“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৭

অ-ধার্মিকের ধর্মকথা

(C)Image:ছবি

।। মৃন্ময় দেব ।।


“Religion, a medieval form of unreason, when combined with modern weaponry becomes a real threat to our freedoms” ~ Salman Rushdie.


ধর্মযুদ্ধ !
শব্দটা বেশ ধন্দ জাগানিয়া। ধর্ম শব্দটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র আমাদের মনে ঈশ্বর-আল্লা-গড হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-মুসলমান-শিখ-ইসাই থেকে শুরু করে বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-কোরআন-ত্রিপিটক-জেন্দআবেস্তা-গ্রন্থসাহেব সহ নানা শাস্ত্র, আচার-বিচার মন্দির-মসজিদ-গীর্জা ইত্যাদি বহু কিছু মনে এলেও কোনও ভাবে কোনও কারণেই যুদ্ধের কথা মাথায় আসে না। অথচ ‘ধর্মযুদ্ধ’ কথাটা আমাদের মস্তিষ্কে সেই কোন কাল থেকে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে ! সামাজিক মানুষ কিন্তু সাধারণত ও স্বভাবত যুদ্ধবিরোধী। কিন্তু ইতিহাসে  বারবার দেখা গেছে যে   ধর্মের নামে যুদ্ধকে নির্বিরোধ মানুষের কাছে গ্রহণীয় করে তোলার প্রয়াস হয়েছে, আজও হয়, হচ্ছে।  মহাভারতেও আমরা দেখি যে জ্ঞাতি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গররাজি অর্জুনকে প্রভাবিত করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধর্ম কথা শোনাচ্ছেন, ধর্মের পাঠ পড়াচ্ছেন। এও দেখা গেছে, বিশেষ প্রেক্ষিতে মানুষ  এমন কি ধর্মের খাতিরে নিজের  প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতেও পিছপা হয় না। একবিংশ শতাব্দীতেও তা আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি, দেশে-বিদেশে এ থেকে এটাই সপ্রমাণিত যে ধর্মকে আম আদমি সমধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু কীভাবে কোন  প্রক্রিয়ায় মানুষকে স্বভাব-বিরুদ্ধ কাজে নিয়োজিত কিংবা অবস্থান গ্রহণের  জন্য বাধ্য করা হয় সে এক ধন্দ।  
ধর্ম কী ? এ প্রশ্নের কোনো সহজ সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর বিদ্বজ্জনের কাছেও পাওয়া যাবে না। জলের ধর্ম আগুন বা বাতাসের ধর্ম ইত্যাদি বলতে আমরা যা বুঝি আর আমরা যে ধর্ম নিয়ে কথা বলছি তা, বলা বাহুল্য,  এক নয়। প্রথম ক্ষেত্রে ধর্ম বলতে ইংরেজি ‘প্রোপার্টি’ (property) শব্দটি বুঝি এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ধর্ম বলতে ‘রিলিজিয়ন’ (religion) বোঝানো হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের ধারণায় ধর্ম বলতে এক ধরনের প্রশ্নহীন বিশ্বাস ও আনুগত্য বিরাজ করে ধর্ম তাদের কাছে ‘অবশ্য পালনীয়’ এক কর্তব্য। মজার কথা হচ্ছে ধর্ম ঠিক এই বস্তুটিই  দাবি করে। কেবল দাবি করে না, আদায়ও করে নেয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেবহুক্ষেত্রে ধর্মের দাবিকে হাজির করা হয়ে থাকে ‘সাংস্কৃতিক নির্দেশাবলী’ (cultural instructions) হিসেবে। আরো কৌতুকজনক ব্যাপার হচ্ছে সামাজিক  জীবনযাপনে ধর্মের আপাত হিতকর নির্দেশসমূহ প্রতিদিন লঙ্ঘিত হতে দেখেও, সাধারণ বয়ানে যা ‘অ-ধর্ম’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, কেউ বিশেষ বিচলিত হয় না। অর্থাৎ ধর্মের প্রচারিত কেতাবি ও নৈতিক(!) বিষয়গুলি উপেক্ষিত হয়ে থাকে, হতে থাকে সব দেশে, সব ধর্মেই। ধর্ম-পালন সীমিত থাকে আচারসর্বস্বতায়, এবং ভিন্ন ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও শীতল যুদ্ধের মধ্যেই। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিবিধ কৌশলে অবস্থাটি টিকিয়ে রাখে। ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ কথাটা যে বলা হয়  সে ধর্মের এই সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী বিস্তারের কারণেই।  
ধর্মীয় রীতিনীতি ও অনুশাসনের বিরোধিতা যে মানুষের সমাজে দেখা যায় না সেও নয়। সময়ে সময়ে তাই ধর্মীয় সংস্কারেরও প্রয়োজন পড়েঅন্তর্গত বিরোধের ফলে পৃথক শাখা-সংগঠন তৈরি হয়, যেমন-মহাযান-হীনযান, ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট ইত্যাদি। সামগ্রিক ভাবে ধর্মকে নাকচ করার প্রবণতাও অবর্তমান নয়। বিভিন্ন সমীক্ষকদের সমীক্ষায় এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পৃথিবীতে নাস্তিকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান এরকম ইঙ্গিত  মিলেছেকিন্তু এই বৃদ্ধির দরুণ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিশেষ ক্ষতি হয়নি। বরং হালে গোটা বিশ্ব জুড়ে এক  অস্বাস্থ্যকর ধর্মীয় উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছেশুধু তাই নয়, ধর্মের নামে মারামারি-হানাহানি এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে বললেও একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না। মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশে নাস্তিক ব্লগারদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড তার দৃষ্টান্ত। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ এই ভারতবর্ষেও ইদানীং একই ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমরা। এক অসহিষ্ণু বাতাবরণ সৃষ্টির প্রাণান্তকর প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছেঅথচ সহিষ্ণুতা নাকি ধর্মের অন্তর্বস্তু, যা ধারণ করে তাই নাকি ধর্ম -এমন কথা অহরহ শুনতে পাওয়া যায়। মানে গেলানো  হয়ে থাকে আর কি! কিন্তু ধৃ-ধাতু থেকে জাত ধর্ম শব্দটি যে কোন ধাতুতে গড়া সেটা মালুম হয় যখন দেখি যে মানবতাবিরোধী যুদ্ধকেও সে আলিঙ্গন করে নেয় অবলীলায়, অকাতরে। এযাবৎ পৃথিবীতে ধর্মযুদ্ধে (crusade) যে পরিমাণ রক্তপাত ঘটেছে অন্য সব যুদ্ধেও নাকি সে পরিমাণ রক্তক্ষয় হয় নি! এজাতীয় উচ্চারণ জ্ঞানী-গুণী জনের মুখ থেকেই নিঃসৃত হতে দেখা যায়।   
ধর্মযুদ্ধ, মানে ক্রুসেড থেকে হালের ৯/১১ পর্যন্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এগুলোর মূলে ছিল বিশাল ষড়যন্ত্র, স্বার্থের সংঘাত। প্রথম ক্রুসেডের (১০৯৬-১১১২) কথাই যদি ধরা যায় তাহলে আমরা দেখব যে সে সময় সে যুদ্ধের প্রভাব জীবন ও সমাজে কতটা মারাত্মক ও সর্বগ্রাসী হয়ে পড়েছিল। ‘পবিত্র  যুদ্ধের’ মোহে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে বুদ্ধিজীবীদেরও। শিল্প-সাহিত্যেও সে প্রভাবের ছাপ রয়ে গেছে। ‘পবিত্র ভূমি’ রক্ষার যুদ্ধে যোগদান না করার বা সামিল না হওয়ার একমাত্র পরিণতি ছিল সামাজিক ভাবে বর্জিত হওয়া, শাস্তিও প্রাপ্য ছিল। ‘হোলি ক্রস’ বহন করে যারা যুদ্ধে সামিল হয়েছে তাদের মোক্ষলাভ যে সুনিশ্চিত সেই মোক্ষম বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল সর্বাগ্রে, সর্বস্তরেকেবল তাই নয়, আধ্যাত্মিক মুক্তির এই প্রলোভনের সমান্তরালে ছিল ইহজাগতিক পুরস্কারের বন্দোবস্তও। যেমন ঋণ মকুব, বকেয়া সুদ মাফ এবং এমন কি পূর্বের জঘন্য অপরাধের জন্য প্রাপ্ত শাস্তি মকুব কিংবা লঘু-দণ্ডের জন্য পৃথক বিচারশালার ব্যবস্থা পর্যন্ত ছিল। লঘু পাপে গুরু দণ্ড হয়  শুনেছি, কিন্তু গুরু পাপে লঘু দণ্ডের নীতি গ্রাহ্য হয়েছিল কেবল ‘পবিত্র ভূমি’ রক্ষার জন্য অস্ত্র তুলে নেওয়ার অন্যতম শর্তে। এর পেছনে যে সক্রিয় রাজনীতি ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক খেলা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ইদানীং কালের ইরাক যুদ্ধেও। মারণাস্ত্র খোঁজার অছিলায় জঘন্য এক ষড়যন্ত্রকে ‘অনন্ত ন্যায়ের যুদ্ধ’ নাম দেওয়া হয়েছিল। নির্বিচারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে জনপদ, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সমূহ। মারণাস্ত্রের বিরোধিতার অছিলায় ব্যবহৃত হয়েছে সাংঘাতিক সব মারণাস্ত্র। অথচ আজ আর কারো অজানা নেই যে weapons of mass destruction- এর হদিশ পাওয়া যায়নি। শুধু মাত্র প্রোপাগাণ্ডার জোরে কী করে একটা মিথ্যাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায় এ তার উৎকৃষ্ট এবং সাম্প্রতীক উদাহরণ। ভাবুন তো, গোটা বিশ্বের তাবৎ বুদ্ধিমানেরা কত সহজেই না বশীভূত হয়েছিল সে অপপ্রচারে ! ধর্মের কাজই হচ্ছে মিথ্যার বেসাতি। এখানেই খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে Robert Pirsig-এর মন্তব্য -"when one person suffers from a  delusion it is called insanity. When many people suffer from a delusion it is called religion."
     এগুলো আমরা জানি, কেবল ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে নয়, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও  জানি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যুক্তি-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কেন মানুষ এরকম স্রোতে গা ভাসায়! কীভাবে তা সম্ভব  হয়! কেবল প্রোপাগাণ্ডার ফলে সাময়িক ভাবে একটা সময় জুড়ে তা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস তো সাময়িক ঘটনার নয়, দীর্ঘ সময়সীমা জুড়ে তার ব্যাপ্তি ও বিস্তার। একটু আগের দৃষ্টান্তে (অনন্ত ন্যায়ের যুদ্ধ) ‘অনন্ত’  শব্দটির ব্যবহার তার দীর্ঘসূত্রিতা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাকেই কি সূচিত করে না ? ‘ন্যায়ের’ (জন্য) যুদ্ধ কথাটার মাধ্যমে ‘অন্যায়’ যুদ্ধকে বৈধতা দেবার প্রয়াস কি একান্ত গোপন ? ধর্ম ও ন্যায়, ন্যায়ধর্ম ইত্যাদি  শব্দগুলো সব গুলিয়ে যায়, মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যায় সবকিছু। অথচ ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার কিন্তু আসলেই কোনও সম্পর্ক নেই। সততার জন্য ঈশ্বর কিংবা ধর্মের প্রয়োজনও নেই। ‘ঈশ্বর নেই’ এই বার্তা রটে গেলে মানুষ খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধে ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন হাস্যকর যুক্তি কেউ খাঁড়া  করতে উৎসাহী হবেন না নিশ্চয়! তা  সত্ত্বেও ধর্ম যে চিন্তাশীল মগজকেও শর্তাধীন পরাবর্তের অধীন করে ফেলে সে তো স্পষ্টকিন্তু কীভাবে, কোন বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা বোঝা দরকার, অন্তত বোঝার প্রয়াস জারি রাখা জরুরি। নতুবা সে বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসা দুষ্কর।   
ধর্ম আসলে এক দুরারোগ্য ব্যাধি। ধর্মাক্রান্ত মানুষ মাত্রেই অবশ্য নষ্ট কিংবা ভ্রষ্ট নয়। অসুস্থ মাত্র র‍্যাবিড (Rabid) –জলাতঙ্ক রোগীর স্নায়ুতন্ত্র যেমন বিশৃঙ্খল ভাবে ক্রিয়া করে ধর্মাক্রান্ত মানুষও ঠিক  তেমনি অসংযত অস্বাভাবিক আচরণ করে। অবশ্য তার বিবিধ স্তর এবং মাত্রা বর্তমান। এটা অনস্বীকার্য যে যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ধর্মের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, হতে বাধ্যCraig A James তাঁর বিখ্যাত বই The Religion Virus-এ মানবমনের ওপর ধর্মের প্রভাব ও আধিপত্য বিশ্লেষণ করেছেন। মানুষের সমাজে ধর্মের উৎপত্তি তথা বিভিন্ন ধারণা ও বিশ্বাসের জন্ম এবং প্রচার প্রসার নিয়ে চিন্তা-চর্চা গবেষণার অন্ত নেই। স্পিনোজা  থেকে ভলতেয়ার, ফুয়েরবাক  থেকে মার্ক্স পর্যন্ত অনেকেই ধর্ম নিয়ে এবং সমাজে এর ভূমিকা নিয়ে ভেবেছেন  কিন্তু Richard Dwakins-এর ‘The God Delusion’ ও ‘Viruses of The Mind’ রচনার আগে জৈববৈজ্ঞানিকভাবে   ধর্মের মডেলকে এত পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়নি, বোঝা যায়নি কিভাবে এটি এপিডেমিওলজির প্রেক্ষাপটে অনেকটা ফ্লু-ভাইরাসের মতোই মানুষকে সংক্রমিত করে এই বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী তাঁর রচিত ‘The Selfish Gene’ গ্রন্থে চিন্তা উদ্রেককারী বহু তথ্য ও তত্ত্ব পেশ করেছেন, যা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও অবহেলার উপায় নেই কোনো।
ভাইরাস হচ্ছে এক ধরনের জীবাণু, যে নিজের খাদ্য তৈরি করতে পারে না, অন্য কোন প্রাণীদেহের আশ্রয় (Host) অবিহনে বাঁচতে পারে না ও বংশ বিস্তার করতে পারে না। প্রাণী দেহের বাইরের ভাইরাস আসলে নিরেট বস্তুপিণ্ড, জড় পদার্থ মাত্রমাইক্রোবায়োলজির বইতে তাই ভাইরাস না-সজীব না-নির্জীব হিসেবেই বর্ণিত। অন্য প্রাণীর আশ্রয়েই ভাইরাস সজীব, তার বাইরে সে নির্জীব। ধর্মগ্রন্থ গুলো যেমন, যে কোনও  গ্রন্থাগারের তাকে হাজার হাজার গ্রন্থের সারিতে তার আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, নেহাত নিরুপদ্রব গ্রন্থ মাত্র -যার নিজস্ব ক্ষমতা কিংবা স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। ধর্মেরও ঠিক ভাইরাসের মত হোস্ট-এর, অর্থাৎ একদল বিশ্বাসী, অনুগামীর আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া ধর্ম টিকে থাকতে পারে না,  তার বৃদ্ধি ও প্রসার ঘটে না। ভাইরাস জীবকোষে প্রবেশ করে কোষ থেকেই বাঁচার রসদ সংগ্রহ করে, বংশবৃদ্ধি করে এবং আস্তে আস্তে কোষের দখল নেয়। জীবকোষের স্বাভাবিক ক্রিয়া বিনষ্ট হয় ও ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণে অস্বাভাবিক ক্রিয়া করতে আরম্ভ করে। মানুষের মস্তিষ্ক যখন যুক্তিহীন (ধর্ম)বিশ্বাসের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তখনও সেই একই ব্যাপার ঘটে। কর্মের কর্তা হিসেবে মানুষ তার স্বাধীন কর্তৃত্ব হারিয়ে বসে। শুধু তাই নয়, সে যে বাস্তবে দাসসুলভ আচরণ করছে সে সম্পর্কে ধারণাও করতে পারে না। ধর্মীয় অনুশাসন, বিধিনিষেধ ইত্যাদি মগজে অনির্দিষ্ট কার্ফু জারি করে।
বিভিন্ন জীবাণু যেমন পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার চেষ্টা করে ধর্মও ঠিক তেমনি অপর ধর্মের সঙ্গে অনাবশ্যক প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়। ধর্মের ধ্বজাধারীরা তাই নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন ও প্রচার করার জন্য যা কিছু করতে সচেষ্ট থাকে। ধর্মকে জীবনযাপনের পদ্ধতি নতুবা সংস্কৃতি হিসেবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আমরা এইচ আই ভি-র (Human Immuno-deficiency Virus) কথা সবাই জানি। এইচ আই ভি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা নিঃশেষ করে দিয়ে শরীর-সংগঠনকে ভেঙ্গে দেয় ও ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ধর্মও ঠিক একই প্রক্রিয়ায় যুক্তি-বুদ্ধি চিন্তা-চর্চার মানসিক-মানবিক প্রতিরোধ পদ্ধতি নিঃশেষ করে দিয়ে সামাজিক সংগঠনকে বিস্রস্ত বিশৃঙ্খল করে ফেলে। সে অর্থে ধর্মও আসলে আরেক এইচ আই ভি – Human Invented Virus এই কারণেই ধর্মীয় আচার স্বরূপ নৃশংস বলি-প্রথা, কুরবানি ইত্যাদি মনস্তাত্ত্বিক ন্যায্যতা লাভ করে। ধর্মের সন্ত্রাস কায়েম করে দশ জনের চোখের সামনে একজনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়। নেলী কিংবা গুজরাটের মত হত্যালীলা ঘটতে পারে। কয়েক শ’ মানুষের হত্যালীলা কয়েক হাজার মানুষ ঠেকাতে পারে না, নির্লিপ্ত ভাবে প্রত্যক্ষ করে কেবল।
‘ধর্ম জানে, প্রতারণা করি নাই’ উচ্চারণের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে প্রতারণার মারাত্মক বীজভাইরাসের সংক্রমণে সাধারণত দুরকমের ফল দেখা দিতে পারে। প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, এইচ আই ভি-র সংক্রমণে যেমন এইডস (Aquired Immuno Deficiency Syndrome) দেখা দেয়। আবার এমনও হয় যে শরীরে এইচ আই ভি রয়েছে অথচ রোগের কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। এরা হচ্ছে বাহক (carrier), এরা জেনে অথবা না-জেনে বীজাণুটিকে অন্যের শরীরে ছড়িয়ে দেবার কাজ করে চলে। রোগের কষ্ট অনুভব করতে হয় না বলে নিজেদের এরা সুস্থ মনে করে। ধর্মবিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। রোগের লক্ষণ তীব্র ভাবে প্রকাশ পেলে ধর্মীয় সন্ত্রাসের জন্ম হয়। আরেক দল ‘বাহক’ হয়ে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ছড়ায় সমাজদেহে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। এদের ‘নিরাপদ শান্তিপ্রিয়’ মনে হলেও বাস্তবিক অর্থে তা নয়, যেহেতু অবস্থাটি স্থায়ী বা অপরিবর্তনীয় নয় কখনোই। প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেলে একজন বাহকের শরীরেও রোগ-লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। ঠিক তেমনি আপাতভাবে শান্তিপ্রিয় ‘ধার্মিক’ মানুষটিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসবাদী বনে যেতে পারে অনায়াসে।  কারো কারো শরীরে অবশ্য সারা জীবনেও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না।     
  অর্থাৎ, এটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে বাইরে থেকে কিছু টের পাওয়া না গেলেও ভাইরাস-আক্রান্ত কোষটিতে এক বিরামহীন যুদ্ধ চলতে থাকে। সমূহ শরীরতন্ত্র বিকল হয়ে পড়লে তবেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নজরে আসে, বিধ্বস্ত চেহারা স্পষ্ট হয়। ধর্মের ভূমিকাও তদ্রূপ, ধর্মযুদ্ধ (!) ঘোষিত হবার পর যে ভয়ানক ও বীভৎস   রূপ আমাদের অভিজ্ঞতায় ধরা দেয় তার প্রেক্ষাপট কিন্তু তৈরি হয়, হয়েছে যুগ যুগ ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্মে। মানুষের মগজ দখলের জন্য, মানব সমাজের গঠনতন্ত্রকে বিশৃঙ্খল করে দেবার লক্ষ্যে ধর্ম-বিশ্বাসের এই  চোরাগোপ্তা হামলা চলতেই থাকে –নিয়ত, নিরন্তর। হালের গবেষণায় এটা প্রতিপন্ন হয়েছে যে শারীরিক  প্রতিরোধ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটলে ‘আচরণগত বিশৃঙ্খলা’ও (Behavioural disorder) দেখা দিতে পারে ‘অটিজম’  (autism) তার দৃষ্টান্ত। এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ আপাতত নেই। ইতিহাস বইয়ের পৃষ্ঠায় আমরা ‘ধর্মযুদ্ধের’ বিবরণ পাঠ করি বটে, কিন্তু অন্তর্গত যুদ্ধের এই দীর্ঘ ও বিরামহীন বর্ণনা কিংবা ইতিহাস লেখা হয় না কোথাও। কিংবা, যেখানে যেভাবে লেখা থাকে সে ইতিবৃত্তের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় না আমাদের পক্ষে। আমাদের উপলব্ধিতে তার নাগাল পাওয়া যায় না, মেলে না হদিশ।
যুদ্ধের মূলে থাকে দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার। প্রথমিক স্তরে যা প্রতিযোগিতা হিসাবে সাব্যস্ত হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার মূলে থাকে সম্প্রসারণবাদ। আর প্রতিযোগিতার, সম্প্রসারণবাদের চরম ও চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে যুদ্ধ। কিন্তু মানুষের সমাজের, মানবিক সমাজের মূল ভিত্তি প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা। কাজেই যুদ্ধ স্বাভাবিক নয়, হতে পারে না, ধর্মযুদ্ধও না। রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ হয়, তখনই যুদ্ধের মহড়া শুরু হয়। আর অন্যায় অনৈতিক যুদ্ধকে ‘ধর্মযুদ্ধের’ মোড়কে হাজির করা গেলে আর কী চাই! কিন্তু মানুষের ধর্ম হচ্ছে মানবিকতা, যুদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই মানব-ধর্ম। ধর্মের নামে যুদ্ধের বিরুদ্ধেও। সহযোগিতার বর্মে আচ্ছাদিত হয়ে ধর্মকারার প্রাচীরে ব্জ্রাঘাত করা তাই জরুরি যুদ্ধের উন্মাদনা থেকে বাঁচতে ও পৃথিবীকে বাঁচাতে একজোট হয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণাই আমাদের একমাত্র রক্ষাকবচ। আর সে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় এবং উপযুক্ত হাতিয়ার হচ্ছে যুক্তি ও মানবিকতাযুক্তিহীন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাই কামান দাগা চাই। তবে তারও আগে বিশ্বাসের শেকড় কী করে মননের ভিত ধ্বসিয়ে দেয় সেই প্রক্রিয়াটিকে বুঝতে হবে নিরেট নাস্তিকতা দিয়ে তা বোঝা যাবে না, সেও মনে রাখা চাই।


সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব যে বিভিন্ন প্রথা কিংবা বিশ্বাসের (ধর্মবিশ্বাসও যার অন্তর্ভুক্ত) শিকার হয়ে মানুষ সংঘটিত করেছে নৃশংস সব হত্যালীলা। ইতিহাসের পাতায় তার অজস্র-অসংখ্য বীভৎস দৃষ্টান্ত ছড়ানো। ডাইনি হত্যা থেকে শুরু করে ধর্মযুদ্ধের নামে চলা এইসব হত্যালীলার মূলে কিন্তু কোন-না-কোন বিশ্বাস, এবং বলা অহেতুক, এই বিশ্বাসের ভাইরাস আণবিক বোমার চেয়ে কোনো অংশে কম মারাত্মক, কম বিধ্বংসী নয় জরুরি নয় যে কথাগুলো কেবল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। জাতীয়তাবাদ থেকে সন্ত্রাসবাদ, গণতন্ত্র থেকে মার্ক্সবাদ সর্বত্রই তর্ক-বিমুখ ‘বিশ্বাসে বশীভূত’ মানুষের সংখ্যা অসংখ্য, অগণন। আমাদের চারপাশে চোখ ঘোরালেও তার নজির পাওয়া যাবে। এটি একটি প্রক্রিয়া। বিজ্ঞাপনের জারিজুরিতে মানুষ যেমন  ফর্সা হওয়ার ক্রীম কেনে এও তেমনি। ধর্ম সমেত যে-কোন ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। বর্তমান জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তথা প্রবণতার প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে সামাজিক ভাবে সচেতন হওয়া যে খুব জরুরি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধের’ প্রস্তুতি চাই। এসময়ের এটাই দাবি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়া চাই।   

('একা এবং কয়েকজন'-এর ধর্মযুদ্ধ সংখ্যায় প্রকাশিত, শীত -১৪২৩)

কোন মন্তব্য নেই: