“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস

(C)Image:ছবি
























©সুনীতি দেবনাথ
----------------------------------------


নোংরা দুর্গন্ধমাখা আবর্জনার স্তূপ,
সেটাকে ঘিরে শকুনিরা কর্কশ চিৎকারে
আকাশটাকে করছিল ফালাফালা।
ওখানেই প্রাণের উদ্ভাসে জন্মেছিল শিশুটি-
অন্ধকারে সেই মানব শিশুটি গাঢ়তর অন্ধকারকে
উপভোগ করার জন্যই জন্মেছিল।
তাই প্রথম দুচোখ মেলে যখন সে তাকালো-
প্রথম সে দৃষ্টিপাতে বোধের জগতে তোলপাড়
পৃথিবী এমনি হয় নোংরা পুঁতিগন্ধময়
আঁধার আকাশে মোড়া, হয়তো জেনে গিয়েছিল সে।
আহা! ফুলের মত পবিত্র শিশুটি
ব্রাজিলের সেই সিণ্ডেরেলা বিশ্বের বিস্ময়কর পণ্যদ্রব্য!
প্রথম চোখ মেলে তাকালেন
মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস!
শকুনির ভিড়ে এক স্পন্দিত জীবন!
তারপর দিন গেল রাত গেল ক্রমাগত এলোগেলো।
কিভাবে দিন রাতের পারাপার হল-
খবর জানেনা কেউ,খবর রাখেনি কেউ,
ব্রাজিলের লাখো শিশুর দিন রাত এমনিই ছিল।
তবে সবাই জানে অনেক দুঃখ বেদনার পথ হেঁটে
মারিয়া আরও গভীর প্রাপ্তির জন্য
আরও কঠোর শ্রমদানের জন্য বেঁচে চললেন,
বেড়েও উঠলেন,মারিয়া একদিন যুবতী হলেন।
একদিন এক পুরুষের সাথে তাঁর ভালবাসাবাসি হল
সন্তানের জন্ম দিয়ে মারিয়া জননীও হলেন-
অবিরত শ্রম আর দুঃখের সহবাসে তিনি এক নারীও হলেন।
সারাটা দিন কাজ আর কাজ চলমান এক কাজের চাকা
সারাটা রাত নিবিড় নিখাদ দুঃখের বুননে কালো
এরই মাঝে বেঁচে থাকে ব্রাজিলের অগুনতি নারী-
মারিয়াও বেঁচে ছিলেন, বাঁচার ফাঁকে ফাঁকে আঁকাবাঁকা ছাঁদে
অক্ষরে অক্ষরে যন্ত্রণাদগ্ধ মনের কথাগুলি
দিনলিপির পাতায় পাতায় উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন,
কালো পৃথিবীর নারীর বেদনায় উপলব্ধ কোমল- গান্ধার!
একদিন এক আকস্মিক ক্ষণে এক সাংবাদিক
পেলেন সেই দিনলিপি পড়লেন বিমুগ্ধ হলেন
বুঝে গেলেন এ নারীর গহন মনের খনি পূর্ণ কালো সোনায়।
কুয়ারতো দে দেসপেহো’ – ‘চাইল্ড অফ দি ডার্ক
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হল, আর থামা নেই
ব্রাজিলের আস্তাকুঁড়- কন্যা হলেন লেখিকা।
সারা দুনিয়া তাজ্জব একী অপরূপ সৃষ্টির সম্ভার!
জীবনের টাটকা গন্ধমাখা, বিলাসী বিদগ্ধ জীবন নয়,
লা ফাবেলা’- ‘ঝুপড়ি’-র বাস্তব জান্তব জীবন আর
সাওপাওলোর নোংরা বস্তির পাঁচ বছরের ডায়েরি’ –
কষ্টকল্পিত কৃত্রিম সৃষ্টির আবর্জনা মাত্র নয়,
দেখে দুইচোখে অনুভবে জেনে সত্যি বেঁচে থেকে
শাশ্বত মানুষের সাহিত্যে নিচে থাকা ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা
অগণিত মানুষের অতলান্ত বেদনার অফুরান কথামালা-
চমকে উঠল তথাকথিত আঁতেল শিল্পের সমঝদারগণ।
আস্তাকুঁড় থেকে বস্তি বিদগ্ধসমাজ বেমানান
এ এক অলৌকিক জাদুকরের যেন জাদুকাঠির ভেল্কিবাজি!
রাতারাতি পৃথিবীর চল্লিশটা দেশের মানুষ
মারিয়া কারোলিনার বিচিত্র কথামালার বিমুগ্ধ পাঠক
উলট- পালট এই উত্থানে তেরটি ভাষায় অনুবাদও হল
জীবনের সত্য অভিজ্ঞতার চরম পরম বেদনার্ত উচ্চারণ!
এবার পরিভ্রমণ বিশ্বজোড়া মহাযাত্রা
সিণ্ডেরেলার পণ্য হবার চটকদার জীবন।
পৃথিবীর অসংখ্য পথে মাত্র কবছরের আশ্চর্য ভ্রমণ
সম্বর্ধনা সাক্ষাতকারের হুল্লোড় ফ্ল্যাশের জ্বলে ওঠা নেভা
ক্লিক্ ক্লিক্ কত, নোংরাঘাটা হাত দুটি তাঁর
নন্দিত হল বন্দিত হল অভিনন্দন আর পুরস্কারে।
সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহোদয়গণ আমন্ত্রণ ভোজে সঙ্গী পেয়ে
ধন্য হলেন, বলা কি সঠিক নয় ধন্য করলেন?
তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনায়কগণ বিশ্বের দিলেন অভ্যর্থনা-
অভিনন্দনে আস্তাকুঁড়ের মারিয়া নন্দনকানন বাসিনী।
বিশ্বদরবারে খ্যাতির শীর্ষে তখন মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস।
মনুষ্য শরীরে ডিনামাইট হল ক্ষুধা’-
এল আমব্রে এস লা দিনামিতা দেল কুয়ের পো উমানো’ –
ক্ষুধার এমন আগুনজ্বলা জ্বালাময়ী ধ্রুব উচ্চারণ
কোনও কবি বা লেখক কোনদিনই কি করেছিলেন ?
কোনও ক্ষুধার্ত মানুষও তার জীবনের স্পষ্ট সত্যকে এমনি
উচ্চারিত হতে শোনেনি কোনদিন- অনবদ্য গ্রন্থের অভিনব কথা!
১৯৭৭সালের শুরুতে বিষণ্ণ রোববারের এক ধোঁয়াটে সকাল
দিনের সূর্য তখনো পুব আকাশে নরম লাল আলো ছিটোনো শুরু করেনি
সেদিনও এক আস্তাকুঁড় ঘিরে পালে পালে শকুনি ডানা ঝাপটাচ্ছিল
উল্লসিত কর্কশ এক বীভৎস কোরাসে তারা-
নোংরা ডাস্টবিন ঘিরে প্রমত্ত ওড়াওড়ি
এই আবহে মরে পড়েছিলেন এক ব্রাজিলিয়ান নারী
ওদেশের হাজার হাজার অতি সাধারণ নারীর মতন।
তিনি এক অনবদ্য সার্থক নারী অন্যের উচ্ছিষ্ট খুঁটে যিনি
ঘোষণা করেছিলেন অমোঘ সত্য-
তুচ্ছতার ঘেরাটোপে থেকেও তাঁর উঁচু মাথা ছুঁয়েছিল আকাশের উচ্চতা,
সৃষ্টির নিত্য সত্যাকাশে আলোর বিভাসে ধ্রুবতারার মতই
প্রতিষ্ঠা পাবার অধিকারী তিনি মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস!
জীবনের ক্ষুদ্রতম খণ্ড অবসরে সমাদৃতা হবার কালেও
মহার্ঘ ভোজসভায় আপ্যায়ন কালেও স্বপ্নেরা তাঁর-
শ্রমদানকালে প্রতিদিন প্রতিটা দিন মেশিনের ঘাতক চাকায়
পিষ্ট হয়ে গড়পড়তা শত শ্রমিকের আহত-নিহত হওয়া,
আর জন্মলগ্ন থেকেই সার সার বোবা স্তব্ধ দৃষ্টির ভিখিরি শিশু
এসব কিছুকে ঘিরে থাকা হিংস্র শকুনির ভয়াল চক্কর,
আতঙ্কিত স্বপ্নদের নিয়ে সুখ যাত্রায় কান্নার লহর বয়ে যেতো তাঁর।
নির্যাতিত ব্রাজিলের নির্যাতিতা নারী নির্যাতিত জীবনের ভাষ্যকার
শোষিতের একেবারে কাছে থেকে শোষিত জীবনে থেকে
কোনও একদিন হয়তো মুক্তি আসবেই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্পষ্ট,
স্বপ্নদ্রষ্টা সেই নারী সকলকে স্বপ্ন দেখিয়ে আস্তাকুঁড়েই মরে গেলেন।
আজ কোন মুগ্ধ পাঠক বা স্তাবক পুষ্পগুচ্ছ হাতে এলোনা-
আজ প্রগাঢ় সন্তাপে কোন বিষাদ- মেদুর বিদায়ী ভায়োলিন বাজলোনা।


.....................................................................................................
এক কৃষ্ণা ব্রাজিলিয়ান নারীর কান্নার লহর আমার কবিতা " মারিয়া কারোলিনা দে হেসুস ", আবৃত্তি করলেন আমারই প্রিয় ভাই রুবেল পারভেজ। আমি রুবেলের কাছে কৃতজ্ঞ। এখানে  ক্লিক করে শুনুন




কোন মন্তব্য নেই: