“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সর্বহারাদের কথা

।।শৈলেন দাস।।
(১)
বাড়িটা বিক্রি হয়নি তখন তাই ফিরতে পেরেছে যতীন। হাওর অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে সাতপুরুষের ভিটে বলতে বিস্তৃত টিলার এক কোণে ছোট কুঁড়েঘর,  কয়েকটি আম জামের গাছ সহ চারপাশে ঝোপ জঙ্গল। পরিবারের লোকজন ও কিছু গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে সে ছিল এক সুখের নীড়। তবে এখন সে একাই এসেছে রাতের আঁধারে, পালিয়ে। স্ত্রীপুত্র কেউ সাথে নেই।
মানব সৃষ্ট দূষণের যন্ত্রণায় রুষ্ট হয়ে মাতৃসমা হাওর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় দেনার দায়ে পড়তে হয়েছিল যতীনকে। সুযোগ বুঝে সুদখোর মহাজন চাষের জমির জবরদখল নেয়, বাড়িটার প্রতি আগ্রহ দেখায়নি নিষ্ফলা বলে। রোজগারের অন্যকোন উপায় ছিলনা তাই পরিবার প্রতিপালনের জন্য সে চলে এসেছিল শহরে। শূন্য হাতে সহায় সম্বলহীন যতীন ঘর বেঁধেছিল শহরতলীর এক পরিত্যক্ত জলাভূমিতে।
বিশ্বায়নের ছোঁয়া লেগে শহরের শরীর বাড়ন্ত, তার সাথে ক্রমশ বিত্তশালী হয়ে উঠা শহরের আদি বাসিন্দারা যতীনদের মত সর্বহারাদের তখন আপন করে না নিলেও শহরে তাদের উপস্থিতিকে মেনে নিয়েছিল ক্রমবর্ধমান শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করবে বলে। মাথা গুঁজার ঠাঁই যেমন পেয়েছিল যতীন তেমনি রুজি রোজগারের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল সহজে। যদিও আর্থিক সচ্ছলতা কখনো আসেনি যতীনের জীবনে, তবে না খেয়ে থাকতে হবে এই ভয় আর তাড়া করেনি তাকে। তাই সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর রাতে অঘোরে ঘুমানোর বদ অভ্যাস পেয়ে বসে তাকে। কিন্তু শীতের কোন এক সকালে প্রতিবেশী যুবকের আর্ত চিৎকারে তার অন্তরাত্মা জেগে উঠতে কার্পণ্য করেনি বলে পুলিশ আজ তাকে খুঁজছে।
শৈরাচারীদের অত্যাচারে জর্জরিত হত দরিদ্র জনগণের 'মারের বদলে মার' মনোভাবের প্রতি শহরবাসী সাধারণ জনগণের সায় থাকলেও এককালে বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধরাও বিপ্লব আখ্যা দেয়নি বলে যতীনকে পালাতে হয়েছে ভয়ে। সহজসরল গ্রাম্য জীবন যাপনে অভ্যস্থ যতীন স্বল্প মেয়াদের এই শহুরে জীবনকালে দেখেছে ধর্মীয় উন্মাদনার সাথে রাজনীতির সংমিশ্রণ, মিটিঙে মিছিলে গিয়ে শুনেছে অনেক বিপ্লবীর কথা। সর্বহারাদের মুক্তির আশায় যে মানুষগুলি সবার সমান অধিকারের নীতি অনুসরণ করার বুলি আওড়েছে পথেঘাটে, তারাই মেকি ভদ্র সেজে পথে নেমেছে যতীনদের দুষ্কৃতি আখ্যায়িত করতে অথচ শৈরাচারীর বিরুদ্ধে টুঁশব্দটি নেই!
দুদিন থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আজও দুপুর গড়িয়েছে অনেকটা। বাড়ির পূব দিকে বড় হিজল গাছের ছায়ায় বসে হাওরের দিকে চেয়ে আছে যতীন। কোঁচড়ে গামছার এক মাথায় কয়েক মুটো মুড়ি, যা একটু আগে দিয়ে গেছেন পাশের গ্রামের শুক্কুর চাচা। দুপুরে হাওরে গরু চড়াতে এসেই যতীনকে দেখতে পেয়ে এসেছিলেন। জানিয়ে গেছেন, বাজারের লোকজন নাকি বলাবলি করছে কি সব গণ্ডগোলের জন্য পুলিশ শহরতলী ঘিরে রেখেছে। রেডিওতেও খবর দিয়েছে কোন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে হামলা করে দুষ্কৃতিরা নাকি সবাই পালিয়েছে; বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে নাকি গোটা শহর উত্তাল। যতীন যেন কিছুদিন শহরে না যায়।
(২)
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে শহরতলীর নিজের বাড়িতে শেষবার গিয়েছিল সতীশ। গণ্ডগোলের তিন চার দিন পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নজর এড়িয়ে গোপনে সেখানে যেতে হয়েছিল তাকে। আতঙ্কময় পরিবেশে অনাহারে অর্ধাহারে নারী শিশুর দিন গুজরানো দেখে সেদিন নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছিল তার। স্বজনদের এই দুর্দিন  মেনে নিতে পারছিলনা সে, বিশেষ করে যতীনের দুই বছর বয়সী শিশুপুত্রের করুণ মুখ এখনও চোখে ভাসছে। ভদ্রলোকের বাড়িতে গরীবেরা ঢিল ছুড়েছে তাই রুষ্ট হয়েছে সুশীল সমাজ, এমন পরিস্থিতে কাকে বুঝাবে সে- যা রটেছে তা যে আদৌ ঘটেনি, শহরতলীর সর্বহারারা দুষ্কৃতি নয়। সতীশ লক্ষ্য করেছে পরিচিতজনেরাও এই কয়দিন যোগাযোগ করেনি, কি জানি তাকেও দুষ্কৃতি ভেবে বসে আছে কিনা! না, স্পষ্টীকরণ একটা দেওয়া দরকার। তাই চিঠি লিখেছে সে সবকয়টি সংবাদপত্রের পাঠকের মতামত বিভাগে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়নি তার চিঠিটি।
কিছুটা হতাশ এবং বিমর্ষতা নিয়ে শহরের ব্যস্ততম রাজপথে যানজটে আটকা পড়ে সতীশ যখন এসব কথাই ভাবছিল ঠিক তখনই মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল। কোন মতে বাইকটি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে মোবাইল হাতে নিতেই স্ক্রীনে ভেসে উঠল মধু'দির নাম। ছোট একটি সাহিত্য পত্রিকা করে মধু'দি, সতীশ এর মত নতুনদের উৎসাহ দিতে মধু'দির এই প্রয়াস। বোতাম টিপে ফোন কানে ধরতেই মধুদি বললেন 'সতীশ, পিসি কথা বলতে চায় তোমার সাথে।' খরায় শুকিয়ে খাট হয়ে যাওয়া কৃষি জমিতে যেন ঝরঝর করে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল কয়েকটি। চরম হতাশার সময়ে আশার আলো খুঁজে পেল সতীশ। বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠার আগেই পিসির কণ্ঠস্বর - 'তুই কোথায় আছিস সতীশ? এতকিছু হয়ে গেল আমাকে একবারও বললি না? একদম মন ছোট করবি না, তুই এখনই আমার কাছে আয়।' লেখালেখির জগতে তার কলম যেমন অনন্য তেমনি সবাইকে ধরে রাখার অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব পিসি সাহিত্যজগতে সতীশদের অভিভাবক। ঘটনার আকস্মিকতা এবং সংকোচের কারণে সে ভুলেই গিয়েছিল পিসির কথা। সতীশের চিঠি দৈনিক পত্রিকাগুলির একটিও ছাপেনি, ছেপেছিল নিতু'দির সাপ্তাহিক 'নতুন দিশা'তে এবং এর ফলেই এক সপ্তাহ পরে পিসি জানতে পেরেছে সতীশরা ভাল নেই।
(৩)
এক মাস কেটে গেছে শহরতলীতে আর পুলিশ আসেনি। যতীনও ফিরে এসে আগের মতই লেগে গেছে রুজিরোজগারে। পিসির এক চিঠিতেই কাজ হয়েছে, মানবাধিকার কর্মীদেরও ঘুম ভেঙ্গেছে ততক্ষণে। সতীশ তার লেখালেখির বিষয়বস্ত তথা ধরণ পাল্টে ফেলেছে, পরিস্থিতির কারণে অনেক পরিণত হয়ে গেছে সে। নিজেই লিখতে শুরু করেছে যতীনের মত সর্বহারাদের কথা।

কোন মন্তব্য নেই: