“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ৩০

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  ত্রিশ     ---সুব্রতা 
মজুমদার।)  




ত্রিশ 

    বাড়ি ফিরে দুর্গাবতীকে না পেয়ে আবার অধৈর্য হয় বৈতল । ভুলে যায় মেয়েকে দেওয়া কথা । দুর্গাবতীর সঙ্গে ঝগড়া না করার, দুর্গাবতীকে কষ্ট না দেওয়ার শপথ কথা । ভোলার বাড়ি, কেতুমামার বাড়ি, পুনামাসীর বাড়ি গেলে কোনও কথা নয়, দুর্গাবতীর এখন সর্বক্ষণের ঠাঁই ওই দালানবাড়িদুর্গাবতী যতক্ষণ যমুনাপ্রসাদ ততক্ষণ । জানিগঞ্জে একটা অফিস আছে কাছারি রোডে আর এক অফিস, এখন কোথাও যায় না, কাছারিঘরকেই অফিস করেছে । আর দুর্গাবতীও ঘনঘন চা করে দেয়, নিয়ে যায় বন্ধ ঘরের দরজা খুলে । ঘরে তুলসীতলায় সন্ধ্যাবাতি দেওয়ার কথাও ভুলে যায় দুর্গাবতী । চেঁচিয়ে দুর্গাবতীকে ডাকে বৈতল । কোনও জবাব আসে না । মেয়েটার খাওয়ার সময় এখন, কে খাওয়াবে । মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রেখে যায় ইটখোলার মোড়ে, কিনে আনে এক কৌটো মুড়ি আর ভাইয়াজির দোকান থেকে পেঁয়াজি দুটো, লাল তুলোর মতো হাওয়াই মিঠাই কেনে কাঠিতে জড়ানো । ততক্ষণে দুর্গাবতী দিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে এসেছে । বৈতল কাঠি মিঠাই মেয়ের হাতে দেয় । মুড়ি পেঁয়াজি ফেলে বিছানায় । রাগ দেখিয়ে একটা খায়, এক মুঠো মুড়িও খায় । বৈতল রাগলে পারতপক্ষে রা কাড়ে না দুর্গাবতী । চুপ করে থাকে । বৈতল বলে,
--- অউ কই দিলাম, আমি আর ফিরতাম নায় ইবাড়িত ।
   দুর্গাবতী শোনে । দুর্গাবতী হাবভাব দেখে বোঝে মতলব । দুর্গাবতী জানে আজ তার মানুষ যাবে নাগাপট্টি মদ খাবে, দুর্গাবতী ভুলতে যাবে মধুবালার ঘরে । বৈতল ধরা পড়ে যায়, দুর্গাবতীর কাছে কিছুতেই নিজেকে লুকোতে পারে না । তাই রাগের গম্ভীর মুখ থেকে ফিক করে হাসি বেরিয়ে যায় । হাসতে হাসতে রাগের মুখ করে । আবার হাসে । সাজানো রিক্সা পক্ষীরাজের প্যাডেলে পা দিয়ে আবার হাসে । দুর্গার উপর রাগ করে দুর্গার পয়সায়ই মাল খাবে আজ । ছিকিতে জমানো দুর্গাবতীর সঞ্চয় সরিয়ে রেখেছে আধুলি সিকি । বৈতল আবার হাসে, আবার গান গায়, মধুবালার কাছে যেদিন যায় বৈতল, তার প্রস্তুতি থাকে সকাল থেকেই । দুর্গাবতীতে মন মজে থাকলে ওর আর কোথাও যাওয়া হয় না । তাই অকারণ দুর্গার সঙ্গে একটা লড়াই বাঁধিয়ে নেয় । রিক্সার ঘণ্টিতে কিরিং কিরিং বাজায় ধীরে, প্যাডেলে পা রেখে টাল ঠোকে, গান গায়,
রূপ দিয়া রূপ ধরতে গেলে রূপের পানে চাও
বদরপুরের নিকটে রূপসীবাড়িতে যাও ।
   দুর্গাবতীতে একঘেয়েমি কাটাতে বৈতল যায় চৌদ্দ নম্বর । মধুবালার গলির নামকে কেন যে মানুষ ও নামে ডাকে বৈতল জানে না । বৈতল সেদিন গাঁজার আসরে, চোখের রঙে রঙে চড়িয়ে বন্ধু বছইকে প্রশ্ন করে,
--- কেনে বে । চৌদ্দ নম্বর কেনে ।
বছই হাসতে হাসতে বৈতলকথা দেয় আপদকে । বলে,
--- কেনে বে ।
আপদও গাঁজার কল্‌কে দেওয়ার মতো বৈতলের প্রশ্ন দেয় নেশাহীন দুখুমিয়ার কাছে । দুখুমিয়া হাসে মধুর মধুর ।
মধুর ঘর ।
  প্রেমতলা পেরিয়ে চৈতন্য প্রেসে সওয়ারি নামিয়ে দেয় বৈতল । বরদা কলোনির অন্ধকারে নামিয়ে নেয় পক্ষীরাজ, বাঁদিকে কিছুদূর গিয়ে পানুর কাছে জিম্মা রাখে রিক্সা । পানুর ঘুগনির বাঁধা খদ্দের বৈতল, তাই চেনা জানা ।
মধুর ঘরে ঢুকেই গালাগাল দেয় বৈতল । বলে,
--- শালি ।
বলে,
--- রাণ্ডি ।
   মনের দুঃখে গালাগাল করতে ভাল লাগে । মাগনা তো না, পয়সা দিয়ে গালি দিচ্ছে বৈতল । মধুবালার টিনের ঘরে আজকাল দেবানন্দের এক মস্ত পোস্টার লাগিয়েছে, হাতে মদের বোতল । ছবিটা দেখলেই বৈতলের রাগ ধরে, মনে হয় বৈতল আসার আগেই বাবু ঢুকিয়ে বসে আছে । মধুর ঘরে মদ খেয়ে রাগ কমেনেশার পেটে ভাললাগা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে । একশবার বলা কথা আবার বলে,
--- তর আসল নাম কিন্তু অখনও কইলে না মধু ।
  মধুবালা মিটিমিটি হাসে । বলে,
--- আমার আসল নাম মীনাকুমারী ।
--- আইচ্ছা গো মিনু, একটা মামলেট ভাজিয়া দিবায় নি ।
    দেশি মদের সঙ্গে এসব চাটের আব্দার করে বৈতল । মধুবালাও জানে আজ রিক্সাওয়ালার পকেটে মাল আছে । দুর্গাবতীর চিকির ভাণ্ডার চুরি করে এনেছে যে । মধুকে বলে,
--- তুই একটা খাইতে না । খা ।
   আসলে শরীর মন সবই যখন বিবশ থাকে দুর্গাবতীর অদেখা উপেক্ষায় বৈতল অবলম্বন খোঁজে । দুর্গার পয়সায় দুর্গার উপর অভিমানের ঝাল মেটায় বৈতল নাগাপট্টির বেশ্যালয়ে । এতেই মনে ফুর্তি হয় । মধুবালাকে বিচারক করে গল্প জমায় বৈতল । বলে,
--- বাপ অইলে নাচত পারে না নি ক ।
   বৈতল জানে মধুবালা জানে না কিছু অগ্রপশ্চাৎ । জানে না বৈতলের গুরমি নাচ নিয়ে দুর্গাবতীর কটাক্ষকথা । জানে না বারবার তার পৌরুষ নিয়ে সন্দেহ, জানে না এক লম্পট ধনীর সঙ্গে তার তুলনা । তুলনায় নামিয়ে আনা নিচে । তবু মধুবালার সমর্থন চাই তার । মধুও প্রতিসংলাপে জড়ায় নিজেকে । বলে,
--- কেনে পারত না ।
--- গাইত পারে না, ক ।
--- পারত না কেনে ।
--- আমি নাচি, গান গাই মনসামঙ্গল । কয় বাপ অইলে বুলে কেউ নাচে না ইলাখান ।
--- কে কয় ।
--- কে কয় জানিয়া তর কিতা রে শালি ।
    ঝনঝনাৎ টাকা দিয়ে বৈতল বেরিয়ে আসে মধুবালার ঘর থেকে । এত বড় সাহস তার দুর্গাবতীকে নিয়ে প্রশ্ন করে । বৈতল চড়ে বসে তার রথে । আবার গালাগালি দেয় আপন মনে একা একা । বলে,
--- রেণ্ডিবেটিয়ে ভাবছে কিতা । ঘরর বৌর কথা আমি কইমু তাইর কাছে । হালির ঘরর হালি ।
    শীতের শহর দশটা বাজতেই কাত । যেদিকে ঢুকেছিল সেদিকে বেরোয় না বৈতল । সোজা পানপট্টি দিয়ে গোলদিঘীর পার । নয়আনি দোকান সব বন্ধ । অন্য সব ব্যবসায়ীরা বাড়ি ফিরছে পায়ে হেঁটে । রিক্সাওয়ালাকে পয়সা দেবে না দুআনা । নয়আনি দোকান বন্ধ হলেও গোলদিঘীর পার জমজমাট । নট্ট কোম্পানির যাত্রা হচ্ছে সোনাইদিঘী । ভাবনা কাজির হাসিতে ফেটে পড়েছে আসর । যাত্রা দেখতে ভাল লাগে বৈতলের । পৃথক মহিলাসন থাকলেও বাড়ির বৌ ঝিরা মাঠে বসে যাত্রা দেখে না । যাত্রা দেখা পছন্দও করে না মেয়েরা । দুর্গাবতীও বলে,
--- যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে ।
   ওরিয়েন্টেল সিনেমা হল সেকেণ্ড শো চলছে নাগিন । বৈতলের প্যাডেল ঘোরে দ্রুত । কলাবতী পেরিয়ে চিনা জুতোর দোকানিদেরও ঝাঁপ বন্ধ । কলাবতীতে চলছে রঞ্জনের হিন্দি সিনেমা সোর্ড ফাইটারজ্যোৎস্না চন্দর বাড়ির সামনে ভিড় কয়েকজনের । নির্বাচনের পোস্টার লেখা হচ্ছে । জোয়াল কাঁধে জোড়া বলদ, কংগ্রেসের প্রতীক । ইস্টবেঙ্গল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আর পালোয়ানের দোকানেও নেই আগামীকালের প্রস্তুতি । পালোয়ানের নাম জানে না কেউ, লাল লেংটি পরে যে পালোয়ান মুগুর ভাঁজতে যায় ভোরের সাপনালায় তাকেই চেনে চাওলা হিসেবে । চায়ের সঙ্গে থাকে ময়দার বিহারি মিস্টি । গীতশ্রীতে নীলাচলে মহাপ্রভুর পোস্টার খুলছে দুজন কর্মচারি । চা বাগানের সাহেবদের আজ ক্লাব দিন । সিনেমা হচ্চে কাছাড় ক্লাবের দোতালায় । রাস্তা থেকে দেখা যায় ইংলিশ সিনেমার নড়াচড়া । সব সাদা কালো রং । আজ কোন চিনা প্যাসেঞ্জার নেই । ইটখোলা ঈদগার সামনে আসতেই আঁধার ফুঁড়ে উদয় হয় দুখুর ধপ করে উঠে বসে রিক্সায় । বলে,
--- মাতিস না জলদি চালা । রায়ট লাগি গেছে বেটা ।
--- কিতা কছ ।
--- গিলানি সায়েবরে চাক্কু মারছেমধুর বন্দো ।
--- গিলানি সাহেব কে জানে না বৈতল । তবে আতঙ্ক একটা জানে । নাগাপট্টি থেকে ফিরতে ফিরতে নেশা কেটে গেছে তার । শহর জুড়ে এক অবিশ্বাসের তোলপাড় শুরু হবে । বৈতলের জীবনে এই প্রথম শহুরে দাঙ্গার অভিজ্ঞতা । গ্রামে এসব নেই । আল্লা হো আকবর আর রামদা নিয়ে লম্ফঝম্ফ শেষ হয় রায়টে । পালোয়ানের দোকানের সব কাজকর্ম কেমন নীরবে হচ্চে আজ । অন্য রাতে বিহারি গানের জলসায় জমজমাট থাকে । বৈতলও একবার প্যাডেল পা রেখে থামে, চিৎকার করে যায় রামা হৈ । পরিচিতি পরিবেশ অন্যরকম হওয়ায় তখনই পেটে মোচড় দেয় বৈতলের । একটু গা ছম ছম । গুডলাক আর শিলং টেলার্স-এর দোকানেও আড্ডা নেই, ঝাঁপ বন্ধ । উল্টোদিকে সুনসান গীতশ্রী সিনেমার পাশে একা গোবর্দ্ধন পাল তার ভুষিমাল দোকানের ভিতর ঢোকাচ্ছে আপনমনে । এই একটা লোকই আছে শহরে যার কোনও হেলদোল নেই, দাঙ্গা হল না ভূমিকম্প হল, কিছু যায় আসে না । ভুষিমালের জঞ্জালে বসে হাসি মুখে চাল ডাল তেল নুন বিক্রি করে যায়, কেউ মাল নিয়ে পয়সা না দিয়ে চলে গেলেও কিছু বলে না । বৈতল জানে গোবর্দ্ধনদাকে বলে কিছু হবে না । তবু বলে,
--- কিতা অইছে বা গুবরধনদা ।
--- কিতার কিতা অইত, অখন কিচ্ছু পাইতায় নায় । দুকান বন্ধ করি দিছি । জ্বালাইও না যাও ।
--- এক ছটাক হইরর তেল দিলাও রেবা ।
   বৈতলের মনে পড়ে সিটের নিচে রাখা তেলের শিশির কথা । দড়ি বাঁধা শিশিটা দেখে কী জানি ভাবে গোবর্দ্ধন । তেল দেয় । বলে,
--- অখন যাও । পয়সা পরে দিও, অবস্থা ভালা নায় ।
   তখনই বুঝেছে কিছু একটা ঘটেছে । পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্থানে এসেও যে একই আতান্তর, বৈতলের রাগ হয় । রাগ হয় নিজের উপর, রাগ বন্ধু দুখু মিয়ার উপর । রিক্সা থামিয়ে দেয় । ইদগার গায়ে নালার এপারে ডুমুর গাছের নিচে রিক্সা থামায় । কিছু বলতেও পারে না । অসহায় আক্রোশে ভাবে দুখুকে ফেলে দেয় নালার জলে, রিক্সাসহ ফেলে দিলে কেউ কিছু বুঝবে না । এক গিলানির সঙ্গে আর এক মিয়া কমবে । বৈতল কিছু করার আগেই তার ঘাড়ের উপর এসে পড়ে আঘাত ।
   দুখু বৈতলের রিক্সা থেমে যাওয়ার কারণ বোঝে না তাই বৈতলের ঘাড়ে দেয় ধাক্কা । বলে,
--- অই বেটা, বাঁচতে চাইলে চালা, থামলে কেনে ।
--- চলত নায় । আমার রিক্সা আর যাইত নায় ।
--- কেনে বে মরা, মরবে নু ।
   বৈতল অন্ধকারে সিটের উপর রাখা কোমর ঘুরিয়ে দুখুকে দেখার চেষ্টা করে । দুখুর উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করে । এই লোকটাই কি তার একমাত্র বন্ধু এই দেশে যে তার ধর্ম পরিবর্তনের ইচ্ছায় বাধা দেয় প্রবলভাবে । বলে,
--- তর মুসলমান হওন লাগত নায় ।
   সেই লোকটাই কি এখন রাতের অন্ধকারে অমুসলমান বলে তাকে খুন করতে চাইছে । চাক্কু মারবে তাকে । জাতভাই এর মৃত্যুর বদলা নেবে ছুরি মেরে । বৈতলের রাগ অভিমানে পাল্টায় । আর তখনই হয় অসহায় । ডাকে তার গুরুকে । গুরু সৃষ্টিধর বৈতলকে রক্ষা করেন সব অসহায়তা থেকে । গুরু জানেন বৈতলের নাকের ডগায় রাগ । তাই বারবার বলেন,
--- তুমার গুসা কমানি লাগব । আর কথায় কথায় হিন্দু বাঙাল হিন্দু বাঙাল করিও না । মানুষ মানুষ অউ হয়, মাটি আর পানিয়ে বানায় মানুষ । পঞ্চভূতে বানায় শরীর, হিন্দুর ও মুসলমানরও । এক এক জাগার মানুষ এক এক রকম । এর লাগি উ তুর্কি সাধু শাহজালালে তান দেশ এমেনর মাটির মিল পাইছলা ছিলেটো । ছিলেটি মানুষর মন বড় নরম রেবা একেবারে তুলতুলা মাটির দলা । হিন্দু অউ কও মুসলমান অউ কও তুমার লাগি জান দিব, খাওয়াইব, পিন্দাইব, আদর করব । কিন্তু উস্কাই দিলে কিতা করবায়, একলা বাঙাল খুব ভালা, দল বান্দিয়া আইলে কিতা করবায় । রায়ট উয়ট লাগলে আর মানুষ মানুষ থাকে না । আবার রায়ট লাগলে মানুষর পরিচয়ও পাওয়া যায় । অউ যে কইলাম জান দিয়া প্রাণ বাঁচায় ।
    বৈতল গুরুর কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না । যতই দোস্তি করুক, বড় কট্টর মুসলমান দুখু । বৈতল দুখুর কথায় তাই প্যাডেল ঘোরায় না । বলে,
--- তোর ঘনিয়ালাত গেলে যখন মারবেউ, অখন অউ মারি লা ।
--- অই হালার হালা, জবাই হওয়ার সময় হইবে, অখন ভাগ ।
--- কই ভাগতাম ।
--- তোর যেবায় ইচ্ছা । ইটখলাত তোর বাড়িত গিয়া ঢুক ।
--- আর তুই । তুই কিতা আমার লাগি আইচছনি ।
--- দুখুর লাগি ভাবিছ না । আমারে মারনেওলা অখনও পয়দা অইছে না । ইলা কত রায়ট দেখলাম । তুইন লতুন আইচছ । বুঝতে নায় ।
--- কিতা বুঝতাম নায় ।
--- পাকিস্তান থাকি আইচছ ভাবরে হিন্দুস্থান, শ্বশুরবাড়ি সরগোপুরি । অখন দেখবে নে সব অউ এক হুরইন বাড়ি ।
--- তুই অউত্ত বেটা ঝাণ্ডা উঠাছ চান্দ তারাআল্লাউ আকবর করছ । পাকিস্তান জিন্দাবাদ করছ ।
--- পাকিস্তানো গেলে ভালা হইব-এর লাগি করি ।
--- কিচ্ছু অইত নায় । হরু মানু কুনু দিন বর অইত নায়, বেশি অইলে তেলি অইব পাল, নাপিত দারোগা অইব, দেখাইব বাল । তুমার কিতা হালার হালা, গোবর্দ্ধন পাল । তুই অইবে ইমাম ।
--- অখন ইতা বাবনাকি মাত মাতার সময় নায় । আপনে বাচলে বাপর নাম ।
--- কিওর নাম । বাপও নাই কেউ নাই । সেন্টেল রোডে শিলং টেইলার আর গুডলাক বন্ধ দেখিয়াউ বুঝি লাইছি । অখন থাকবা লেংটা ।
   বৈতলের শেষ কথাটা দুখুর বোধগম্য হয় না । রায়ট লাগলে ন্যাংটা থাকবে কেন । কে থাকবেদুখুকে রহস্যে রেখে বৈতল আবার বলে,
--- থাকবা না খাইয়া ।
--- কিতা মাতছ বেটা, পাগল উগল অই গেলে নি ।
   পাগল হয়নি বৈতল । নিজের সঙ্গে লড়ছে সে । ভাবছে দেশ তো ভাগ হয়ে গেছে, হিন্দুস্তান টুকরো হয়েছে, পাকিস্তান হয়েছে । দুই ধর্মের লড়াই কেন থামে না তবে । গুদলাক আর শিলং টেলার্স শহরের দুই নামকরা দরজির দোকান । সব কর্মচারী এবং মালিক মুসলমান, ওদের যদি এখন এই দাঙ্গায় উৎখাত হতে হয় তাহলে বাহারি কাপড় সেলাই করে দেবে কে । বাবুরা কি ন্যাংটো থাকবে । শহরের কশাই বলতে বেচুদা, দশাসই পাঠান মানুষটা ডালায় করে কাটা মাংস পৌঁছে দেয় বাড়ি বাড়ি । নির্বিরোধী মানুষটাও মুসলমান । বেচুদা চলে গেলে বাবুরা কী খাবে । পাটনাই খাসির মাংস আর কে বেচবে । কী জানি, হয়তো কিছুই কারো জন্য আটকে থাকে না । কিন্তু একটা ছন্দপতন তো হয়, ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে । নতুন করে আরম্ভ হয় । বইয়াখাউরিতেও তার বাপের মতো মাছুয়া দুজন নেই, বাপের বেটা বৈতলও তো কম কেরামতি দেখায় নি সুনামগঞ্জের হাওর জলে । ভাটির দেশের সম্পদ রক্ষা করেছে, গোটা জেলায় মাছ সরবরাহ করেছে বৈতলের মতো কৈবর্ত সমাজ, মাইমলেরা । এখন যে পালিয়ে চলে এল নতুন দেশে, ওদেশের ভাটির জল কি থেমে থেকেছে । বৈতলকে ডেকেছে, তুমি ছাড়া চলছে না চলে এসো । দেশভাগের সময় এবং তারও পরে বৈতল দেখেছে মানুষের দুর্দশা । তবে দেশভাগ গরীব মানুষকে যত না দুর্দশায় ফেলেছে, বাবুরাও কম কষ্ট করেনি । গরিবের কিবা দেশ, কিবা বিদেশ । খাটতে খাটতে খাও, খাটনি নেই তো চলে যাও । বাবুরা থাকে নিশ্চিন্তে, যা-ই করুক তাদের একটা স্থায়ী আয়ের উৎস থাকে । ধর্মের দেশভাগ বাবু মানুষকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেয়নি । ঘর বাড়ি পুড়েছে দাউ দাউ, গুজবের আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে । তাও ওরা বুদ্ধিমান, তাই ঘরবাড়ি বেচে বদলাবদলি করে চলে এসেছে নিজ নিজ পিতৃভূমিতে । এসেছে কাছাড়ে, ত্রিপুরায়, আসামে । সিলেটি মানুষ পশ্চিমবঙ্গে গেছে কম । চাষাভুষো কৈবর্তদের এত বুদ্ধি নেই, ওরা ঝগড়াঝাটি মারামারি করেছে, ভিটে ছাড়েনি । শহরের মানুষের উস্কানিতে বেদম মার খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে শূন্য হাতে । খেতের জমি কিংবা হাওরের জল ওরা বদলাবদলি করতে পারেনি সবাই । এখানে এসে দেখেছে অন্যরূপ, এখানে শহরের হিন্দু মসলমান আলাদা আলাদা থাকে আর ফুসফাস করে । নিজের এলাকায় নিশ্চিন্ত থেকে উস্কানি দেয়, মন্দিরের দরজায় গরুর গোস্ত ফেলে দেয়, মসজিদের সামনে শুওরের মাংস । দূর থেকে বলে নারদ নারদ । বৈতল নিজেও কেমন সুরক্ষিত, হরিৎবরণ জমিদার বাড়ির দুর্গে স্ত্রী কন্যাসহ সে সুরক্ষিত । তাই, রিক্সা থামিয়ে নিজের সঙ্গে লড়াই করার কথা ভাবতে পারে । আর ইদ্‌গা এত বড় হলে কী হবে, চারপাশের সব বসতি হিন্দুর । ঘনিয়ালা হলে আর এতক্ষণ ভাবার সময় পাবে না, কল্লা উড়ে যাবে । নিজের কথা ভাবতে ভাবতে বৈতল দুখুকে নিয়ে উতলা হয় । কী করবে এখন এই একরোখা বাঙালকে নিয়ে । দুখুর মতো বিপরীত বুদ্ধির মানুষ তো দুটো হয় না । নিজেকে বিপন্ন করে এখন সে বৈতলকে রক্ষা করবে । বৈতল মুহূর্তেই সম্বিত ফিরে পায়, রিক্সার সিটে কোমর ঘুরিয়ে বলে,
--- অয় পাগল অই গেছলাম, অখন চল ।
   বৈতলের এখন বড় দায়িত্ব বন্ধুকে রক্ষা করা । দুখুকে ইটখোলা, হরিৎবরণ পার করে দেওয়া । তারপর সে যা পারে করুক, পাকিস্তান জিন্দাবাদের জিগির তুলুক না হয় পাকিস্তানেই চলে যাক চাঁদ তারা নিয়ে, বৈতলের কী । মুসলমান হলেই কেন পাকিস্তানপন্থী হয় বুঝতে পারে না বৈতল ওদেশে থাকতে দেখেছে হিন্দুদের দুরবস্থা শেষ সময়, হিন্দু মানেই ইণ্ডিয়ার গুপ্তচর । দুই বাংলা এক করার চক্রান্তকারী । পাকিস্তানে হিন্দু অবিশ্বাস এখনও মারাত্মক আকারে রয়েছে । ওখানে সবাই পাকিস্তানি আর হিন্দুরা বাঙালি । মুসলমান বাঙাল । বৈতলের গুরু সৃষ্টিধর বলেন বিবর্তনের কথা, ধর্মান্তরের কথা । বলেন বাংলাদেশে তখন বৌদ্ধধর্মের রমরমা, বৌদ্ধরা মাথা মুড়িয়ে ন্যাড়া হয়ে থাকে । মুসলমান বিজয়ের পর বৌদ্ধদের হলো ধর্মান্তর । ন্যাড়া থেকে নেড়া, নেড়া থেকে লেড়ো । নতুন মুসলমান হলো বাংলায় । এই সিলেটেও বাঙালি হিন্দুরা মুসলমান হয়ে হয়ে যায় বাঙাল । গুরু মজা করে বৈতলকে বলেন,
--- তারা অইগেলা বাঙ্গাল আমরা বাঙালি । তারা পুংলিঙ্গ আমরা স্ত্রীলিঙ্গ ।
   গুরু নিজেই বলতেন তাঁর শিক্ষাদীক্ষা কম । সব পার্টির কমরেডদের কাছ থেকে শোনা কথা । দেশে এখন হয়েছে নতুন উৎপাত, অশিক্ষিত গ্রাম্য বা বস্তিবাসী মুসলমানদের বোঝানো হচ্ছে ওরা ভুল করে ইণ্ডিয়ার বাসিন্দা হয়ে গেছে । সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট হাইলাকান্দি লালা কাটলিছড়া বদরপুরে পাকিস্তানের পতাকা উঠেছে । তারপর ত্রিপুরাকে ছিটমহল হওয়া থেকে বাঁচাতে নতুন করে সীমানা নির্ধারণ করা হয় অদলবদল করে । পাকিস্তান হয়ে-যাওয়া ভূখণ্ড আবার ভারত হয় । তাই মনের দুঃখে চক্রান্তের কথা বলে । ভুল স্বপ্ন দেখায় স্বদেশ পাকিস্তান ফিরে পাওয়ার, তাই পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে চাঁদ তারার পতাকা ওড়ে কোথাও কোথাও । গরমাগরমির তো সবে গুরু, গিলানি সাহেবকে চাকু মারার উত্তেজনা চলবে কিছুদিন, দুদশজন মরবে, কারফ্যু হবে । তবে শান্তি । হরিৎবরণের নিশ্চিন্ত হিন্দু এলাকায় এখানে ওখানে জটলা, নিরীহ মানুষ সংগঠিত হচ্ছে । সন্দেহের চোখে দেখেছে বৈতলের রিক্সা, চেনা মানুষ বলে থেমে যাওয়া সংলাপ আবার শুরু করে । বলে,
--- মরত নায় । গিলানি মরত নায় । কাঠুয়ার পরাণ ইতার মরে না ।
বৈতল দুখুকে নির্দেশ দেয় । বলে,
--- চুপ মারি বই থাক । নামিছ না । আমি তরে দিয়া আইমু ।
   দুখু লাফ মেরে নামতে চায়, বৈতল পিছন ঘুরে মারে এক থাপ্পড় বেঁটে গাট্টা মানুষটাকে । বৈতলও পক্ষীরাজ ছোটায় ঘনিয়ালার দিকে । ঘনিয়ালায় ঢুকতেই জিগির ওঠে নারায়ে তকবির’ ‘আল্লা হো আকবরমিলিত কণ্ঠস্বর থেকে প্রতিজ্ঞা ওঠে ।
--- ‘সিলেট নিলাম ভোটর জোরে, কাছাড় নিমু লাঠির চোটে ।
    বৈতলের পরাণে বারবার মনোব্যথার গুমোট । ভাবে, এ কেমন মানুষজন্ম মানুষ না পায়খানার গু । বাড়ির পায়খানা থেকে নাগা জমাদারনির মাথায় । মাথার টিন খালি করে আসে খাসিয়াপট্টির মালগুদামে, গুদামের মাল আবার যায় গুয়ের গাড়িতে, কোথায় যায় কে জানে । তবে বৈতল জানে যেখানেই যায় দুর্গন্ধের অশ্রদ্ধায় যায় । বইয়াখাউরি থেকে গু-এর টিন হয়ে এল ইণ্ডিয়ায়, ইণ্ডিয়ায় এসেও উৎপাত কমে না, আবার কি যেতে হবে মালগুদামে বোঝাই হয়ে । শুনছে জল-নেই দেশে নিয়ে যাবে, দণ্ডকারণ্য যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছে । লেখালেই কি যেতে হবে । কোথায় যাবে বৈতল । কত ঘুরবে, কোথায় হবে তার শেষ আপন দেশ । নিজের দেশ বইয়াখাউরির ভাটি ছেড়ে, জল ছেড়ে, বড় হাওরের হাওয়ায় চাদর ফেলে চলে এল দুর্গা ভরসা করে এই ভিনদেশে । মুখের ভাষা এক বলে আবার যেন ঝাঁকে মিশে যাওয়া । আবার সেই শ্রাবণী, মনসা আইর পূজো, গুরু সৃষ্টিধর ওঝার কাছ থেকে শেখা মনসাপুঁথির গান, ঢলানি জিয়ানি । দুখুর সঙ্গে লড়ালড়ি । লুলার বন্ধুত্বের ছায়া । বৈতলের ভয় লুলাকে হারিয়েছে, এখন না দুখুকেও হারাতে হয় । তাই সবসময় খটাখটি করে বন্ধুত্বের বাঁধন শক্ত রাখছে । জিয়ানির শেষে বৈতলের মন খারাপ থাকে । গায়কের তো আনন্দ হওয়ারই কথা, একে একে সব হাড় জুড়ে যায়, বিপুলা ও লক্ষ্মীধর দেশে ফিরে আসে । চান্দেও পদ্মার পূজা করে,
বামহাতে পূজা কৈল চান্দ অধিকারী ।
তাহাতে সন্তুষ্ট হইলা জয় বিষহরি ।।
    সবই তো সুখের হয় । মনকাষ্টের নাওখানি শূন্যে করে ওড়া বৈতলের মন খারাপ হয় সারা বছরের আয়োজন সমাপন হওয়ায় । আবার এক বছর, দুর্গা বিসর্জনেও এত বিষাদগ্রস্ত হয় না বৈতল । বৈতলের মনে হয় যেন জীবনটাই শেষ, সব পানসে । ধড়াচুড়া খুলে আবার লুঙি গামছা পরে বেরিয়ে পড়ে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ।


চলবে


চলবে 

 < উজান পর্ব ২৯ পড়ুন
                                                                                                                  উজান পর্ব ৩১ পড়ুন >
                                                                                                               উজান পর্ব ৩১ পড়ুন।  

কোন মন্তব্য নেই: