“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

পরিবর্তনের দ্যোতকদের চ্যালেঞ্জ



পার্থ প্রতিম আচার্য


।। পার্থ প্রতিম আচার্য ।।

আজকের পৃথিবীতে প্রতিটি মননশীল ব্যক্তি চলমান সামাজিক ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ  চান । আসলে এর পেছনে ক্রিয়াশীল জনগণের মধ্যে থাকা শেকল ভাঙ্গার আকাঙ্ক্ষা।কিন্তু যে প্রশ্নটা ভাবায় তাহলো- কি ভাবে?
            একজন শ্মশ্রু গুম্ফ শোভিত মহান দার্শনিক সোচ্চারে পৃথিবীর মেহনতিদের একদা  জানান দিয়েছিলেন সমাজকে ব্যাখ্যা অনেক হয়েছে , এখন কাজ হল তাকে পরিবর্তনের। নির্ভুল বলেছিলেন তিনি এটা সন্দেহাতীত, কেননা এই ব্রহ্মাণ্ডে যদি কোন শাশ্বত নিয়ম থাকে তা হোল - পরিবর্তনের নিয়ম। সমস্ত বস্তু জগতই গতিময়তায় রয়েছে, এটা বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত সত্য ।
          প্রশ্নটা হলো, যদি সবকিছুই নিয়ত গতিশীল যে গতিময়তা তাকে নিয়ে যায় ব্যক্তির ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে পরিবর্তনাভিমুখে তাহলে ব্যক্তির পরিবর্তনের দ্যোতক রূপে ভূমিকাটা কী? হয়তো  ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত পথে পরিবর্তন কে দেখার অভিলাষটাই রয়েছে এর পেছনে।রয়েছে এমন একটা বাসনা যাতে আসন্ন পরিবর্তন হয় সহজতর/স্বল্প আয়াসলব্ধ।(আমার পূর্বে উল্লিখিত  দার্শনিক এটা আগেই বলেছেন একটু অন্য ভাষায়।) কোন পরিবর্তন/গুণগত রূপান্তরণ যদি পরিকল্পিত কাঙ্ক্ষিত পথে ঘটাতে হয়(অবশ্যই সেটা হতে হবে প্রকৃতির পরিবর্তনের নিয়মের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে) তবে আমাদের দরকার পরিকল্পনাকারীর।সেই সব মানুষ যারা বিষয়গত উপাদান হিসেবে আসন্ন পরিবর্তনকে স্বল্প-আয়াস লব্ধ করে।(পরিমাণগত পরিবর্তন বস্তুর ঘটে চলেছে প্রতি পলে , ব্যক্তি.বিশেষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবে)।
                কিন্তু আমার মনে হয় সেই রূপ পরিকল্পনাকারী হওয়ার কিছু পূর্বশর্ত আছে।ওটা হতে হলে গতিময়তার মধ্যে অবস্থিত বস্তুটি সম্পর্কে তার/তাদের সম্যক জ্ঞান থাকাটা আবশ্যিক নয় কি? এ প্রসঙ্গে আমার অতি সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে।আমাদের রাজ্যের বিখ্যাত সাংবাদিক মানস পালের একটা পোস্ট সেদিন দেখলাম । তিনি লিখেছেন তার তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া সন্তান তাকে জিজ্ঞেস করছে----বাবা  নিবিরু মানে কি? এ বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছে।মনে হয়েছে যে এই প্রজন্মের শিশুদের ভাবনার জগৎ এর সঙ্গে আমরা কতোটা পরিচিত তা পরখ করে দেখা যেতেই পারে।সুযোগটাও আলটপকা এসেই গেলো।অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উচ্চবুনিয়াদি বিদ্যালয় স্তরের শিশুদের একটা ওয়ার্কশপে রিসোর্স পার্সন হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখা হলো ঐ বিদ্যালয়গুলিকে আদর্শ শিখন প্রতিষ্ঠানে (learning organization , google it for the detailed explanation of the term)রূপান্তরে আগ্রহী একদল ডেডিকেটেড(dedicated) মানুষের সাথে।এই সুযোগ কি আর হাত ছাড়া করা যায় ?একটা রিফ্লেক্টিভ সেশনে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত করে দিলাম--- যেমন ১)এরিয়া ৫১ বলতে কি বুঝেন? ২) জম্বি কি শুনেছেন? ৩) ইলুমিনাট্টি কি? ৪)"মানুষ কখনও চাঁদে নামেনি "--ভিডিও দেখেছেন? ৫)ডোরেমন এর গ্যাজেট গুলো কি কি? ৬)ইনস্টাগ্রাম,স্নেপচ্যাট,নিবিরু,এপোকেলিপ্স কি ? ইত্যাদি ইত্যাদি।
             (পাঠকরা দয়া করে আমাকে এই প্রশ্নগুলো করার দায়ে অভিযুক্ত করবেন না---ওখানে জড়ো হওয়া প্রায় সবই শহর বা শহরতলীর বিদ্যালয় থেকে আসা।আর এই ঘটনার উল্লেখ করা আমার প্রতিপাদ্য নয়।কেবল প্রতিপাদ্যের সমর্থনে উল্লেখ করলাম ।)
             দেখলাম অনেকেই ডোরেমন সম্পর্কে অবহিত হলেও বাকি বিষয়গুলি ঠিক জানেন না। আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো সেই শ্মশ্রু গুম্ফ শোভিত দার্শনিকের শব্দগুলো--- "যদি আপনি পরিবর্তনের দ্যোতক হতে চান তবে আপনাকে গতিময়তার মধ্যে বস্তুকে জানতে হবে।’ আমরা যদি বর্তমান প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক গঠনই না বুঝি(তা যত আবর্জনার স্তূপ দিয়েই ভরা থাকুক না কেন,বা যত ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়নের ফসলই হোক না কেন) যদি শুধু নিজেদের যান্ত্রিক  চিন্তার ধরন/দিক দিয়েই সব বিচার করি তাহলে আমরা কি পরিবর্তনের দ্যোতক হতে পারবো? উত্তরটা অবশ্যই হবে নেতিবাচক।এমনকি যে কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্যেও আপনাকে, যার ওপর পরীক্ষা চালাবেন তার ক্রিয়াশীলতাকে বুঝতে হবে -রূপান্তরণ  এছাড়া অসম্ভব ,ইউটোপিয়া মাত্র ।
           তথাকথিত উত্তর আধুনিকতার যুগে (যাকে পূর্বে উল্লিখিত দার্শনিকের অনুসরণকারী আমরা বলি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার যুগে, আমার আপনার ইচ্ছা নিরোপেক্ষভাবেই পৃথিবীটা ছোট হয়ে চলছে প্রতি নিয়ত।অর্থনীতির পরিবর্তনের পদাঙ্ক অনুসরণে সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া আজ নিয়মে পর্যবসিত।আজ থেকে দশ পনেরো বছর আগের শিশুর মননে আজ বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে,ঘটে চলেছে। আমার প্রশ্ন হলো পরিবর্তনের দ্যোতকরা যদি এই ঘটে চলা আর্থ-সামাজিক সংষ্কৃতিক পরিবর্তন ও তার ফল শ্রুতিতে ব্যক্তি মানসে পরিবর্তনকে ধরতে না পারেন তাহলে তিনি বা তারা কি তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন? তিনি/তারা যদি নিজেদের প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনমুখি প্রবণতাগুলি সম্পর্কে নিজেদের update না করেন তাহলে কি পরিবর্তনের সহায়তাকারী হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারবেন? সেটা শিক্ষা ক্ষেত্রেই হোক বা সামাজিক ক্ষেত্রে ?
তবু পরিশেষে আমি ফিরে যাই আমার মহান দার্শনিক গুরুর কাছেই আর আশা করি বস্তুগত স্থিতির পরিপক্বতার উপর। জানি ঐ অবস্থাই জন্ম দেয় কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষগুলির ওঠে আসাকে।সেই বিষয়গত শক্তি যার উত্তাপে গর্ভের সন্তান প্রস্ফুটিত হবে নতুন আশা নিয়ে --- কারণ এর কিছু জানি বা না জানি,এটা নিশ্চিত জানি ---সব অবস্থাই ক্ষণস্থায়ী মাত্র।

১৪/২/২০১৭




কোন মন্তব্য নেই: