“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

শব্দরূপা





      ।। শিবানী দে।।
মার চেন্নাইবাসী দেড় বছরের নাতি আমাকে তার পাশে  বসতে বলে, ‘উক্কা, উক্কা’। তার মায়ের কাছে  জানলাম, তামিলে ‘বস’(sit down) বলতে ‘উকারো’ বলে । উক্কা তারই অপভ্রংশ । আমি তাকে প্রতিআপ্যায়ন করে শুদ্ধ সিলেটিতে বলি, ‘বউক্কা’ ‘বউক্কা’ । বলতে বলতে মনে হল, ‘বউক্কা’ ‘বসা(বওয়া) হোক আজ্ঞা’র সংক্ষিপ্ত রূপ নাকি ? ভাষাবিদরা বলতে পারবেন ।
            আগে যখন করিমগঞ্জ ছিলাম, তখন সাধারণ লোককে ‘করিমঞ্জ’ বলতে শুনতাম । আমাদের পাশের একটি গ্রামের নাম লোকমুখে শুনতাম ‘ঘন্‌সামরচক’অনেকদিন ভাবতে ভাবতে মনে হল, জায়গাটা ‘ঘনশ্যামের চক’ হলেও হতে পারে
           একবার  শিলচর থেকে করিমগঞ্জ যাব, বাস ছেড়ে গেছে, একজন লোক আমাকে বলল, “‘সমু’ত যাইন গিয়া ” আমি হকচকিয়ে গেলাম । ‘সমু’ বস্তুটা কি ? যতই কলকাতা থাকি, আমি বরাক উপত্যকার মানুষ, বরাকের ভাষা জানার অভিমান আছে, আর ‘সমু’ কি জানিনা ! আমার যাতায়াতের দু-এক বৎসরের ব্যধানে দৈনন্দিন জীবনেও এমন শব্দ ঢুকে পড়ল যাকে আমি চিনিনা !আমার হতচকিত ভাব দেখে লোকটা আমাকে আঙ্গুল দিয়ে একটা গাড়ির দিকে নির্দেশ করল । দেখলাম, টাটা সুমো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকজন যাত্রী নিয়ে । তো আমিও ‘সমু’তে সামিল হলাম ।
             দিনকয়েক আগে  একটি বহুল প্রচারিত খবরের কাগজে একটা রিপোর্টে পড়লাম, আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের ‘আবেদ্দিন’ বাজারের হোটেলে কিছু বাঙালি পর্যটক আটকে পড়ছেন । যদ্দূর জানি, অ্যাবার্ডিন বাজার পোর্ট ব্লেয়ারের একটা ব্যস্ত এলাকা, যেখানে অনেক হোটেলও আছে । রিপোর্টার হোমওয়ার্ক  না করেই যেমন কানে শুনেছে তেমনি লিখে দিয়েছে, খ্রিস্টান ইংরেজ অ্যাবার্ডিন মুসলিম আবেদ্দিন(আবেদিন)এ পরিণত হয়েছে । আজকে আবার সেই পত্রিকায় দেখলাম, ‘অজগর মল্লিক নামে দুষ্কৃতীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে’। ভাগ্যিস, মল্লিক পদবিটা লাগানো ছিল! নাহলে  অজগরকে কি আর কেউ গ্রেপ্তার করেছে কোনোদিন (নিতান্তই সাপুড়ে ছাড়া)!  একটু পর মনে হল, অজগরের কপালে ‘দুষ্কৃতী’ ছাপ মারলেও শব্দটা হবে ‘আসগর’। পত্রিকার সংবাদদাতার  কেরামতি !  
             সেদিন  এয়ারপোর্ট ধর্মতলা রুটের বাসে যাচ্ছিলাম উইন্ডস্ক্রীনের একপাশে ছোট বোর্ডে রুটের মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্টপেজগুলোর নাম দেওয়া আছে, যেমন অনেক বাসেই থাকে চারটে নাম লিখা রয়েছে, বাগুইআটি, উল্টোডাঙ্গা, আলিনটন, আমাস্টিক । প্রথম দুটো তো চিনলাম।পরের দুটো নাম  চিনিনা ! অথচ এই রাস্তায় এই নম্বরের বাসে গত ষোল  বছর ধরে মাঝেমাঝেই যাতায়াত করছি । এরকম কোনো জায়গার নাম তো মনে পড়ছে না । ওহ্‌ হো, বোধোদয় হল একটু পরে যাকে আমরা ‘ওয়েলিংটন’বলি, সেটাই ‘আলিনটন’ রূপ ধরেছে । আর, ‘আমাস্টিক’ তো ফ্যান্টাস্টিক। অনেকটা চট্টগ্রামী ভাষার  সংক্ষিপ্তকরণের ধরনে আর্মহার্ষ্ট  স্ট্রিট বাসকর্মীদের মুখে এবং লিপিতে ‘আমাস্টিক’ রূপ ধারণ করেছে
                মজা লাগল, এইভাবেই তাহলে শব্দ বদলায় । উচ্চারণে যা আসে তাই লিখিত হয়ে মান্যতা পেয়ে গেলে  কিছুদিন পর শব্দ তার আসল রূপ হারিয়ে নতুন রূপ ধরতে পারে । আর, শব্দবিকৃতি নির্বিশেষ ।

কোন মন্তব্য নেই: