“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১০ জুলাই, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানি: উজান পর্ব ২

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের দ্বিতীয়  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)

 মিদারবাড়িতে কাজ করে দুর্গাবতীর ফুরসত হয় না কোথাও যাওয়ার । কাজেরও তো সময়গময় নেই । দুর্গাবতীর কাজের বিনিময়েই বাসস্থান । পুকুর পারে টিনের ছাউনির বড় বাড়িটা বৈতলকে মনে ধরলেও এক কাঁটা খচখচ করে । মাঝে মাঝে বৈতলের মন বিদ্রোহী হয় । দুর্গাকে বলে,
--- চলো, বারই যাই ইখান থাকি । নদীর চরো উরো যেখানো পারি বাড়ি একটা
বানাই লিমু ।
   স্বামীভক্তিতে দুর্গা কম যায় না । বলে,
--- তোমার মনো দুঃখ থাকলে চলো যাই গিয়া ।
            মনে উপরে, মনের নিচে দুঃখ যে কোথায় নেই । বৈতলের দুঃখ সুন্দরী দুর্গাবতীকে নিয়ে । বৈতলের মনে সর্বক্ষণ হারাই হারাই । তাই খোঁজে । জমি খোঁজে । জমানো টাকা যা আছে তাতে কিছু হয় না । খাস জমি পেতেও ঘুষ দিতে হয় রিফ্যুজি অফিসকে । তবু হতোদ্যম হওয়ার মানুষ নয় বৈতলমধুরামুখে নদীর হাঁটুর উপর জমির টুকরোটুকুও চোখে চোখে রাখে । আর দুর্গাবতীকে শোনায় ভিন্ন কথা । কোনদিন শোনায় বিসি গুপ্ত বাড়ির পাশের জমি । কোনদিন বলে আর্যপট্টির ইড কোম্পানির জমিকথা । বলে,
--- কম্পানি তো উঠি গেছে । কেউ নাই । বউত জমি । চধরি বাড়ির ছোটজনে কইছইন দিবা আমারে একটুকরা ।
--- ইতা মাতো বিশ্বাস করিও না ।
--- না না, তাইন ভালা মানুষ ।
--- আর ভালা মানুষ । কতউত্তো দেখলাম । বিলাইর ভাগো ছিকি ছিড়ে নি ।
 দুর্গাবতীর মতো নিরাশ হওয়ার মানুষ নয় বৈতল । সে তার কল্পরথকে এরপর টেনে নিয়ে যায় রহমানবাড়ির গায়ে । সব শুনে দুর্গাবতী বলে,
--- তুমিও এক ভালা মানুষ । যে যেটা কয় মানিলাও । বড়লোকর পুয়ারে লইয়া যাও কলেজো । তোমার লগে দুই কথা মাতছে, কইছে বাপরে কইব তোমারে জমি দেওয়ার লাগি, আর তুমিও পুবেদি দুয়ার উয়ার লাগাই দিরায় ।
--- তার মন ভালা । যেতা কয় কথা রাখে । পুয়া ইগু কী সুন্দর জানো নি । সবে ছোট নবাব কইয়া ডাকে । তারা বুলে আরবর মানুষ । অউ লম্বা চওড়া, রাজপুত্রর লাখান দেখাত ।
--- মাইনষে যে কইন চন্দনবাড়ির পুয়াইন্ত হকল রাজপুত্র ।
--- রহমান বাড়ির পুয়া ইগুর রঙ দেখলে তোমারও শরীর ঝলসি যাইব ।
--- আইচ্ছা তে, তারার শরীর আর রঙ দিয়া কিতা করতাম । পুড়ির বিয়া দিতাম নি ।
--- তুমি অউত্ত মাতলায় কান্দায় আর কুন্দায় । অখন কও যাইবায় নি আমার লগে ।
--- তুমি দেখি লাও ।
    বৈতল জানে এসব কথার কথা । দুর্গাবতীর না যাওয়ার অজুহাত । তাই গুলতির বাঁটে চামড়ার রশি বাঁধে শক্ত করে । তেল চকচক করে নতুন রবার লাগায় । গুলি ছাড়াই তাক করে জমিদারের মাথা বরাবর । আঁঠালো মাটির গুলি এক আঙুলের টিপেই ঝুরঝুর করে ঝরে যায় হাতে । মেয়েকে আদর করে ডেকে নেয় কাছে । বলে,
--- চল বেটি ।
মন খারাপ হলেই বেরিয়ে পড়ার স্বভাব বৈতলের । নিরিবিলিতে উপভোগ করা । মনের মানুষ সঙ্গে থাকলে বৈতলের সুখ হয় । মা বাপের ঢলানি জিয়ানিতে জেরবার হয়ে কতবার চলে গেছে মিরতিঙ্গার পাহাড়ে । ওখানে পেয়েছে বন্ধু লুলাকে । ওখানেই বৈতলের রাজ্যপাঠ, মাও গেছে তার গাছগাছালি পাখপাখালি আর পাটপাথর দেখতে । এখন মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে নতুন পাটে । নদীর ওপারে দুধপাতিল গ্রাম । গোয়ালারা রোজ দুধ নিয়ে আসে শহরে । ভারি করে রান্নার লাকড়িও নিয়ে আসে গ্রামের কাঠুরে । ভাগা করে হরিণের মাংস নিয়ে আসে কাঠের গুঁড়োয় ভরে । একদিন খাকি হাফ প্যান্ট সার্ট হ্যাট আর বন্দুক কাঁধে একটা লোকও আসে । পেছনে বরুয়া বাঁশের ভিতর চারপা বাঁধা মরা বাঘ ঝুলিয়ে জনা চারেক চা – বাগানের শ্রমিক, কুলি । মরা বাঘের মুখেও মানুষের প্রতি আক্রোশ দেখে বৈতল । সঙ সাজা লোকটা এক চা বাগানের ম্যানেজার, দক্ষ শিকারি । মিরতিঙ্গা, বইয়াখাউরি, পাগলায় টিলা আছে অনেক, কিন্তু ঘন জঙ্গল নেই, তাই বাঘ ভালুকও নেই । একা একা বৈতলেরও হারিয়ে যাওয়ায় কোন বাধা নেই । বৈতলের মেয়েও ভয় পায় না কিছুতে ! বাঘমারা দুর্ধর্শ মানুষটিকে দেখে হাসে মেয়ে । বৈতলও মেয়েকে শেখায় মন্ত্র । বলে,
--- ভয় করলেউ ভয়, নাইলে কিচ্ছু নায় ।
সেই নির্ভীক মেয়েও ভয় পায় । বৈতল মেয়েকে কাঁধে নিয়ে নদীর ওপারে যায় শুকনোর সময় হেঁটেই নদী পারাপার করা যায় । বৈতল দুধপাতিলের জঙ্গলে গুলতি বের করে । দু- দুটো ঢুপি মারে । আধমরা পাখির ছটফটানি দেখে মেয়ের মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েবৈতল মেয়েকে কোলে তুলে নেয় । বলে,
--- কিতা অইল বেটি । ডরাইলে নি ।
 বৈতল বুঝে শিশু মনের প্রতিক্রিয়া । বাঘমারা সাহেবের দিকে তাকিয়ে মেয়ে তার অকারণ হাসে নি । তবু মেয়েকে প্রবোধ দেয় বৈতল । বলে,
--- না মারলে আমরা বাঁচতাম কেমনে কও মাই । তারা মরলে তো আমরা খাইয়া বাঁচতাম । দেখবায় নে তুমার মায়ে কী সোয়াদ করি রান্দইন ঢুপির মাংস ।
এক ছটাক তেল কেনে বৈতল । এই টুকুনি তেল দিয়েই রাঁধে, পাখির মাংস ভালই রাঁধে দুর্গাবতী । পেঁয়াজ রসুন ছাড়াই রাঁধে । দুর্গাবতীকে অনেক বলেও পাখির রাজা মুরগি ঢোকাতে পারে নি রান্নাঘরে । বৈতল যুক্তি দিয়ে বলে,
--- মুরগিও তো ঢুপির মতো হাসর মতো পাখি । রান্দ না কেনে ।
--- কী জানি, ইতা অই গেছে । হিন্দুবাড়িত আরো বউত্তা খায় না । গজার মাছ পারবায়নি খাইতে, বাঘ মাছ । দুখুদায় যেতা খায় ।
--- আমি ইতা খাই ।
--- তুমার কথা বাদ দেও । তুমি তো আধা বাঙাল ।
--- ওগো মাই, খাওয়াইছো ভালা । রান্দছ ভালা অখন ইতা মাতিয়া আমারে ছলাইও না কই দিলাম ।
 দুর্গার উপর বৈতলের রাগ যেমন হয় যখন তখন, ভালও বাসে পাগলের মতো । বৈতল জানে স্বদেশ ছেড়ে এই অজানা শহরে না এলে এমন ভালবাসাও শিখত না সে । বৈতল বুঝতে পারে নতুন এক শিকর ছড়াচ্ছে তার । তাই নতুনের কথায় গুরু সৃষ্টিধরের শরণ নেয় বৈতল । গুরু বলেন,
--- নতুন অইলেউ রেবা পুরানার ডাক পড়ে । পুরানা অইল আসল জড় । যে ভুলি যায় তার হক্কলতাউ যায় ।


চলবে

 < উজান পর্ব ১ পড়ুন                                                    উজান পর্ব ৩ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: