“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১১ মার্চ, ২০১৭

হোলি, দোল, বসন্তোৎসব : উৎস ও ক্রমবিকাশ


।। অশোকানন্দ রায়বর্ধন।।
(C)Image:ছবি

মাদের দেশে হাতে গোনা যে কয়টি উৎসব প্রায় সব প্রদেশেই অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে একটি হল দোল উৎসব ৷ এটি প্রদেশভেদে নানা নামে প্রচলিত ৷ তার মধ্যে দোল ও হোলি সর্বাধিক  প্রচলিত ৷ এটি মূলত রঙের উৎসব ৷ ঋতুর উৎসব ৷ বসন্তোৎসব ৷ বসন্তের দখিন সমীরণে দোলায় প্রিয়জনকে মনের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে সমাজশৃঙ্খলার কিঞ্চিৎ শৈথিল্যের সদ্ব্যবহার করেন তরুণ তরুণীরা ৷ নবযৌবনপ্রাপ্ত নরনারীর মদনোৎসবের সমাজস্বীকৃতির নিদর্শন এই অনুষ্ঠান ৷ এক অর্থে প্রাচীন কৌমসমাজের যৌনাচারমূলক অনুষ্ঠানও এই হোলি ৷ কালক্রমে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে ৷ দোল বা হোলিকে কেন্দ্র করে দু তিনটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে ৷ প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব বা হোলিকা দহন ৷ দ্বিতীয়টি ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে পালিত রাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা ৷
স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য অংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান রয়েছে ৷  হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী ৷ দেবতার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানববিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করলেন ৷ তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত ৷তিনি বিষ্ণুকে পিতার উপরে স্থান দেন ৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন ৷ দাদার আদেশে ভগ্নী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করেন ৷ বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ বেঁচে যান কিন্তু হোলিকা অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যান ৷ হোলিকার আগুনে দগ্ধ হবার কাহিনি অবলম্বনে হোলির আগের দিন বহ্ন্যুৎসব ' হোলিকা দহন' বা 'মেড়া পোড়ানো' হয় ৷
এই উৎসবের উৎস প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কাহিনিটিও সুপ্রচলিত ৷ শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ও তাঁর সখীগণের সঙ্গে খেলা করছিলেন ৷ সে সময় অকস্মাৎ শ্রীমতী রাধা রজঃস্বলা হয়ে পড়েন ৷ ঘটনার আকস্মিকতায় রাধা সখীদের ও ব্রজবালকদের সামনে যাতে বিব্রত বোধ না করেন সেজন্যে রাধার লজ্জা ঢাকতে শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধি করে সখীদের সঙ্গে আবির খেলতে শুরু করেন ৷ এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলি উৎসব পালন করা হয় ৷এই কাহিনিরই একটু রকমফের রয়েছে অন্য আর একটি পুরাণে ৷ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, ব্রহ্মার আদেশে প্রথমবারের মতো কৃষ্ণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে রাধা ৷শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে রতিলীলায় মত্ত হলেন ৷ সারারাত কামসূত্রের চৌষট্টি কলায় মথিত করলেন শ্রীমতী রাধিকাকে ৷ আবেগঘনাবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের দশন ও নখরাঘাতে এবং কৌমার্যখন্ডনে শ্রীমতী এমন রক্তাক্ত হলেন যে সকালে লজ্জায় কুঞ্জ থেকে বেরুতে পারছিলেন না ৷ উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে র জন্যে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাঁর অনুগতদের রং নিয়ে খেলার আদেশ দিলেন ৷ সকলে যখন রঙের খেলায় মত্ত সেইসময়ে রাধিকা বেরিয়ে এসে বাড়ি ফিরলেন ৷ রঙের উৎসবের উৎসকেন্দ্রিক আরও একটি মিথ পাওয়া যায় ৷ সেটিও কৃষ্ণকে নিয়েই ৷ ছোটোবেলায় রাক্ষসী পুতনার দুধ পান করে শ্রীকৃষ্ণের গাত্রবর্ণ নীল হয়ে যায় ৷ যৌবনবয়সে শ্রীকৃষ্ণ যখন দেখলেন তাঁর গায়ের রঙ নীল আর রাধিকার গায়ের রঙ গৌরবর্ণ ৷ তখন শ্রীকৃষ্ণ হীনন্মন্যতায় ভুগছিলেন ৷ ( স্মর্তব্য:   যশোমতী মাইয়া সে বোলে নন্দলালা /রাধা কিঁউ গোরী, ম্যয় কিঁউ কালা) ৷  তাঁর এই অবস্থা কাটানোর জন্যে মাতা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে উপদেশ দিলেন তাঁর ইচ্ছেমতো রঙে রাধাকে রাঙিয়ে দিতে ৷ রাধার গায়ে মুখে শ্রীকৃষ্ণের রঙ লাগানো থেকেই হোলির সৃষ্টি ৷ অন্যদিকে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামে অসুরকে বধ করেন ৷ কোথাও অরিষ্টাসুরকে বধ করার কথা আছে ৷কোথাও আবার পুতনা রাক্ষসীকে বধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে এই তিথিকে গৌরপূর্ণিমা বলে ৷

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে হোলির বহু বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে ৷ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বসন্তরাসের বর্ণনা আছে ৷ অন্যত্র 'রঙ্গ' নামক উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ হর্ষের প্রিয়দর্শিকা ও রত্নাবলী এবং কালিদাসের কুমারসম্ভব ও মালবিকাগ্নিমিত্রমে ও বসন্তোৎসবের উল্লেখ আছে ৷ কালিদাসের ঋতুসংহার এ পুরো একটি সর্গে বসন্তোৎসবের বিবরণ রয়েছে ৷ ভারবি, মাঘ এবং অন্য কয়েকজন কবিও কাব্যে বসন্ত বর্ণনা করেন ৷ নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ ও জৈমিনী মীমাংসায় রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় ৷ তিন শো খ্রিস্টাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকোৎসব পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷বাৎস্যায়নের কামসূত্র রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে ৷ তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে ৷এখানে দোলায় বসে আমোদ প্রমোদের উল্লেখ পাই ৷ চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এই হোলি উৎসবকে শবরস্বামী তাঁর দর্শনশাস্ত্রে বর্ণনা করে গেছেন 'হোলক উৎসব' নামে ৷ সপ্তম শতকে রচিত রত্নাবলী এবং অষ্টম শতকের মালতীমাধব নাটকেও বসন্তোৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ জীমূতবাহনের কালবিবেক ছাড়া ষোড়শ শতকের রচিত রঘুনন্দন গ্রন্থেও এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে ৷ আল বেরুনির বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সামিল হতেন ৷
কবি বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে সুরদাস, রহিম,পদ্মাকর,জায়সী,মীরাবাই,কবীর এবং বিহারী, কেশব,ঘনানন্দ প্রমুখ অনেক কবির প্রিয় বিষয় ছিল বসন্ত ৷ মহাকবি সুরদাস বসন্ত ও হোলির উপর আটাত্তরটির মতো পদ রচনা করেছিলেন ৷ এ ছাড়া সুফি সন্ত হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু এবং বাহাদুর শাহ জাফর প্রভৃতি মুসলমান কবিগণও হোলিবিষয়ক সুন্দর পদ রচনা করেন ৷ এ থেকে অনুভব করা যায় যে দোলযাত্রা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানও বটে ৷আর এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটিকে আধুনিকতায় নিয়ে দাঁড় করান কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন প্রবর্তন করে ৷ যৌবনোচ্ছ্বল উল্লাসের পাশাপাশি সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক অনন্য অনুষ্ঠান ও উৎসব এই হোলি ৷

তথ্যসূত্র:   . পূজাপার্বনের উৎসকথা - ড. পল্লব সেনগুপ্ত
                         .শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ - শশিভূষণ দাশগুপ্ত ৷
                          ৩. সাক্ষাৎকার সংগ্রহ - কবিয়াল শান্তিপদ নাথ ৷বিজয়নগর, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ৷
                          ৪. কিছু হোলিগানের নিজস্ব সংগ্রহ

কোন মন্তব্য নেই: