“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ২৫

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  পঁচিশ    ---সুব্রতা মজুমদার।) 



পঁচিশ

   শ্রাবণের ইজারা পেয়েও খুশি নয় বৈতল । বৈতলের আরো চাই, গ্রাস করতে চায় সে যমুনা প্রসাদকে । দুর্গাবতী যে সাধারণ মানবী নয় সে-প্রমাণ তাকে করতে হবে । প্রথম দিন দুর্গাবতীর মূর্ছা, জমিদার বাড়িতে শুশ্রূষা ও তার অধিষ্ঠান ভুলতে পারে নি বৈতল । দুর্গাকে বলে কেরামতি দেখাবে, আর লেপাপুছার কাজ করতে হবে না । চা জলখাবারের সেবাদাসী হতে হবে না । দুর্গা বৈতলের মতলব বোঝে নি । জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন রৌদ্রের তাপ বাড়ে, মন্দিরের গায়ে গোবর লেপতে লেপতে দুর্গাবতী অজ্ঞান হয় আবারএবার আর জমিদার বাড়ির বৈঠকখানায় যাওয়ার অবকাশ দেয়নি বৈতল । মন্দির চাতালেই শুইয়ে রাখে, আর প্রচার করে ভর হওয়ার, মা মনসার ভর । মনসা মন্দিরের চাতালে শুয়ে দুর্গাবতী মনোব্যথায় গায় ডিঙ্গা ডুবানির গানশ্রাবণ মাসে মনসা গানের প্রস্তুতিতে বৈতল যে সারাদিন একা গান গায় । শুনতে শুনতে দুর্গাবতীর গেঁথে যায় । রৌদ্রতাপে দগ্ধ হয়ে তাই দুঃখের গান গায়,
একে একে সব ডিঙ্গা ডুবি হইল পাত ।
সব ধন হারিল চান্দের যে আছিল তাত ।
বালিশ বুকুতে ধরি ভাসে সদাগর ।
মরিয়া না মরে, আছে সঙ্করের বর ।।
ব্যস, এই একটুকরো পয়ার গায় দুর্গাবতী, আর কিছুই না । বৈতলই তিন ঘড়া সোনাদানার গুপ্ত সমাচার জানায় জমিদারকে । এতদিন এক ঘড়ার গল্প প্রচলিত ছিল, তিন ঘড়া শুনে জমিদারও উজ্জীবিত হয় । হয় প্রচার, গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আসে ভক্তের দল । পদ্মদিঘীর পশ্চিম কোনে ভেসে উঠবে মৈসামুড়া ডিঙ্গা । আই প্রসন্ন হলেই জমিদারের সিন্দুক ভরে উঠবে নানা ধনে । বৈতলের একান্ত অনুরোধে দুর্গাবতী শুয়ে থাকে ভর হওয়ার সব অঙ্গভঙ্গি করে, এলোচুলে মাথা ঘোরায় এদিক ওদিক ।
   এরপর ঠাঠা রোদ্দুরে আর দুর্গাকে উঠোন ঘুরে ঘুরে লেপাপুছার কাজ করতে হয় না । মন্দির পুরোহিত শিবনাথ পণ্ডিতের সহকারিণী হয়ে যায় । এর আগেই তো এক জোড়া লালপেড়ে কোরা শাড়ি পেয়েছে দুর্গাবতী । লালাপাড় শাড়িতে দুর্গাবতীর যৌবনে আগুন লাগে । সে-আগুনে পোড়ে যুবা জমিদার যমুনা প্রসাদ সিং । বৈতল আর দুর্গাকে জমিদারের ভিতরবাড়িতে যেতে বারণ করে না । বৈতল পাটনির বৌও সিং জমিদারের গৃহিণীর সখী হয়ে যায় । হয়ে যায় সমকক্ষ । বৈতলও আর দুর্গাবতীর রাশ টেনে রাখে না তেমন । বৈতলও মন দেয় রুটি রোজগারের, ঘরের বাইরে থাকার । নতুন ভেল্কির খোঁজে বৈতল তাই রিক্সার টিপ বাড়িয়ে দেয় । সন্ধ্যার গাঁজার আসর থেকে উঠেও বাড়ি ফেরে না, অন্য এক আসরে মজিয়ে  রাখে নিজেকে । আনারকলির ঘরে গিয়ে নেশা করে । বৈতল জানে তার মন বড় অবোধ, যখন যাকে ধরে তাকে প্রাণপণ আকর্ষণে নিজের দিকে টেনে রাখে । ভাবে দুর্গাবতী চায় একটা সম্মানজনক বৃত্তি । স্বামীর পরিচয় চায় । দুর্গাবতী বলে পূজারী হয়ে যেতে । শিবনাথ পণ্ডিতের সহকারী হলেই চুকে যায় ল্যাঠা । কিন্তু বৈতল যে ভুলতে পারে না তার উত্তরাধিকার তার গাত্রবর্ণ, তার কথা বলার অশিক্ষিত ধরন । কিছুতেই বেরোতে পারবে না, বেরোতে চায় না সে । তাই দুর্গাবতীকে বলে,
--- আমি পারতাম নায় । আমি মাছ মারতাম আর খাইতাম পারি । ইতা অং বং চং পারতাম নায় । ইতা সংগোস কিড়িমিড়ি আমার কাম নায়, ইতা জানইন বাবন পণ্ডিতে । আমি যেতা আমি অতা ।
--- আর আমিও তো অতা । রিক্সা আলার বউ । আর কিতা । পুয়া পুড়ি অইলে কইব বাপ রিক্সাআলা ।
--- হুনো গো মাই, তুমার খুরো খুরো দণ্ডবৎ । আমি বাবনও নায় জমিদারও নায় । আমি এক মাইমল, পানির পুক, কপাল দুষো রিক্সা চালাইয়ার । গতর খাটাইয়া খাওয়ার কুনু শরম নাই । অখন যদি আমারে পছন না অয়, তুমার পছনর বেটার লগে থাক গিয়া । আমারে ছাড়ি দেও ।
   ছাড়াছাড়ির কথা হলেই দুর্গাবতী অভিমানে ফুলে ওঠে, কান্নাকাটি জোড়ে । বৈতল বিব্রত হয় সন্ধি করে । হেরে যায় ।
    বৈতল আবার নতুন করে ভাবে । ভুল হলো না ঠিক হলো । দুর্গাবতীর সুখের জন্য একটা আবাস দিতে চেয়েছে বৈতল, সেই দুর্গাকেই কি শেষপর্যন্ত হারিয়ে ফেলবে । নিজের দোষেই এমন হয় । মেহেরপুর টিলা থেকে এত বড় সাপটা না ধরলেই হত । জমিদারকে ভয় দেখিয়ে আংটি নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঠিকই ছিল । কিন্তু বড়লোকের বড় কথায় বড় অসম্মান হয় বৈতলের । এই লোকটা তো আবার পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে, সরাসরি ছোটলোক বলে না তির্যক কথায় বলে ।  আর বৈতল রাগে । তার পুকুরের রুই মাছের থেকে ক্ষীণদেহী বলায় বৈতল রাগে । ক্ষীণদেহের তেজ দেখাতে বদ্ধপরিকর হয় । লোকটা হয়তো কথাটা বলেই ভুলে গেছে । নিচের তলার মানুষকে অসম্মান করাটাই তাদের স্বভাব ভুলে যাওয়াও স্বভাব । আসলে বড়লোকের রসিকতা যখন নিচের দিকে ছোটে তখন তার মাত্রা থাকে না । তারপর লোকটা ওকে দেওলা করে রাখার কথাও বলে । হয়তো কৃপাভাজনকে সম্মান দেখাতেই বলা । কিন্তু বৈতল তো তার কৃপা চায় না, তার সর্বনাশ চায় । হ্যাঁ লোকটা কৃতজ্ঞতা দেখাতে গিয়ে একটা ফাউও পেয়ে যায় । লাভ হয় তার, দুর্গাবতীকে অধিকার করার স্বপ্ন দেখছে । তবে বৈতল জানে এত তাড়াতাড়ি দুর্গাবতী তাকে অমান্য করবে না সাতঘাটের পানি খেয়েছে দুর্গা, দুর্গা জানে বৈতল দাস রিক্সাওয়ালা ছাড়া অন্য গতি নেই তার ।
   যদিও আষাঢ় মাস পড়তে না পড়তেই বৈতল দুর্গাবতীর ঝগড়াঝাটি বাড়ে । বৈতলের রিক্সা চালানো নিয়ে দুর্গাবতীর লজ্জা কাটেনি । দুর্গাবতীও বড়লোকের ভাষায় কথা বলে পেঁচিয়ে । বলে,
--- ব্রাহ্মণ হইয়া রিক্সা চালাও, লইজ্জা শরম নাই নি ।
তেঁড়া বেঁকা কথায় বৈতল জ্বলে ওঠে তেলেবেগুনে । বলে,
--- কিওর লজ্জা, কিওর শরম । থাকা ভালা পাওয়া ভালা নায় । তুমারে তো কেউ চুরর বৌ কর না, তে কিওর লইজ্জা । কাম করিয়া খাই । আর শুনি লাও গো মাই, আমি কুনু বাবন উবন নায় কই দিলাম, আমি কৈবর্ত, রিক্সা চালাইলে আমার শরম লাগে না । লইজ্জা তো আমার, যখন মাইনষে কইব আমি যম জমিদারর ইওর হাই ।
--- ছি । তুমার মুখো কিচ্ছু আটকায় না নানি । জমিদারে অতবড় কাম দিতা চাইলা নিলায় না এর লাগি কইলাম । কেতুমামা বুড়া অইছইন, কতদিন গাড়ি চালাইতা পারবা ঠিক নাই । শিখাইলে এর পরে তো গাড়ি তুমার ।
--- অয়, দানপত্র লেখি দিব নি বেটায় । ইগুরে ছিনছ না, অখন ছিনছে তরে, এর লাগি মিঠা মাত মাতের গাড়ি দিব কর । গাড়ির ডাইভার বানাইত আমারে । আমারে সামনে রাখিয়া পিছে বইয়া তুই করতে রাধালীলা, আর আমি দেখতাম । আমি জানি, আমি দেখছি তোর ছিনালামি ।
    বৈতল কিছুই দেখেনি একটু বাজিয়ে নেয় শুধু । দুর্গাবতীও সময় বুঝে চুপ মেরে যায় । বৈতলকে ধন্দে রাখে । বৈতলও দুর্গাবতীকে বাজে কথা বলে দুঃখিত হয়, দমে যায় । আবার মন দেয় পাঁচালি গানে । এই করে করে বৈতল প্রস্তুত হয় । শ্রাবণীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে । বই নেই খাতা নেই কিছু নেই, স্মৃতিধর বৈতল গুরুর কণ্ঠ থেকে শুনে শুনে সম্পূর্ণ পদ্মপুরাণ মুখস্থ শিখেছে । শুধু কি এক কবির লেখা । যে কবির যে টুকু সুন্দর সাজিয়ে শিখিয়েছেন গুরু, ষষ্ঠীবর দত্ত বংশীদাস বাইশ কবি কালীচরণ জগন্নাথ বিজয় গুপ্ত চৈতন্য চরণ পাল গুরু সৃষ্টিধর আর বদিওঝার গায়নরীতি মেনে নিজেকে তৈরি করেছে । গুরু বলেন বদিওঝা তার ওস্তাদ, ওস্তাদির মার হল লাচাড়ি, মানে শ্রোতাকে ধরে রাখা, নাটক করে দর্শকের মন কাড়া । মিল ছন্দের টানে শ্রোতাকে বিবশ করে দেওয়া, কোথাও কিছু একটা শ্রুতিমধুর কিন্তু ধরা যাচ্ছে না । কোথাও গানের কথাকে থামিয়ে রেখে, অভিনয় দিয়ে দর্শককে মোহিত করে দেওয়া । কখনও বিষাদ কখনও উচ্চকিত আনন্দ কখনও বা মৃদু হাসির রেশ মুখে । গুরু বলেন গানের আসর হলো সাগরের পার হাসি কান্নার ঢেউ আসবে দুলে দুলে, আসবে উচ্ছ্বাসে । বৈতল যখন গায়,
মামী মন কেনে বেজার
আজ বুঝি মামায় বুচি খাইছে না তোমার ।
 বৈতল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, চিনে নেয় শ্রোতা দর্শকের মন । সামনে বসা মানুষের খুশি দেখে হাঁক দেয় জয় আই বিষহরির জয়
   গায় আর এক মজাদার দিশা,
বুড়া গেল না তোর খাইত
অকারণে হইলে বুড়া দুইপরী ডাকাইত ।
              আবার হাঁক দেয়, ‘শিব হে
গুরু বলেন,
--- ইতা হক্কলতা পুথিত নাই রেবা । ইতা চালাকি, একলা বকবক করে কে কও চাইন, আউয়ায় । আসরর বউঝি হক্কলর দি যদি পড়াইতায় না পারলায় তে আর কিওর গাওরা তুমি । সময় দেওন লাগব, নাইলে শ্বাসকষ্ট হইব, শাসিরগ ফুলি গেলে গাইতায়ও পারতায় নায় পড়তায়ও পারতায় নায় এর লাগি তারারে মাতাও মাঝে মাঝে, আর তুমি চুপ করি থাকো । মাইনষে যে ভালা কর ই কথা তুমার কানে হুনন লাগব ।
   গুরু তো একাই একশ, তাই একক প্রদর্শনীর সুযোগ পায়নি বৈতল, কোনও শিষ্যও তৈরি করতে পারে নি দোহারকির জন্য । চাতলার দক্ষিণ পারে খিরারতলা গ্রামের কীর্তনিয়া শ্রীহরি পাটনির খোল করতাল মৃদঙ্গ আর দোহারকির চিকন গলা নিয়ে তৈরি করে তার আইকথার নতুন নিবেদন । এই এক মাসেই তার পরীক্ষা, তার পরিচয় নবীন শহরে । জমিদার যমুনা প্রসাদ বলেছে শামিয়ানা টাঙিয়ে দেবে, যতদিন গান হবে ততদিন ভোগ হবে । খিচুড়ি হবে লাবড়া হবে ডেকচি ডেকচি, ভক্তজনরা প্রসাদ পাবে । বৈতলের জন্যও বিশেষ সম্মান হবেদৈনিক অর্থ বরাদ্দ ত্রিশ টাকা করে, বলেছে যা চাইবে পাবে । বৈতল যা চায় তা দেবে কী করে যমরাজা । বৈতলের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না । তাই বৈতল হাসে । হাসতে হাসতে বলে,
--- যেতা চাইমু দিবা, আইচ্ছা নিমুনে । যেতা ইচ্ছা যখন জিগাইয়া নিলেও নেওয়া না জিগাইয়া নিলেও নেওয়া । মনো রাখইন যে ।
   বৈতলের আইগানে বিভোর জমিদার হাসে । পুঁথিগায়ক বৈতলের গান শুনতে হরিৎবরণ ইটখোলা দুধপাতিল থেকে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ এসে জড়ো হয় । গুরমির বেশে নাচে বৈতল । বৈতলের গাল শ্মশ্রুবিহীন শ্যাম । কিম্পুরুষ নাচের আদর্শ । বৈতলের কণ্ঠেও পদ্মাবতীর বাস । অধিবাসের দিন বৈতল একটু আনমনা হয় । উত্তেজনায় দুর্ভাবনাও হয়, পারবে তো । একক গানে উৎরে যাবে তো । গুরু সৃষ্টিধরকে স্মরণ করে গুরুর ব্রহ্মা গুরুর বিষ্ণু গুরুরদেব মহেশ্বরো, সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে গুরুকে, নির্দ্বিধায় নিজের নাম উচ্চারণ করে গুরুর নামে । নবীন গায়ক সৃষ্টিধর ওঝার পুনর্জন্ম হয় হরিৎবরণ মনসামন্দিরে । গুরুর মতো নির্ভর করে নিজেকে । ভুলে যায় ঘর সংসার । শুরু করে গান । শ্লোক গান দিয়ে হয় মঙ্গলাচরণ,
আস্তিকস্য মুনিমার্তা বাসুকী ভগিনীস্তথা ।
জরৎকারু মুনির্পত্নী মনসা দেবী নমোহস্তুতে ।
 ‘জয় আস্তিক মুনির মা মনসা দেবীর জয়এর রব ওঠে মহুয়া গাছের চারপাশে । গাছের চারদিক ঘুরে সৃষ্টিধর নামের বৈতল ওঝা করে মনসা বন্দনা । গায়,
নম নম ওগো দেবী আস্তিকের আই ।
তোমার চরণ বিনে অন্য গতি নাই ।
সকলি তোমার লীলা সব তুমি পার ।
সর্প হইয়া কামড় মার উঝা হইয়া ঝাড় ।
   শ্রীহরি পাটনির দোহারকিতে সর্প হইয়া কামড় মার উঝা হইয়া ঝাড়হরিৎবরণের আকাশে বাতাসে শ্রোতার কণ্ঠে মুখরিত হয় । প্রথম দিনেই বৈতল ওঝার নামে জয়ধ্বনি ওঠে, সৃষ্টিধর ওঝার পোষাকী নাম থেকে বৈতল দাস ওঝা নামটাই ভক্তের প্রিয় হয় । জানিগঞ্জ বাজার থেকে কেনা নতুন পাগড়ি ঘাগরা সালোয়ার ঘুঙুর আর হাতের সাদা চামরে বৈতলকে এক ভিন্ন দুনিয়ার নর্তক মনে হয় । নতুন ওঝার গান শুনতে শহরের মান্যগণ্যরাও এক পাক দিয়ে যান, খুশি হয়ে অনেকে দশ টাকার নোটও দিয়ে যান পুরষ্কার । নগদ প্রাপ্তি থেকে একভাগ বৈতল শ্রীহরিকেও দেয় ।
   মনসাপূজার দিন তো এলাহি কাণ্ড । জমিদার হাত উপুড় করে দেয় পূজার জন্য । বিলপার থেকে আনা হয় রমণী আচার্যকে করণ্ডি সাজাতে । করণ্ডির পট দিয়ে যায় কর্ণমধুর ভাদু পাটনি । হেরম্ব ভট্টাচার্য জমিদার বাড়ির কুলপুরোহিত, নিত্যপূজার কাজ চালিয়ে দেন শিবনাথ পণ্ডিত কিন্তু শ্রাবণীর মর্যাদাই আলাদা । বৃদ্ধ কুলপুরোহিতের ডাক পড়ে, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে বৃদ্ধের । নাগপেচ সাজাতে পূজনের বৌ বানিয়ে দেয় পঞ্চবিভূতি । পঞ্চগুঁড়ি । চাউলতুষ বেলপাতা হলুদ আর আবির । আলাদা আলাদা কটরায় । হেড়ম্ব ঠাকুরের প্রথম দেখায়ই ভাল লেগেছে দুর্গাকে । বলেন জমিদার গ্রিহিনিকে,
--- বড় লক্ষীমন্ত বৌ পাইছ গো, বড় কামর বেটি ।
    বড়বৌরও দুর্গাকে অপছন্দ নয় । জমিদারের বৌ বয়সে প্রবীণা না হলেও সবাই বড় বৌ বলে । বয়সে দুর্গাবতীর ছোটই হবে এক দুই বছরের । ভেতরবাড়িতে রোজই দেখা হয় কথা হয় । গায়ের রঙ মাজা হলেও বৈতল যেমন বলেছে । টিকির ছালিনয় । গতরের লছন কম ভারী শরীরে সোনার গয়না খোদাই করা । দুর্গা প্রথমদিকে জোড়হাতে নমস্কার করেছে এখন হাসে । বড় বৌও হাসি দিয়ে প্রধান পুরোহিতের মন্তব্য সমর্থন করে । হেড়ম্ব ঠাকুর এবার দুর্গাবতীকে বলেন,
--- তোর হাতের কাম বড় সুন্দর বেটি, তুই অউ করি দে । নাগপেচ সাজাই দে ।
--- না না ঠাকুর, আমি কেমনে করতাম । আইর যে গুসা, অমঙ্গল অইব ।
--- কিওর অমঙ্গল । আমি তারার কুলপুরোহিত আমি কইয়ার কিচ্ছু অইত নায়, করি দে বেটি । মন দিয়া করিছ, মার আশীর্বাদ পাইবে ।
   প্রবীণ পুরুষের সমর্থন পেয়ে দুর্গাবতী নাগপেচ সাজায় মন দিয়ে । বৃদ্ধ ব্রাহ্মণও রক্ষা পায়, এতদিন তো ধ্যাবড়া ধোবড়া ছবি একে নাকাল হয়েছেন । দুর্গাবতীর আঁকা দেখে বৃদ্ধের মুখ খুশিতে ভরে ওঠে আবার ।
   বৈতলের এসব আদিখ্যেতা পছন্দ হয় না । দুর্গাবতী বলে,
--- ইতা কিতা । ইখান থাকি এনে, হিখান থাকি হেনে না আনলে কিতা অইত নায় নি আইর পূজা । পূজা থাকি ই আড়ম্বর বড়, খালি বড়লুকি দেখানি । করণ্ডি নাগপেচ ইতা এমন কিতা পণ্ডিতর কাম । আমরার গাউত ইতা গাউআলা মাইনষেউ করছইন ।
   দুর্গাবতীর ব্রাহ্মণমন বৈতলকে সমর্থন করে না । বলে,
--- না, আচার্যি ঠাকুর না আইলে অইত নায়, ভটবাবন না অইলে অইত নায় করণ্ডি । মা মনসার হক্কলে ডরাইন ।
--- কেনে ভট বাবন কিতা গাছর গুটা নি । না অইলে অইত নায় । আর আই বেটি কুনু বাবনর সম্পত্তি নি, মাছুয়া মাইমল চাড়াল নাগার্চি হকলর আই, তুমরা যারারে কও ছুটলুক তারার মা । বাবনে কিতা করতা ইনো । আর কাকাবাবুয়ে কিতা কইছইন জানোনি । তাইনও তো ভটবাবন । কইছইন জন্মর সময় কেউর মাথাত লেখা থাকে না ভট আর পাটনি, হিন্দু আর মুসলমান । ই জমিদার ইগুয়ে মানুষরে মানুষ মানে না ।
--- মানুষ তো মানুষ অউ । কিন্তু বাবনর পুড়ি বাবন অউ হয়, মাইমলর পুত মাইমল, তুমার লাখান ।
--- কালা, নানি । গাত গন্ধ আইছলা গন্ধ । শ্রাবণ মাস যাউক তারপরে দেখাইয়ার তোর জিলকানি । বার করিয়ার বাবনাকি । জমিদারনী অইতে, নানি । তোর তেল কিলা বারকরন লাগে দেখাইয়ার । বাঙাল অই যাইমু । মুসলমান অইলে আর ভট থাকে না, শর্মা থাকে না, পাটনি থাকে না । সব অই খোদার বান্দা ।
--- বাক্কাউতো হিকছ দেখি । মন্দিরো বইয়া ইতা না মাতিয়া মজিদো যাও । ইতা কে হিকার তুমারে, কোন ইমামে ।

--- কেনে লুলা ইমামরে ভুলি গেলায় নি । রুল আমিন বেজ । ইখানো আছে এক বাট্টি ইমাম, শয়তানের লাট্টি, দুখু মিয়ারে দেখছ নানি । আমার লগে যে খালি লাগে । আর আছইন একজন, দাতা, মামুপির । তাইন পির উর কিচ্ছু নায়, মাত্‌তা পারইন না, কিন্তু বড় ভালা মানুষ । মাইনষে কয় তান হাতর মাইর খাইলে বুলে কপাল খুলি যায় । উমা ধুমা মারইন কিল ।






চলবে  
< উজান পর্ব ২৪ পড়ুন   
                                                                                                                                 উজান পর্ব ২৬ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: