“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আয়স কাল ২১


(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের ৪র্থ অধ্যায়ের ৩য়     ভাগ। এই সঙ্গে উপন্যাসটি এখানেই শেষ হলো : -- শিবানী দে)




(C)Image:ছবি

                     *      *      *      *      *

ময় প্রায় এসে গেছে যখন খুব নিজস্ব কাজের জন্যেও আমাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে । এই দুঃখকাহিনি সমাপ্ত করার ও তাহলে ও উপযুক্ত সময় । এটা নয় যে আমি সন্দেহ করি ভারকুয়েইল সহায়তা করবে না । যখন শেষ সময়ের কথা হচ্ছে, তখন আমি তাকে কোনোভাবেই সন্দেহ করি না । তার মধ্যে সব সময়েই আমার জন্য একটা উড়ুউড়ু ভাবের অনির্ভরযোগ্য উদ্বেগ ছিল, তার সেই উদ্বেগ সে প্রকাশ করতেও জানে না । আমি পড়ে গেছি, সে আমাকে ধরেছে । এখন আমি বুঝতে পারি যে সে যখন প্রথম এসেছিল, তখন সে আমার হাতে দেখাশোনার জন্য পড়েনি, আমিও তার হাতে দেখাশোনার জন্য পড়িনি । অথবা আমরা দুজন দুজনের হাতে পড়েছি, সেই পারস্পরিক নির্বাচন অনেক হোঁচট খেয়েছে, কখনো উপরে উড়েছে, কখনো গোত্তা খেয়ে মাটিতে নেমে এসেছে ।
তবুও সে কোন শুশ্রূষাকারী বা পরিপোষক হতে পারে এ ভাবাই যায় না । সে হল শুষ্ক; তার পানীয় জল নয়, আগুন । সম্ভবত এজন্যই আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনা তার কোনো সন্তান থাকতে পারে । তার শুক্র হবে শুকনো এবং বাদামি, রেণুর মত, এদেশের ধুলোর মত ।
তার উপস্থিতি, তার সাহায্য আমার চাই, কিন্তু সেও আমার সাহায্য চায় । কোনো নারী পুরুষকে যে সহায়তা দিতে পারে, সেরকম সাহায্য সে চায় । কোনো মন ভুলিয়ে তুলে নেওয়া নয়, বরং মনোযোগ দেওয়াতে সাহায্য। সে ভালবাসতেও জানে না । আমি কোনো মনের ওঠাপড়ার কথা বলছি না, সবল দৈহিক ভালবাসার কথাই বলছি । সে একটা বাচ্চা ছেলের মত ভালবাসার ব্যাপারে আনাড়ি । জিপ, বোতাম বা ক্লাস্পের কি ভূমিকা সে জানে না । কোন জিনিষ কোথায় যায় সে জানেনা । যা করতে হবে তা কি করে করতে হয় তা সে জানেনা ।
আমার দিন যত ঘনিয়ে আসছে, সে ততই বিশ্বস্ত হচ্ছে । তবুও আমাকে তার হাত ধরে দেখাতে হচ্ছে । 
আমার মনে পড়ে সেই দিনটা যখন আমরা গাড়িতে বসেছিলাম, সে দেশলাই ধরে আমাকে বলেছিল, “ওটা কর ।ক্রোধে বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু আমি কি তাকে ঠিক বিচার করেছিলাম ? এখন আমার মনে হয় মৃত্যু সম্পর্কে তার কোনোও ধারণা নেই, যেভাবে কোনো কুমারীর যৌনতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই । কিন্তু কৌতূহল একই রকম । যেমন একটা কুকুর তার মনিবের দুপায়ের সন্ধিতে শুঁকে, ল্যাজ নাড়ায়, পুরুষাঙ্গের মত লাল এবং বোকাবোকা তার জিভ বাইরে ঝোলে । 
গতকাল যখন সে আমাকে চান করতে সাহায্য করছিল, আমার স্নানের জামাটা খসে পড়েছিল, সে তাকিয়ে দেখছিল । যেন মিল স্ট্রিটের ভবঘুরে বাচ্চা, যাদের মধ্যে শিষ্টাচারের লেশটুকুও নেই । শিষ্টাচার: ব্যাখ্যার অযোগ্য, সমস্ত নীতিশিক্ষার ভিত্তি । আমরা কি কি করি না । যখন আত্মা শরীর ছেড়ে যায়, তখন আমরা তাকিয়ে থাকি না, আমাদের চোখ জলে আবৃত হয়ে যায়, অথবা হাত দিয়ে চোখ ঢাকি । আমরা আঘাত পাওয়া জায়গার দিকে তাকিয়ে থাকি না, কারণ সেইসব জায়গায় আত্মা বেরিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিল, তারপর জোর করে রাখা হয়েছে, আঘাতটা বন্ধ করে, সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ।
আমি জিগ্যেস করেছিলাম, সে বেড়ালগুলোকে খাওয়াচ্ছে কি না । সে মিথ্যে করে বলল, “হ্যাঁ ।কারণ বেড়ালগুলো কুকুরের জন্য পালিয়েছে । আমি কি আর ভাবি ? না, আর নয় । আমি তোমাকে দেখাশোনা করেছিলাম, তারপর ওকে, আমার হৃদয়ে আর বিশেষ জায়গা নেই । বাকি যা কিছু আছে, ওই যে লোকে বলে না, ‘ভাঁড় মে জায়ে’* 
গতকাল রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছিল আমি তোমাকে বিদায় জানাতে আহ্বান করতে চেয়েছিলাম । কিন্তু তুমি এলে না । আমি তোমার নাম উচ্চারণ করলাম, ফিসফিস করে, “আমার মেয়ে, আমার সন্তান,” আমি অন্ধকারে বললাম, কিন্তু আমার সামনে যা এলো তা হল একটা ফোটোগ্রাফ: তোমার একটা ছবি, তুমি নও । যখন আমি ঠাণ্ডা হয়ে যাই, হয়তো তখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাগরপারে যাবার জন্য আমি আহূত হই, জানি না । 
দেখছ তো, আমি এখনও তোমার ভালবাসায় বিশ্বাস করি । 
আমি শিগ্‌গিরই এই কথার রজ্জু থেকে তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি । আমার জন্য দুঃখিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই । কিন্তু এই লোকটা, যাকে আমি রেখে যাচ্ছি, যে সাঁতার জানে না, যে এখনো উড়তেও শেখেনি তার জন্য তোমার চিন্তায় একটুখানি স্থান রেখো ।


আমি ঘুমিয়ে যখন জাগলাম, তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা : আমার পেট, হৃদ্‌পিণ্ড, শরীরের হাড় অবধি ঠাণ্ডা । ব্যালকনির দিকের দরজাটা খোলা, বাতাসে পর্দা উড়ছিল । 
ভারকুয়েইল ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সাগরের মত ঝরা পাতার আন্দোলন  একদৃষ্টে দেখছিল । আমি তার হাত, তার উঁচু খোঁচা খোঁচা কাঁধগুলো, হাড় বের করা মেরুদণ্ড স্পর্শ করলাম । ঠকঠক করা দাঁতে জিগ্যেস করলাম, “কি দেখছ ?”
সে উত্তর দিল না । আমি আরো কাছে গেলাম । আমাদের নিচে ছায়ার সাগর, পাতার আচ্ছাদন নড়ছে, মর্মর শব্দ করছে, যেন অন্ধকারের শরীরের আঁশ ।
সময় হয়েছে ?” আমি বললাম ।
আমি বিছানায় ফিরে গেলাম, দুটো শীতল চাদরের সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকলাম । পর্দা বিভক্ত হল, সে আমার পাশে এলো । এই প্রথমবারের মত আমি কোনও গন্ধ পেলাম না । সে আমাকে তার দুবাহুতে তুলে প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরল, যাতে আমার শ্বাস ঝটিতি নির্গত হয়ে যায় । তার সেই আলিঙ্গন থেকে কোনো উষ্ণতা পাবার ছিল না ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------

তারাচিহ্নিত শব্দগুলোর তাৎপর্য  :

আফ্রোদিতি (Aphrodite): গ্রিক পুরাণের অনুসারে প্রেম ও প্রমোদের দেবী । সাধারণত: দেবীমূর্তির শরীরের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত থাকে ।
ম্যান্‌ড্রাগোরা(mandragora) : বিষাক্ত গুল্ম বিশেষ, এর থেকে ব্যথানাশক ও ঘুমপাড়ানোর ওষুধ তৈরি হয় ।
শাফ্‌ল্‌(shaffle) : পা মেঝেয় ঘষটে নাচবিশেষ
হ্যালুসিনেশন(hallucination) : দৃষ্টিবিভ্রম (সাধারণত: শারীরিক অসুস্থতার কারণে বা বিশেষ ওষুধ বা মাদক সেবনের ফলে) ।
ট্রিস্টান(Tristan) : মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সাহিত্যে অন্যতম জনপ্রিয় রোম্যাণ্টিক নায়ক ।
গাই ফক্স(Guy Fawkes) : (১৫৭০---১৬০৬) ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম । গাই-এর উপর সিংহাসনের নিচে বারুদ রাখার দায়িত্ব ছিল ।কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ধরা পড়ে ও তাদের ফাঁসির সাজা হয় । গাই ফক্‌স্‌কে যখন ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য দড়ি পরানো হচ্ছিল, তখন দৈবাৎ পড়ে গিয়ে তার ঘাড় ভেঙ্গে মৃত্যু হয় । সেই থেকে ৫ নভেম্বর গাই ফক্‌সের রাতউৎসবে পরিণত হয়েছে । পুরোনো কাপড় ও খবরের কাগজ ও মুখোস দিয়ে ফক্‌সের পুতুল বানিয়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে এসে কোনো খোলা জায়গায় কাঠকুটো জড়ো করে সেই পুতুল পোড়ানো হয় । বিশেষ করে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাই এতে অংশ নেয় ।
ভার্জিল(Virgil) : রোমান মহাকবি, ইতালির মাতুয়া শহরের কাছে ৭০খৃষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, মৃত্যু ১৯ খৃষ্টপূর্বাব্দে । এঁর রচিত ইনিডপ্রাচীনকাল  থেকেই ইতালির জাতীয় মহাকাব্য ।
Ossa : ল্যাটিন শব্দটির অর্থ অস্থি । মিসেস কারেন বলছেন দিনলিপি, হয়তো এই কারণে যে অস্থির মধ্যেই মানবশরীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকে ।
ভাঁড় মে জায়ে : হিন্দি প্রবাদ । উপন্যাসে আছে go to the pot,  এর জুতসই বাংলা অনুবাদ করতে না পেরে হিন্দির সাহায্য নিলাম ।
--------------------------------------------------------------------------------------------
                                                    

                                                                  শেষ





কোন মন্তব্য নেই: