য গৃহে প্রবেশ করলাম, যে ঘরে প্রতিধ্বনি ও মিলিয়ে গেছে, যেখানে পদতলের প্রতিটা ক্ষেপণ  সাড়হীন এবং নির্জীব । কী আকুতি নিয়েই না আমি সেদিন চাইছিলাম তুমি যদি এখানে থাকতে, আমাকে জড়িয়ে ধরতে, সান্ত্বনা দিতে । এতদিনে আমি আলিঙ্গনের আসল অর্থ বুঝতে পারছি । আমরা কাউকে আলিঙ্গন করি নিজেই আলিঙ্গিত হতে । আমরা আমাদের সন্তানদের জড়িয়ে ধরি নিজেদের ভবিষ্যতের হাতে পুনরায় আলিঙ্গিত হবার জন্য, মৃত্যুর ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য, মরণ থেকে উত্তীর্ণ হবার জন্য । এজন্যই আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম, সবসময় । আমরা সন্তানদের জন্ম দিই পরে তাদেরই দ্বারা মাতৃভাবে লালিত হতে । এই সত্য ঘরে ঘরে মায়েদের সত্য । এখন থেকে শেষ অবধি  আমার থেকে এই কথাটাই তুমি শুনে যাবে তাই বলছিলাম, সেদিন বড় ইচ্ছে করছিল তুমি যদি কাছে থাকতে । উপরের ঘরে তোমার কাছে যাই, তোমার বিছানায় বসি, তোমার চুলে আঙ্গুল বোলাই,  তোমার কানে ফিসফিস করে বলি, “ওঠবার সময় হয়েছে আর তুমি পাশ ফের, তোমার শরীরে তাজা রক্তের উষ্ণতা,  তোমার শ্বাসে দুধের গন্ধ, তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলি,  “মাকে একটা বড় আদর দাও,”  যার আসল মানে,  তুমি আদর করলে মা কখনো মরবে না,  তোমার মধ্যেই বেঁচে থাকবে ।

বেঁচে থাকা ! তুমিই আমার জীবন, আমি তোমাকে আমার জীবনের মতই ভালোবাসি । প্রতিটি সকালে আমি ঘরের বাইরে এসে আঙ্গুল ভিজিয়ে হাওয়াতে তুলে ধরি । যখন ঠাণ্ডা হাওয়া উত্তরপশ্চিম দিক থেকে, তোমার বর্তমান বাসস্থানের দিক থেকে বয়, আমি অনেকক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে শুঁকতে থাকি এই আশায় যে তোমার কানের পেছনে, ঘাড়ের ভাঁজে যে মিষ্টি দুধেল গন্ধ পেতাম, তোমার শ্বাসের সঙ্গে তার একটুখানিও যদি দশ হাজার মাইল ভূমি ও সাগরের দূরত্ব অতিক্রম করে আমার কাছে পৌঁছায় !

আজকে থেকে আমার প্রথম কাজ-----আমার মৃত্যুকে কারো সঙ্গে ভাগ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা । তোমাকে ভালবাসা, জীবনকে ভালোবাসা, জীবিতকে ভালোবাসা, কোনরকম তিক্ততা ছাড়া বিদায়গ্রহণ । মৃত্যুকে আমার নিজের, একান্তই নিজের বলে আলিঙ্গন করা ।

তাহলে কার কাছে এই চিঠি লিখা ? উত্তর হল, তোমাকে, কিন্তু তোমাকেও নয়, আমাকে; তোমার মধ্যেকার আমাকে ।

সারাটা বিকেল আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করলাম, ড্রয়ারগুলো পরিষ্কার করলাম, কাগজগুলো বাছলাম, বাদ দিলাম ; সন্ধ্যাবেলা বেরুলাম । গ্যারেজের পেছনে ঝুপড়ি আবার আগের মত তৈরি হয়ে গেছে, কালো প্লাস্টিক সুন্দরভাবে মাথায় বিছানো । ভেতরে লোকটা পা গুটিয়ে শুয়ে আছে, একটা কুকুর তার কাছে শুয়ে কান ও ল্যাজ নাড়াচ্ছে । কুকুরটা কোলি জাতীয়, বাচ্চা থেকে অল্প বড়, কালোর উপর সাদা সাদা ফুটকি ।

আমি লোকটাকে বলে দিলাম, “এখানে আগুন জ্বালানো চলবে না । আমি কোনও ঝামেলা চাইনা, বুঝলে ?”

লোকটা উঠে চারদিকে তাকাতে তাকাতে পায়ের পাতা দুটো রগড়াতে থাকল, ভাবখানা যেন, বুঝতে পারছে না সে কোথায় আছে । ঘোড়ার মত লম্বাটে, রোদেজলে দড়কচ্চা মেরে যাওয়া মুখ, চোখের নিচেটা নেশাখোরসুলভ ফোলা, অদ্ভুত সবুজাভ চোখ----সব মিলিয়ে একটা অসুস্থ চেহারা ।

জিগ্যেস করলাম, “তোমার কি কিছু খাবার চাই ?”

আমার পেছনপেছন সে রান্নাঘরে চলে এল, যতক্ষণ না আমি ওর জন্য একটা স্যান্ডুইচ কাটলাম, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকল । দরজার পাল্লায় ঠেস দিয়ে সে স্যান্ডুইচে একটা মুখভরা কামড় বসাল, কিন্তু যেন চিবোতে ভুলে গেল । কুকুরটা কুঁই কুঁই করছিল, লোকটার শূন্য সবুজ চোখ চক চক করে উঠল । আমাকে এখন সাফসুতরো করতে হবে,” একটু অধৈর্য হয়েই ওকে বললাম, আর দরজা বন্ধ করবার উপক্রম করলাম । কোন বাক্যব্যয় না করেই লোকটা চলে গেল, কিন্তু আমার মনে হল, ঘরের কোণটা পেরিয়ে যেতে যেতে স্যান্ডুইচটা সে ছুঁড়ে ফেলল, আর কুকুরটা সেইদিকেই ঝাঁপাল ।

তুমি যখন ছিলে, তখন এত গৃহহীন মানুষ ছিল না । কিন্তু আজকাল এরা জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে । আমি কি এদের ভয় পাই ? মোটের উপর বলতে গেলে, না । অল্প ভিক্ষা, অল্প চুরিচামারি, নোংরা, চেঁচামেচি, মাতলামো, এর বেশি কিছু না । আমি বরং ভয় করি গোমড়ামুখ অল্পবয়সী ছেলেদের গ্যাং-কে, ওরা হাঙ্গরের মত হিংস্র, অনেকেরই এক আধবার জেল থকে ঘুরে আসা হয়ে গেছে । নিজেরা শিশু, কিন্তু শৈশবকে, আশ্চর্য হবার বয়সকে, মনের সমৃদ্ধ হবার বয়সটাকে ঘৃণা করে । তাদের মন, তাদের আশ্চর্য হবার ইন্দ্রিয় খর্ব, সদা সন্ত্রস্ত । আর অন্যদিকে, বর্ণবিভাজনের  বিরাট দেওয়ালের ওধারে তাদের শ্বেতাঙ্গ ভাইয়েরা ও মানসিক খর্বতার শিকার । তারা তাদের নিদ্রালু খোলের মধ্যে দিনরাত  আবর্তিত হচ্ছে । সাঁতারের ক্লাস, ঘোড়ায় চড়ার ক্লাস, ব্যালে শেখার ক্লাস, লনে ক্রিকেট খেলা, উঁচু দেওয়ালে ঘেরা বাড়িতে বুলডগের পাহারায় তাদের জীবন কাটে । স্বর্গের শিশুরা, ফরসা, দোষলেশহীন, দেবদূতের মত উজ্জ্বল, কিন্তু পুট্টির মত নরম । তাদের আবাস অজাতদের ত্রিশঙ্কু জগৎ, তাদের সরলতা মৌমাছি লার্ভার সরলতা, মোটাসোটা ও সাদা, মধুতে মাখামাখি, তাদের নরম চামড়া মিষ্টি রসে টইটম্বুর । তাদের মন তন্দ্রালু, প্রশান্তিপূর্ণ, বাস্তবজ্ঞানহীন ।

এই লোকটাকে আমি কি কারণে খাবার দিলাম ? তার কুকুরটা (আমি নিশ্চিত যে কুকুরটাকে চুরি করে আনা হয়েছে,) যদি কখনো আমার কাছে খাবার চাইতে আসত, তখন তাকে আমি যে কারণে খাওয়াতাম, সেই একই কারণে । সেই একই কারণে আমি তোমাকে আমার বুকের দুধ খাইয়েছিলাম । নিজে পরিপূর্ণ হওয়া এবং সেই পরিপূর্ণতা থেকে অন্যকে দেওয়া : এর থেকে গভীরতর ইচ্ছে আর কি হতে পারে ? বৃদ্ধ ও তার ক্ষয়িষ্ণু শরীর দিয়ে জীবনের শেষ বিন্দুটুকু শোষণ করে দেবার, পোষণের দুর্মর ইচ্ছা । তাই বোধ হয় মৃত্যু তার কুশলী তীর প্রথমে আমার স্তনের দিকেই ছুঁড়েছিল ।

এই সকালে কফি দিতে এসে দেখলাম সে ড্রেনে পেচ্ছাব করছে । কোনরকম লজ্জাসংকোচের বালাই নেই ।

তুমি কি কোন কাজ করতে চাও ?” আমি বললাম । চাইলে আমি তোমাকে অনেক কাজ দিতে পারি।

সে কোন কথা না বলে কফি খেতে লাগল ।

তুমি তোমার জীবনটাকে নষ্ট করছ ,”  আমি বললাম । তুমি ত আর বাচ্চা নও । তুমি এভাবে কি করে থাকতে পার ? কি ভাবে তুমি সারাদিন কিছু না করে শুয়ে থাক ? আমি এটা কিছুতেই বুঝতে পারিনা ।

এটা সত্যি ; আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা । আমার মধ্যে কিছু একটা আছে যা এই আলস্যের বিরুদ্ধে, এইরকম সব ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতার  বিরুদ্ধে, এই ইচ্ছাসুখিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ।

এর উত্তরে সে যে কাজটি করল, তাতে আমি থ হয়ে গেলাম । আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে (এই প্রথম সে আমার দিকে সোজা তাকাল ) সে ঘন, কফির বাদামি রঙ মেশানো হলুদ একদলা থুথু আমার পায়ের কাছে কংক্রিটের উপর ফেলল । তারপর কফিমগটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হনহন করে চলে গেল ।

ধাক্কা খেয়ে ভাবলাম, জিনিষটা, আমাদের মধ্যেকার সেই জিনিষটাই বাইরে চলে এল । আমার গায়ে থুথু ফেলেনি বটে,  কিন্তু আমার সামনে ফেলেছে, যেখানে দেখতে পারি, পরখ করতে পারি, এ নিয়ে ভাবতে পারি । তার জবাব, তার নিজস্ব ধরণের জবাব তার মুখ থেকে গরম গরম বের করে এখানেই রেখে গেছে । অনস্বীকার্যভাবে এটাই তার কথা, ভাষায় প্রকাশ করার আগের ভাষা । প্রথমে তার সেই দৃষ্টি, তারপর নিষ্ঠীবন । কি ধরণের চাউনি ? মায়ের সমান বৃদ্ধা মহিলার প্রতি অশ্রদ্ধাপূর্ণ  দৃষ্টি----ওহে, এই যে রইল তোমার কফি ।

সেই রাতে সে আর গলিতে শুতে এল না । বাক্সগুলোও উধাও । কিন্তু খানিকটা ইতিউতি খুঁজে আমি দেখলাম, এয়ার কানাডা লেখা ব্যাগটা পড়ে আছে কাঠ রাখার ঘরে, যে ঘরে কাঠের গুঁড়ি ও ডালপালার মধ্যে সে নিজের জন্য একটুখানি জায়গা হবে বলে ভেবে রেখেছে বলে মনে হয় । বুঝলাম সে আবার ফিরে আসবেই ।

এরই মধ্যে ছপাতা লিখে ফেললাম, তাও আবার এমন একটা  লোকের  সম্পর্কে, যার সাক্ষাৎ তুমি কখনো পাও নি, আর পাবেও না কখনো । আমি কেন ওর বিষয়ে লিখছি ? কারণ সে, সে-ই বাঁচছে, আমি নই । আরেকটা কারণ, সে যে দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে, তা নিয়ে লেখা যেতে পারে । তা না হলে এই লেখাটি কখনো উচ্চগ্রামের, কখনো নিচুখাদের এক বিলাপ সঙ্গীত হয়ে উঠত না ? যখন আমি ওর সম্পর্কে লিখি, তখন আমার নিজের সম্বন্ধেও লিখা হয়ে যায় । যখন ওর কুকুরের সম্পর্কে লিখি, তখন ও আমার নিজের সম্পর্কে লিখা হয়, যখন বাড়ির সম্বন্ধে লিখি, তখনো ও সেটা আমার সম্বন্ধেই লেখা । লোকটা, কুকুর, বাড়ি---যে বিষয়ই হোক না কেন, তার মাধ্যমে আমি তোমার  দিকে হাত বাড়াই । অন্য জগতে আমার আর শব্দের প্রয়োজন হবে না । আমি তোমার দোরগোড়ায়  হাজির হব । বলব , “তোমাকে দেখতে এসেছি”, আর শব্দ সেখানেই শেষ হবে । আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরব, আর নিজেও আলিঙ্গিত হব । কিন্তু এই জগতে এই সময়ে আমাকে তোমার কাছে পৌঁছাতে শব্দের সাহায্য নিতে হবে । তাই দিনের পর দিন আমি নিজেকে শব্দে প্রকাশ করি শব্দকে কাগজের পাতায় মিঠাইয়ের মত সাজাই : আমার মেয়ের জন্য মিঠাই, ওর জন্মদিনের জন্য, যে দিনটাতে আমি ওকে জন্ম দিয়েছিলাম । আমার শরীর থেকে আসা কথা, আমারই বানানো মিষ্টির গুলি, আমার মেয়ে নিজের সময়মতো খুলে দেখবে, বের করবে, মুখে দিয়ে চুষবে, নিজের শরীরের মধ্যে নেবেযেভাবে কোন কোন মিষ্টিগুলির বোতলের গায়ে লেখা থাকে : পুরোনো ধরণের মিষ্টিগুলি, মা দিদিমাদের হাতে বানানো; তাদের ভালোবাসা জড়ানো, যে ভালোবাসার বিকল্প নেই, শুধু অনুভব করা যে আমরা তাকে কি করব উপভোগ, না পরিত্যাগ ।


কোন মন্তব্য নেই: