“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৫

শেফালি একটি ফুলের নাম

                 ।।শৈলেন দাস।।

রতের সকালে শেফালি ফুল গৃহস্থের উঠানে প্রস্ফুটিত হওয়ার মত মহেশ দাসের বাড়িকে অনেকটা উজ্জ্বল করে রেখেছে প্রাণ চঞ্চল, বিনয়ী স্বভাবের শেফালি দেব। অল্প কিছুদিন হল টেট পরীক্ষা পাশ করে প্রাইমারী স্কুলের দিদিমণি হয়ে সে এসেছে  বরাকের প্রত্যন্ত অঞ্চল বিলাইপুর গ্রামে। তার নম্র এবং মিশুকে ব্যবহারে গ্রামের সবাই মুগ্ধ। বিশেষ করে মহেশ দাসের বাড়ির সবাই তো শেফালির সুরভিতে বিমোহিত। তার থাকা-খাওয়াতে যেন কোন খামতি নাথেকে যায়, শহর থেকে গ্রামের অনাত্মীয় এক পরিবারে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকলেও তার যেন মনে নাহয় সে অন্যের বাড়িতে আছে -সে ব্যাপারে সবাই খেয়াল রাখে। এছাড়াও আরেকজন আছে যে মন্ত্রমুগ্ধের মত সদা শেফালির সাহায্যকারী। শেফালির যেকোনো প্রয়োজনে সে এক পা'য়ে খাড়া। শেফালির মতে অভারস্মার্ট, গুডলুকিং কিন্তু একটু বোকা -এই ছেলেটি মহেশ দাসের ভাইপো বিকাশ। সেও স্থানীয় সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক, তবে স্থায়ী নয় চুক্তির ভিত্তিতে তার চাকরি। শেফালির প্রতি তার এই মুগ্ধতার কারণ যে যার মত করে বুঝে নিলেও কেউ কিন্তু বাঁকাভাবে ব্যাখ্যা করেনি কখনো। শেফালিও তার এই খাতির উপভোগ করেছে খোলা মনে। আর যা-ই হোক শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে এসে তাকে অন্তত বোর হতে হয়নি বন্ধুর অভাবে।
     এরই মধ্যে শিক্ষা দপ্তরের এক নির্দেশে সরকারি স্কুলগুলিতে কম্প্যুটার শিক্ষকদের রদবদল প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাইমারী স্কুল গুলিতে শেফালির মত যারা চাকরি পেয়েছে তারাও অফিসে ধরাধরি করে নিজেদের বাড়ির আশেপাশের স্কুল গুলিতে চলে যাচ্ছে এটাচম্যান্টে। কিন্তু শেফালি ব্যতিক্রম, সে বিলাইপুরেই থেকে যাবে বলে ঠিক করেছে। শেফালির এই সিদ্ধান্তে বিকাশ তো মহা খুশি। দুদিন থেকে এক অন্যরকম চঞ্চলতা অনুভব করছে সে নিজের মধ্যে। হঠাৎ করে তার সব ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়েছে শেফালি। তার মনে ধারণা জন্মাতে লাগল হয়ত তার প্রতি ভাল লাগা ভাবের জন্যই শেফালি থেকে গেছে এখানে। অতএব আর দেরি করা চলবে না। বলে নিতে হবে নিজের মনের কথা। কিন্তু কীভাবে? অনেক ভেবে চিন্তে একটু সাহস জোগাড় করে একদিন সন্ধ্যায় সে সময় চাইল শেফালির কাছে। মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য বাড়ির বাইরে কোথাও  সে নিয়ে যেতে চায় শেফালিকে। এদিকে শেফালিও মনে মনে একটা সুযোগ খুঁজছিল একবার বাড়ির বাইরে যেতে এবং এক্ষেত্রে বিকাশই ছিল তার একমাত্র উপায়। তাই সে খুশি হয়ে রাজি তো হয়েছেই সাথে বিকাশকে একটা সারপ্রাইজও দেবে বলেছে। শেফালি চটকরে তার কথায় বাইরে সময় দিতে রাজি হয়েছে এবং কি একটা সারপ্রাইজও নাকি আছে তার জন্য, বিকাশের তো আনন্দ আর ধরেনা।
দুদিন পর রবিবার বিকেলে প্ল্যান মত বাড়ির লোকজনকে বলে ওরা এসেছে একটি মন্দিরে, একটু নির্জন জায়গায়। বেশ পরিছন্ন মন্দিরের সিঁড়ির হাতলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শেফালি। বিকাশ তার ব্যাগ থেকে একটি ডাইরি বের করে দিতে যাবে শেফালিকে এমন সময় শেফালি 'সারপ্রাইজ' বলে চোখে ইশারা করল মন্দিরের গেইটের দিকে। সৌম্যদর্শন এক যুবক আসছে মন্দিরের গেইট পেরিয়ে।  বিকাশ তাকে চিনে, আলাপও হয়েছে ওদের। নতুন কম্প্যুটার টিচার। শেফালি কয়েক পা এগিয়েছে আগত সারপ্রাইজকে স্বাগত জানাতে, সেই ফাঁকে বিকাশ তার ডাইরির প্রথম পাতাটি ছিঁড়ে সন্তর্পণে ফেলে দিয়েছে পূজা শেষে বাসি হয়ে যাওয়া ফুলের স্তূপে। রোল টানা কাগজে লেখা 'শেফালি একটি ফুলের নাম' -বিকাশের ভাবনার কলি, অঙ্কুরিত হওয়ার আগে ঝরে পড়েছে ।

কোন মন্তব্য নেই: