“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০১৭

স্বপ্ন স্বত্ব


।। রণবীর পুরকায়স্থ।।
(C)Image:ছবি
মার বাবার বাড়ি আমি দেখিনি জীবনে। একশ বছর আগের এক পোস্টকার্ড দেখেছি। ১৯১১ এর ২রা অক্টোবর কলকাতা বড়লাটের অফিস থেকে পাঠানো ঠাকুরদা রজনীকান্ত দেব-এর নামে। সরকার বাহাদুর সন্তুষ্ট হইয়া তোমার মাসিক বেতন একপয়সা বাড়াইয়া দিলেন। রাউলি পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন তিনি। ঠিকানা রাউলি, পরগনা ছাতক, জিলা সিলেট।
আমার মায়ের বাড়িও দেখা হয়নি। সিলেট সিভিল হাসপাতালের গায়ে দাড়িয়াপাড়ায় জন্ম হয়েছিল মার। শহরের মানুষ মামারা দেশভাগের পরও থেকে গেলেন সিলেটে, কিন্তু থাকতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। ঘরছাড়া হয়ে ইণ্ডিয়ায় চলে আসতে হয়। পাকিস্থান হওয়ার পর এক অদ্ভুত আইনে মামাদের অর্ধেক বাড়ি নিয়ে নেয় সরকার। কর্মচারী আবাসনের জন্য। বাকি অর্ধেক কোনো রকমে বিক্রি করে লুকিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে চলে আসেন এপারে। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর ছেড়ে যাওয়া সব হিন্দুসম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি হয়ে যায়।
রাউলির বাড়ি কেউ দখল নেয়নি। সাতঘর মানুষের এক ছোট গ্রামের দখলই বা কে নেবে। কোনো ব্রাহ্মণ ছিল না গ্রামে, ঠাকুরমশাই পূজাপার্বণে আসতেন খুরমা নামে পাশের গ্রাম থেকে। খুরমা খুব দূরের গ্রাম নয়। নদীর এপার আর ওপার। একঘর মাত্র সম্পন্ন শিক্ষিত গৃহস্থ রজনীকান্ত দেব। কয়েকটি চাষি পরিবার বাকি দুই পরিবার ঘাটোয়াল তথা মৎস্যজীবী। দুঘর মাত্র মুসলমান। বাবার বাড়ির তিনদিকে তিন নদী, নদীঘেরা ত্রিভুজাকৃতি গ্রামের বাইরে ছিল ঠাকুরদার পাঠশালার দোচালা। বাবা গত হয়েছেন পঁচিশ বছর মায়ের বয়স পঁচানব্বুই, কানে শোনেন না একেবারেই, অঙ্গিভঙ্গি আর ঠোঁট-পড়াই যোগাযোগের মাধ্যম।  
দুহাজার এগারোর নভেম্বরে শত্রু-সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার আইন হওয়ায় আমার বড় জেঠুর ছেলে অনন্ত দেব খুব উৎফুল্ল এবং কৃতজ্ঞ শেখ হাসিনার প্রতি। আশি বছর বয়স্ক আমার দাজান আনন্দের আতিশয্যে জানিয়ে দিলেন এক গুড় সমাচার যা আমরা কেউ জানি না। বললেন,
--- আমার কাছে দলিল আছে বাড়ির। তুই দেখছ না একবার চেষ্টা করিয়া। শত্রু সম্পত্তি বুলে সব ফিরত দিলাইব।
--- দাজান, অখন আর শত্রু সম্পত্তি নাই, ভেস্টেড প্রপার্টি রিটার্ন অ্যাক্ট অইছে। দখল করা জমি ফেরত দেওয়ার আইন।
--- আইচ্ছা বা ঘাড়র নাম অউ গর্দনা। মুসলমানর হাত থাকি দেখ বাড়িঘর ফিরত পাওয়া যায় নি?
দাজান মূল দলিলের জেরক্স কপি আমার হাতে দিয়ে বলেন,
--- তোর তো বউৎ জানাশুনা হি দেশো, লেখক উকিল প্রফেসার। দেখ না একবার চেষ্টা করিয়া।
       দাজানের কথায় যে আমিও কম উৎসাহিত হয়েছি তা নয়। মা কানে শুনে না জেনেও চিৎকার করে বলেছি,
--- কও না গো কেমনে চিনমু তোমার দাড়িয়াপাড়ার বাড়ি?
       মা নড়া ঠোঁটের অর্থ বুঝে কিছু না বুঝে কিছু সোজা কিছু উল্টো জবাব দেয়। আমার বাবার বাড়ি উদ্ধার করতে যাওয়া নয়, আমার খুশির কারণ সিলেট যাওয়ার একটা যোগাযোগ হয়ে যাওয়ায়। আমার শালা ডঃ প্রদীপ পাল বদরপুর কলেজের লাইব্রেরিয়ান, সে তার গবেষণা পত্র নিয়ে বই করেছে দুদেশে দুটো। বাংলাদেশ বিয়ানিবাজারের কবি ফজলুল হকের প্রচেষ্টায় সিলেট বইপাড়া থেকেও বেরোচ্ছে সিলেট কাছাড়ের লোকগান।সিলেট বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়েছি আমি।
       শুভে শুভে বই প্রকাশ সমাধা হয়। প্রদীপকে বলি যথেষ্ট হয়েছে আর সাহিত্য নয় সিলেট প্রবাসের কদিনে। বইপত্রর সুহৃদ শুভেন্দু ইমামকে বলি,
--- পরিচয় খুজাত আইছি। আমার মার বাড়ি খুজমু শহরো, আর বাবার বাড়ি গ্রাম রাউলিত।
       শুভেন্দু বলেন,
--- সব অইব।
       শুভেন্দুর যেমন বলা তেমনি কাজ। শুধু মাঝখানে একটি দিনের প্রস্তুতি। দুদিন পর ভোরের বেলা দুয়ারে প্রস্তুত গাড়িমস্ত বড় টয়োটায় আমি আর প্রদীপ সওয়ার। জানি না কোথায় যাব কারণ সিলেট এসে আমরা কার্যত রাজবন্দী। শুভেন্দুর প্রথম ফতোয়া ডলার ভাঙানোর অপচেষ্টা চলবে না। হোটেলের বিল দেওয়া চলবে না, গাড়িভাড়া দেওয়া চলবে না, চলবে শুধু প্রতি রাতে সুহৃদবাড়ির আতিথ্য গ্রহণ। এমন বিপাকগ্রস্ত অবস্থায় আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছয় নয়া সড়কে। দূর থেকে তিন তিনটে চেনা মুখ হাত দেখিয়ে গাড়ি থামায়। সর্বাগ্রে মালেকুল, সবশেষে দলনেতা কবি মোস্তাক আহমেদ দীন আর মাঝখানে আলাভুলা জুনাইদা। মালেকুল জুনাইদ-এর বাড়ি খুরমা। খুরমা থেকে হাউক দিলেই বাউলি। বাবা বলেছেন হাউক মানে হাঁক। খুরমা নাকি একটি হাটের মিষ্টান্ন পদ। ওরা গাড়িতে উঠে বসতেই মালেকুল জানিয়ে দেয় ভ্রমণ সূচি। সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে দ্বিপ্রাহরিক আহারের বিরতি খুরমা গ্রামে। আমি বলি,
--- আর রাউলি?
জুনাইদ হাসে। বলে,
--- দূর আছে। গাড়ি যাইত নায়। তিন তিনটা নদী পার অনি লাগব।
জুনাইদ-এর রহস্য-কথা ধামাচাপা দিয়ে মুস্তাক হাসিমুখে বলে,
--- মাদানির কথা মাদানে অইব নে, অখন পতা খাওয়া অইত নানি?
       নয়া সড়কেই এলাহি প্রাতরাশের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তারপর সোজা সুনামগঞ্জ। শহরের প্রবেশপথে বিশাল তোরণ, তোরণে হাসন রাজা। আমাদের একমাত্র গন্তব্যও রাজার বাড়ি লক্ষ্মণশ্রী। সুরমা নদীর গায়ে গায়ে এগিয়ে যায় গাড়ি। গাড়ির সাতজোড়া চোখের দশটি তো এমন দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত। ঢাকায় বুড়িগঙ্গার সদরঘাটে রিক্সাগাড়ির মতো নৌকোর ট্র্যাফিক দেখেছি আমি। আর অবাক বিস্ময়ে দেখছি সুনামগঞ্জ। জুনাইদ আমাদের বিস্মিত দৃষ্টি দেখে বলে, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর উজানেও থাকে ভাটির টান। তাই তরতরিয়ে নৌকো চলে দুদিকে। কথার ভিতর কী রহস্য দিয়ে যে কথা বলে জুনাইদ, ধরতে পারি না। এ যেন বীরভূমের বাউল পরম্পরার কথা, অমাবস্যায় চাঁদের উদয় যেমন। আমাদের জুনায়েদ কবি ও বাউল। শুভেন্দু বলেছিলেন,
--- ইসলামো সংস্কারর কুনু জাগা নাই। জুনাইদর বাপ জুবের আহমেদ আছলা মরমিয়া বাউল, ধর্মর নিয়ম কানুনর বাইরো গিয়া বান্দছিলা পদ। গানর আসরোউ খুন ওই গেলা।
       সেই বাউলের পুত্রও কবিতায় গায়,
আমি কিন্তু
বেহায়া দরজা খুলে মল্লার রাগে গান গাইতে পারব না।
       আমাদের পাঁচজন পথপ্রদর্শকের প্রধান মুস্তাক আহমেদ দীন এম সি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। কলেজে তার বিভাগের কমনরুম থেকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখান,
--- ওউ দেখইন আমার শ্রেণীকক্ষ, ওখানো পড়াই। আমার ছাত্র হকলর নাম হুনতানি? ওউ বেঞ্চির ইদিকে বইন প্রবোধ চন্দ্র সেন আর হদিকে নীহার রঞ্জন রায়। আমার ছাত্র তারা, ভাবইন চাইন?
       রহস্য ঘেরা এই আত্মপরিচয়টা কী নিতান্ত অশ্লাঘনীয়। কথা ও হাড়ের বেদনার কবি দীন, কবি ও কবিতার কাগজ মুনাজেরার সম্পাদকও বটে। গাড়ির ভিতরই শুনছিলাম কবির দুলাইনের এই কবিতা,
নগর পুড়ছে তারপর দেবালয় বেঁচে গেল দেখি!
শরীর পোড়ার পর যেরকম রয়ে যায় শরীরের শাড়ি।
গন্দমপত্রিকার সম্পাদক মালেকুল হক-এর হাতে দামি ক্যামেরা। ঝোলায় তার দামি ল্যাপটপ। টুপটাপ সর্বক্ষণ ছবি তুলে যাচ্ছে আমার। একদিনের প্রবাস সঙ্গী প্রিয়ভাষী এই যুবক ছবির স্মৃতি সাজিয়ে দেয় তার এসডি কার্ডে। সাধুবাদ জানাতে গেলে সে কবিতায় দেয় স্পর্ধিত উত্তর,
      এইভাবে, আমি প্রতিদিন সূর্যমন্দির বানাই নদীবর্তি বালি দিয়ে।
       আমার চালক মোক্তার ভাইও যখন তখন গিয়ার নিউট্রাল করে দেখায় হাওর, লণ্ডনি মসজিদ, গোবিন্দগঞ্জে চা খাওয়ায় নিজের পয়সায়। বলে,
--- আপনারা অইলা মেহমান, বড় বড় মানুষ, মনো রাখন লাগব নানি? আপনারার লগে রাস্তাত উবাইয়া চা খাইছি। কম কথা নি?
       জাউয়ার  বিখ্যাত বাজার দেখিয়ে শুনিয়েছে মজার কথা। এককালে ঠগের বাজারে ছিল জাউয়া। হাটুরেরা ভয়ে ভয়ে বলত, “জাউয়া গিয়া আউয়া অইয়া আইলাম।প্রযুক্তিহীন সেই সময়েও দন্তহীন গরুর মুখে দাঁত লাগিয়ে বেশি দামে বেচে দিত।
       আর একজন ছিল আমাদের সঙ্গে, বইয়াখাউরি থেকে উঠেছে। সাহিত্য সঙ্গ লোভী, মিষ্টি মানুষটির নাম ভুলে গেলেও তাকে ভুলব না স্বপ্নভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে মনে থাকবে। এরা সবাই যে আমার পিতৃভূমির মানুষ। এরা সবাই বড় ভাল মানুষ, বড় আলাভুলা। যদিও প্রশ্ন থাকে, তাহলে কেন হল দেশভাগ, কেন গণভোট। কে একজন অমিতাভ কবি গেয়েছিল আক্ষেপের গান, “আকাশটাকে দুভাগ কর দেখি।একটাই তো নদী বরাক তার মিঠে জল ছড়িয়েছে কুশিয়ারায়, বিবিয়ানায় আর সুরমা হয়ে নয়নের মণি সুরক্ষিত রেখেছে জেলা জুড়ে।
       বাবার কাছে শুনেছি ছাতক যাওয়ার রাউলি যাওয়ার কোন সরাসরি রাজপথ ছিল না, জলপথই ছিল শহর সিলেট কিংবা সুনামগঞ্জ যাওয়ার একমাত্র সাধন। বর্ষায় মাটি খুঁজে পাওয়া ভার সুনামগঞ্জে, হাওর নদী খাল সব একাকার হয়ে সাগরের রূপ নেয়। বিচিত্র সব জলাশয়ের নাম এখনও বাল্যস্মৃতিতে সাঁতার কাটে। দেখার হাওর ডেকার হাওর রানির হাওর টেংগুয়া হাওর আর মায়ের মামার বাড়ি মৌলভীবাজারের কাউয়া দিঘী নাকি সৌন্দর্যে সবার সেরা। মা বলত ছাতক তাও শুকনো, ছাতকে অনেক পাহাড় পর্বত মেঘ বৃষ্টি। ডাউকের গুল পাহাড়ে বৃষ্টি হয় বারোমাস। বাবা বলত, আমাদের বাড়ি দক্ষিণ ছাতক, নাইওর খালের পারে পারে যেতে হয় বাড়ি। বর্ষায় ছই দেওয়া নৌকায়। তখন আমাদের গ্রামঘেরা তিন নদী ভটরখাল মহামায়া আর চন্দনি একাকার। এভাবে জলবন্দী হয়েই কেটেছে বাবার শৈশব। সিলেটের কথা, আর না দেখা রাউলি গ্রামের কথা বাবা যত বলত, মা বলত সব থেকে বেশি। দেশভাগের বেদনায় কাতর হত মা। উদ্বাস্তু হয়ে বাজারিছড়া গ্রামে আসার পর মাকে দেখতাম চন্দনি রাতের উঠোনে গলা ছেড়ে মিহি কণ্ঠের গান গাইতে। মা গাইত,
      কে যাওরে ভাটি গাঙ বাইয়া।
       মা থামত এক কলিতে টান দিয়েই। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। সেকালে রাতের বেলা গলা ছেড়ে গান গাওয়া কোন গৃহবধূর পক্ষে শোভন ছিল না। তবে আমাদের বাড়ি থেকে তো পড়শি বাড়ির দূরত্ব অনেকখানি। এক টিলার ওপারে। ছোট আমি ওসব বুঝিনি। শিশুমনে একটা অপার্থিব আবহ তৈরি হতো। উঠোনের গায়েই একটা নাইওর-খালের কুলুকুলু ধ্বনি সাজিয়ে দিত মা। জলের ছলছলাৎ আর বৈঠার ছপছপাৎ। ঠাকুমার ধ্যান সন্ধ্যা ভেঙে যেত। উঠে এসে বসতেন মূর্তা বেতের চাটাই-এর উঠোনে। মাকে বলতেন,
--- গাও গো বউ, গাও না, আমরা তো রিফ্যুজি, কে কিতা কইত, গান গাইয়াউ আমরা দুঃখ ভুলতাম।
       ঠাকুমা চলে যেত অন্য কথায় অন্য বিস্মৃতি খুঁড়ে বের করত। বলত,
--- তোমার মই-হড়ির গলাও আছিল চিকন। তাই তো আইল না। আছে না মরছে কে জানে?
       আমার ঠাকুমার ছোটবোন কিরণশশীকে আমি দেখিনি। কিন্তু জানি, আমাদের ছিন্নমূল পরিবারের সবকিছু এখনও ঠিক করে দিতে পারেন অনুপস্থিত মেজদি। আমার ঠাকুরদার প্রিয় শ্যালিকা। দেশভাগ হতেই ভাগের মা বাবা ঠাকুমা চলে এল এদেশে। মেজদি এল না, ঠাকুর্দাকে দেখিনি আমি, মা বলেছে দাঙ্গায় মৃত্যু হয় তার। বারোমাস রাউলির আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা চলত আমাদের সোনা-রূপা চা বাগানে, তাই মায়ের যাওয়া হয়নি রাউলি। রাউলি না গেলেও শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সবার প্রিয় ছিলেন মা। মাও ভালবাসতেন সবাইকে। মা এখনও বিশ্বাস করে মেজদি বেঁচে আছে, কম করেও যার বয়েস এখন একশ দশ। মেজদির মধ্যে কী ছিল কে জানে, তার কথা উঠলেই মা-র মন বিষণ্ণ হয়ে যেত। মা দুঃখের গান গাইত। জলভরা চোখে গাইত,
      আমার ভাইরে কইও গিয়া নাইওর নিতা আইয়া
       মায়ের চোখে জল চিকচিক করত। আমি কিছু বুঝতাম, কিছু না। বুঝতাম না সে-কী  দেশভাগের জ্বালা, না কোন অকহনীয় কথা। মাকে অনেকদিন মেজদির কথা বলেও কোন জবাব পাইনি। মা চুপ করিয়ে দিয়েছে। সবাই বকত, ঠাকুমা ছাড়া কেউ প্রকাশ্যে নাম পর্যন্ত নিত না। বাবা মাঝে মাঝে ভুলে যেত, রাউলি গ্রামের গল্প বলতে গিয়ে শোনাত এক সর্বকর্মে পারদর্শী মহিলার কথা। বাবা বলত,
--- ভটরখালো মেজমাসি জাল নিয়া নামত উঠত গিয়া চন্দনি। সাঁতার দিত মাছ মারত, আমরার রাউলি বাড়ি চলত তান কথাত।
       আমি মাকে বলতাম,
--- তে তোমার কথাউ কও। কেউ যখন তোমার মেজদির কথা কইতায় নায়। কও তুমি কেনে গান গাইয়া কান্দো।
       মা বলত,
--- আমি লুকাইতাম পারি না, এর লাগি কান্দি, গাই। গানর সুরে সুরে যাই গিয়া স্বপ্নর দেশো। নাইওর-খালো। তখন তো অত ভালা সড়ক-উড়ক আছিল না। গাউত যাওয়ার একমাত্র উপায় নদী আর খাল। সুরমা বড় নদী, বউত দূরর মা-নদী, সুরমার কত ছাওয়াল। আমরার নাইওর-খালও নদী। নাইওর নেওয়ার পানসি ডুবছিল এর লাগি খালর নাম।
       মাকে বলেছিলাম,
--- খালর পানিত পানসি চলত?
--- কালা নৌকাত ছই লাগাইল থাকলেই গাউ-আলা মাইনসে কইতা পানসি।
       বাবা শুনে শুনে হাসত। কারণ বাবা জানে আমার রাউলি বাড়ির যতটুকু জ্ঞান মায়েরও ততটুকু। আমার মা শহরের মানুষ। সিলেট দাড়িয়াপাড়ার মোক্তার বাড়ির মেয়ে। বাবা জলঢুপের সোনা-রূপা চাবাগানে চাকরি করত। বাবা বছরে একবার যেতো দেশের বাড়ি। মাকে নিয়ে যায় নি কখনও। বলত,
--- থাকতায় পারতায় নায় একবেলাও।
       ফিরে এসে বাবাও সাজাত দেশের বাড়ি। কত রকমের গল্প। কত ধরণের শাকসব্জি, ফলমূল, মাছ, পাখপাখালি মানুষ জন। বাবা বলত ভুলু মামার গল্প, বলত রঞ্জু নামে তারও এক বন্ধুর কথা। বলত,
--- আমার গাউত কেউ বাদুয়া মানুষ নাই, সব ভালা।
       আমি বাবাকে বলতাম,
--- তোমার কোন মেয়ে বন্ধু আছিল না?
       মা শুনে হাসত। বাবা বলত,
--- আছিল তো! হাসিরে লইয়া আইছলাম বাগানো, রঞ্জুর বইন। তোর মায় খেদাই দিল।
       আমি মাকে বলি,
--- কেনে কেনে মা, খেদাই  দিলায় কেনে? বাবার বন্ধুনিরে দেখতাম।
--- দেখার মতো কিছু আছলা না তোমার হাসি পিসি।
--- তে?
--- তে আর কিতা। সারাদিন কেউ একটা মানুষরে নাম ধরি ডাকলে নি ভালা লাগে কেউর?

       ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমার কৌতূহল শুধু ভুলু মামা নয় রঞ্জু কাকু কিংবা হাসি পিসি নয়। আমার জানার আগ্রহ পিতার দেশ আর তার লোকজন নিয়ে। বাবাকে বলি,
--- তোমারর দেশ তো পাকিস্তান অই গেল, সব মুসলমান। তোমরার গাউত কুনু মুসলমান আছিল না?
--- না একজনও না।
--- সব হিন্দু?
--- কী জানি? হিন্দু কিতা জানতাম না, মুসলমানও না।
--- তে?
       বাবা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকে। বলে,
--- জানছি বড় অইয়া। আমার বাবারে মারল গোবিন্দগইঞ্জ বাজারো। বড় হওয়ার বড় বিপদ বাবা। বড় অইয়ো না। আমরার গ্রামো সাতটা মাত্র বাড়ি, আমরারটাউ বড়। কুনুমতে, খাওয়া পরা চলত। হালুচা আর পাটনি কয়েক ঘর।
---  মাত্র?
--- আর কিতা থাকত কও। সবে গপ মারে তারা জমিদার আছিল। আমরা কিচ্ছু আছলাম না। খেতর জমি আছিল। সুপারি গাছ আছিল, নাইরকল গাছ আছিল।
--- আর?
--- আর কিতা? ভুবি, লুকলুকি লাটা লেওইর, সপরি, আম, কাঠল। আম-উম লইয়া আইত ভুলুয়ে। তোর মারে ডাকত দিদি। আমো পুকা থাকলেও কি মিস্টিরে! মালদই আমও হার মানত।
--- তোমার বন্ধু রঞ্জু আইতা না আর?
--- না।
--- কেনে?
--- আছে ইতা বউত্‌তা। কইলাম নু তোর মায় দেখতা পারতা না!
       মা শুনে হাসত। বাবা বলত,
--- বিয়ার পরে রঞ্জু আইলে তোর মা কী খুশি অইত।
--- খুশি কেনে? সিম বরই আনতা এর লাগি?
       মা বলত,
--- তখনকুর দিনো কিতা ইট সিমেন্টর বাড়ি আছিল নি? বাড়ির চাইরদিকে মাটির দেওয়াল। বর্ষার সময় ভাঙ্গি যাইত, আবার উঠানি অইত। কত মানুষ আছিল বাড়িত। বড় জেঠা, ছোট জেঠা, পিসি দুইজন, মাসিও আইয়া থাকতা কিরণশশী। একান্নবর্তী পরিবার, অখন বুঝতে নায়। শ্বশুরমশাই থাকি জেঠাশ্বশুররে ডরাইতাম। আদরও দিতা বেশি। আর তোর বাপরও আছিল উদ্ভট কাণ্ড কারখানা।
--- কেনে? কিতা করতা?
--- একবার কইলা পুই মাসির বিয়াত লই যাইতা হাসিরে।
--- বালাউত্ত বন্ধু-উন্দু না থাকলে বিয়া বাড়িত মজা নাই।
       আমি বাবার মামাবাড়ির নাম শুনিনি। মাকে বললাম,
--- বাবার মামার বাড়ি কই? সিলেট?
       যখনই আমি আমাদের বাড়ির কথা শুনতে চাই, তখনই মা কিংবা বাবার মধ্যে একজন কথা বললে অন্যজন হাসে, না হয় ভুল ধরে। এবারও তাই হয়। বাবা বলে,
--- পুই মাসির বিয়ার সময় তুমি কই? বিয়া অইছে নি?
       মা দমবার পাত্রী নয়। বলে,
--- আমি শুনছি তোমার কীর্তি। পুই মাসিউ কইছইন।
       আমি গল্পের সূত্র ছাড়ি না। বলি,
--- হাসি পিসি গেছলা ?
       বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে বলেছিল,
--- না রে। তখন তো ছোট আছলাম, বুঝতাম না।
--- কিতা বুঝতায় না?
       বাবা মা দুজনই চুপ করে থাকত। কিছুই বুঝতাম না। তাই ভান করে প্রসঙ্গান্তরে যেতাম। বলতাম,
--- ও বুঝছি। তোমরার যে বাসাত অতজন মানুষ, খাওয়ার ডাক পড়লে কিতা করতায়?
       মা বলত,
--- অতজন কই? দেশবাড়ির পাকঘর তো আমরার লাখান নায়। দশ-পনরজন বইয়া খাইতা পারতা। সকালেউ পিড়ি ধইয়া টাল করি রাখা অইত।
       বাবাকে বলতাম,
--- তোমরা কতজন আছলায় বাবা? একশ না কম?
       মা বলত,
--- অত গণাগণি করতনি কেউ, অউ অইব আরি।
       বাবা হাসত। আমি বলতাম,
--- অত ধান চাউল সব্জি হইত ক্ষেতো?
--- হইত রে বাবা। আমরার গ্রামর মতো ধানক্ষেত নাই ছাতক পরগনাত। কত রকমর ধান, হরিনারাইন শাইল ইন্দ্রশাইল কালাজিরা বিরইন ধান আর উষনা তো কত কিছিমর। শাকসবজির লাগি মা-তারার বিচরা আছিল পাকঘরর পিছে। সারা বছরর আলু মিঠালাউ কুমড়া থাকত উগার-ঘরো। আমর আচার সত্ত্ব আমসি দেওয়া অইত। মূলা শুকাইয়া শুটি করি রাখা হইত শ্রাবণীর লাবড়ার লাগি। মনসাপূজা হইত নানি। বাবায় করিমগঞ্জ থাকি গুরমি আনাইতা, নাচ গান পাঠ হইত মনসামঙ্গল।
--- মাছ খাইতায় না?
--- মাছর লাগি পুকইর আছিল। পুকইরর থাকত রউ বাউস চেং মাগুর। পুকইরর আর নদীর মাছ ধরত লাটাই পাটনি আর ইদ্রিশ মিয়ায়। দুইঘর মাছ-আলা। আমরার গ্রাম আছিল দুর্গর লাখান। পানির দুর্গ। তি-কোনা গ্রাম তো, তিনদিকে তিন নদী। ছাতক আর মাধবগইঞ্জ যাওয়ার দিকো আছিল মহামায়া। নৌকো লইয়া উবাই থাকত লাটাইদা। তারা না থাকলেও ইবাড়ি হিবাড়ির পুয়াইন্তে বৈঠা লইয়া আইত। হাউক হুনলেউ অইল। বাবার পাঠশালার গাত ভটরখাল আর বিছরাবাড়ি গাউর হারিছ চধরির বাড়ির দিকে চন্দনি।
--- কী সুন্দর নাম নদীর?
       মা হাসতে হাসতে বাধা দেয়। বলে,
--- হুন। তোর বাবায় একবার চধরিচাচারে কয় কিতা জানছনি? কয়, তোমরা আমরার লগে পাল্টাপাল্টি করি লাও, আমার চন্দনির ধারো থাকার ইচ্ছা।
--- তেউ? অইছিল নি পাল্টাপাল্টি?
       গল্পের লোভে আমারও চোখ লোভে চকচক করত। আহারে, চন্দনি নদীর পারে যদি হতো আমাদের বাড়িটা। কিন্তু বাবার মুখটা বিষাদগ্রস্ত দেখে দমে যাই। যদিও বাবা বলেছিল,
--- অইছিল।
       মাও অনেক কষ্টে হাসিমুখ ফিরিয়ে এনে বলেছিল,
--- হুনছ না, কে আছিল জানছ নি চধরি চাচা? তোর হাসি পিসির বাপ।
       বাবা রাগ করে মাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল,
--- বাদ দে তোর মার আজারি মাত। গেছে নি কুনুদিন দেশো। দেখছনি দেশভাগ। সোনা-রূপাত থাকিয়া তাইন রিফুজি!

       আমার মায়ের দুটো দেশের বাড়ি। একটা না দেখা শ্বশুরবাড়ির গ্রাম রাউলি অন্যটা নিজের জন্মভূমি দাড়িয়াপাড়া। আমার মায়ের শৈশব। মায়ের গর্ব তাঁরা সাধুহাটির দাম। আমার দাদু রাকেশ মোক্তারের বাড়িতে মস্ত বড় লোহার গেট। দামবাড়ি লেখা লোহার গেট বিস্তর খুঁজেছি আমরা। আমি আর কবি মোস্তাক আহমেদ দীন। দীন বলেছে,
--- অত পুরানা গেইট কিতা থাকব নি? জং ধরিয়া শেষ হই গেছে। কম দিনের কথা নায়। এক কাম করইন দাদা, পুকইর তো পাইছন একটা হাসপাতালর ধারো, মোবাইলো উঠাই লাইন ফটো। মাসিমা খুশি অই যাইবা।
       আসলে মায়ের কথা মতো কিছুই মেলে না। মা বলেছিল হাসপাতালের গায়েই পুকুর। কিন্তু আমার মন মানছে না, মায়ের মুখ থেকে যেমন যেমন শুনেছি তেমন তো নয়। মা বলেছিল সরকার দখল করেছিল অর্দ্ধেক বাড়ি। বাকি অর্ধেক তো থাকবে। এক ধোপার দোকানে দেখি লেখা দীনবন্ধু লন্ড্রি। দীন বলে,
--- দেখইন হিন্দু দোকান দীনবন্ধু। কইত পারে।
       কম বয়সী ছেলেটি কিছুই বলতে পারে না। তবু আমি বলি,
--- আমার দাদু রাকেশ দাম, মোক্তার আছলা। তান তিন পুড়ি এক পুয়া।
       ছেলেটি আমতা করে। বলে,
--- দাম শুনছি। এক দাম-বাড়ির কথা। অউ গল্লির ভিতরে চৈতন্য পালর বাড়ি, তান মা আছইন বুড়া। কইতা পারবা।
       আমার থেকে তো কবি দীনের উৎসাহ বেশি। গলির ভিতর গিয়ে বের করে এক বৃদ্ধাকে। মনে হয় যেন ঠিক জায়গায় এসেছি। মায়ের থেকে বয়স কম। বলি,
--- আমার মায়ের নাম অরুণা। দা দা ম...
       না, হয় না। তিনি নিরাশ করেন। কুড়ি বছর পর বিলেত থেকে ফিরেছেন। তাই নাকি সব পাল্টে গেছে।
       দীন কী জানি কী একটা অঙ্ক করল। বলল,
--- অইত নায়। মাসিমা থাকি পনর বছরর ছোট। চিনার কথা নয়। চলইন।
       তবু বেরিয়ে আসার মুখে একটা মোক্ষম সূত্র দিয়ে দিলেন মহিলা। বললেন,
--- বাবার কাছে হুনছিলাম। হাসপাতালর গাত আছিল একঘর। বিক্রি করি গেছইন-গি।
--- অয়। সরকারে নু রিকুইজিশন করি নিল-গি আধা বাড়ি।
--- ফাত্তা শেখে কিনছিলা। হাত বদল অইতে অইতে অখন ব্যাঙ্কর হাউজিং।
--- সোনালি ব্যাঙ্ক নানি? দেখছি।
       মায়ের বাড়ির জীবন্ত স্মৃতি তো আর উবে যাবে না। আমি সেই সময়ে ফিরে যাই। মা বলত ফাত্তা শেখ আর আনসার আলির কথা। বলত,
--- আমার দুই কাকা। বাবার দুই মরির। বিরইন চাউল দিতা পৌষ-মাসো, কালিজিরা হরিনারাইন দিতা। চুঙা দিতা পিঠার লাগি। নেরা লইয়া আইতা ফাত্তা চাচায়, কইতা হাকরাইতর দিনতো তোমরা মেড়া-মেড়ির ঘর বানাও পুকইর পারো।
       মায়ের চোখ ছলছল করত। তবু বারবার বলা গল্প আবার বলত,
--- আমি তখন লেখাপড়া শিখিয়ার। ইন্দুমতী ইস্কুলো ফাস্টবুক পড়িলাইছি। আমার বাবা মোক্তার অইলে কিতা অইব খুব লাগালাগি করতা বাড়িত। একদিন বাবায় কইলা, কও চাইন দেখি কিতা শিখছ ইংলিশ, ইফ যদি ইজ হয় হোয়াট অর্থ কী?  আমি কইলাম অত সহজ কোয়েশ্চন, আনসার চাচারে জিগাও তাইনঅউ আনসার দিলাইবা। বাবা আর তান দুই মরির খুব হাসছিলা। পাকিস্তান হওয়ার পরে আর আনসার চাচারে দেখছি না। ফাত্তা চাচায় তো  কিনি নিলা অর্ধেক বাড়ি। হিন্দুর সম্পত্তির যে দাম তার থাকি কম দিছইন না।

       কবি দীন মারফৎ আমাদের দাড়িয়াপাড়া অভিযানের খবর পৌঁছে যায় বইপত্রয়। বিকেলের আসরে একটি ক্ষীণকায় যুবক নিজেকে ফাত্তা শেখের নাতি বলে ঘোষণা করে। বলে,
--- আমি জুনাইদ। আপনার মার চাচার নাতি।
আমি বলি,
--- চলো তো দেখাই দেও বাড়ি।
       ছেলেটি বলে,
--- দেখাইমু। তার আগে কইন আইছন তো তিনদিন। আমার লাগি কিতা আনছইন?
       আমি অবাক হই। চেনা নেই জানা নেই বাইশ তেইশ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বলে কি না আমার জন্য কী এনেছেন! আমিও বলে ফেললাম রাগে,
--- বুক ভরা হাহাকার।
       সপ্রতিভ ছেলেটিও অবাক। বলে,
--- কেনে?
--- কেনে কথার উত্তর নাই। বুঝতায় নায়। বাস্তুহারার কষ্ট তো আর দেখছ না, বুঝবায় কেমনে? আমার কুনু মাতৃভূমি নাই।
--- এ ইতা আবার কেমনে? ইণ্ডিয়া থাকি তো আইছইন?
--- ইণ্ডিয়া নামর এক নেশন দেশ থাকি আইছি। আমি ভারতীয়। ইতা নেশন বা দেশর অর্থ বুঝি না।
       প্রত্যুত্তরে ছেলেটি ব্যতিব্যস্ত হয়, অসহায় হয়ে বলে,
--- আমি ফাত্তা শেখর নাতি নায়। দীনভাই-এ কইলা তো গফ।
       আমি বলি,
--- আমি জানি, বুঝেছি। আমি আইছি শিকড়র সন্ধানো। পিতৃভূমি দেখার লাগি।
--- কই পিতৃভূমি?
--- গ্রাম রাউলি পরগণা ছাতক মহকুমা সুনামগঞ্জ জিলা সিলেট।
--- অখন সব বদলি গেছে। পুরানা সুনামগঞ্জ জেলা আর নাই , ছাতকও অখন উপজেলা।
--- ও রাজনীতির উপরে রাজনীতি? ইচক দানা বিচক দানা! ভুগলরে খালি পুকায় খায়। কুন সময় ধর্মর পুকা কুন সময় ধনসম্পত্তির পুকায়।
--- চলইন তে পুকা মারিয়া আই।
--- কই?
--- আপনার পিতৃভূমি রাউলি।
--- রাউলি কই জাননি?
--- চিনি। আমার আর মালেকুল ভাইর বাড়ি খুরমাত।
--- খুরমার লাগাউও।
--- ইবার কিন্তু হাচা কইয়ার। শুভেন্দু ভাইরে কইছলা নানি, আমরা সাবরেজিস্টার অফিসো খবর নিচি। আপনার দাদু রজনীকান্ত দেবর নামত-অউ আছে নামজারি। ষাইট বছর খাজনা বাকি।
       আমি তো হতভম্ব। এ কী করে সম্ভব। বলি,
--- অ্যাঁ! কেমনে জানলায় অত তাড়াতাড়ি?
--- রাউলি তো ছোট গ্রাম। মাত্র কয়েক ঘর বাসিন্দা।
--- অয় তখন আছিল সাত।
--- রেজিস্টারো অখন-ও সাত-অউ। গেলেউ দেখবা।
--- কিন্তু যারা বসবাস করছে, তারা যদি দেখিয়া ভাবে অন্যতা।
--- দখল নিতা আইছইন?
--- যদি ভাবে?
--- নিবা দখল। কেউ কিচ্ছু কইত নায়।

       আসলে নামজারির খবরে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি। এ যেন আলাদিনের প্রদীপ। আশি বছরের দাজানের লোভী মুখটাও মনে পড়ে। খুব খুশি হবে, আসল দলিল নিয়ে চলেও আসতে পারে। আমিও সুনামগঞ্জের হাসনরাজার বাড়ি দেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। ভাবি মহামায়া ভটরখাল চন্দনি পরিবেষ্টিত এক সাজানো বাগান কথা। যার এক অংশের মালিকানা এখনও আমার উপর বর্তায়। পিতৃপুরুষের ভিটে বলে কথা। মালেকুল হককে তাগাদা দিই। বলি,
--- রাউলি কোন সময় পৌঁছমু?
--- বিকাল অই যাইব। আইচ্ছা কাইল থাকি একটা কথা আমার মাথাত ঘুরের। জবাব দিবানি?
--- কও না।
--- আপনে কেনে পিতৃভূমি কইলা? মাতৃভূমি কইলা না কেনে?
--- জানি না বা। সবেউ কয় পিতৃভূমি। কি জানি অভিমানও অইত পারে। মাতৃভূমির টান বেশি এর লাগিনি না ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রণা ঢাকার লাগি? তোমার কিতা মনে অয়?
--- আমি কিতা কইতাম। আমরা তো ইতা জানি না। ষাইট বছরর উপরে পার অইগেছে মনো রাখছইন কেনে? আপনার পুয়ার ভিতরেও ঢুকাই দিছইন নি?
--- না, তারা নতুন প্রজন্ম, তোমরার লাখান। তারার মাতৃভূমি ভারতবর্ষ পিতৃভূমিও ভারত। যেলাখান তোমরা বাংলাদেশি। আমরা অইলাম সভ্যতার অভিশাপ।
--- ইতা বাদ দেইন, আমরা তো আছি। আইচ্ছা আপনে গেছইন নি রাউলির বাড়ি?
--- না।
--- জানইন নি কি রকম আছিল বাড়ি?
--- জানি। আমার মায়ে কইছইন। গোলাভরা ধান পুকইর ভরা মাছ বিচরা ভরা সবজি ঘর ভরা আত্মীয়-কুটুম।
--- ভুল। কিচ্ছু আছিল না কুনুদিন, অখনও নাই। দারিদ্র্য আছে। আপনারা তো পাল্টাপাল্টিও করছইন না। কে নিত ই নিচা জমি, পরতি বছর বন্যায় সব ভাসাই নেয়, আবার গড়ন লাগে। চলইন দেখবা। কেউ কাড়িয়া নিছে না কিচ্ছু। চলইন ফিরাই দিমু সব।
--- কিতা ফিরাইবায়? আমার একান্নবর্তী পরিবার ফিরাইবায়? আমার মার স্বপ্ন ফিরাইবায়?  মা স্বপ্ন দিয়া সাজাই-ছইন রাউলি গ্রাম। বাবার জন্ম রাউলিত বাবায় যত জানইন মায় জানইন তার থাকি বেশি। মা গেছইন না কুনুদিন। আমিও না, মায় যত সাজাইছইন আমি তার থাকি তিন চাইর বছর কম। আর ভাবছি যাইমু একদিন, পিতৃ-পিতামহর দেশো।
--- অখন অইছে সময়, চলইন।
--- যাইমু যাইমু। অখন আমরার বাড়িত কে আছইন জানো নি?
--- জানি। সুভান মিয়া। মৃণাল সেন-এর ছবির মতো ফুটা চাল বাইয়া শনপচা জল পড়ে বাদলির রাইত।
--- ই তো বুঝলাম দারিদ্র্য। কিন্তু আমরার বাড়িত সবসময় সুভান মিয়াউ থাকে কেনে? একউ গল্প কেনে সবে লেখে, একটা ব্রাহ্মণ পরিবার তো থাকত পারত, কুনু কায়স্থ ধর কর পুরকায়স্থ বা গোবিন্দ পাটনি?
--- তাইলে তো দাদা গল্প হয় না, সংখ্যাগুরুর শাসন হয় না। বর্ডার হয় না, পাকিস্তান হয় না। বাংলাদেশ হয় না আশায় আশায়। বাঙালি অখনও ভাবে শেরে বাংলা থাকলে ইতা অইল না নে।
--- হিপারোও ভাবে নেতাজি আইবা দুই বাংলা এক করবা। আমরার পরিবারো জানোনি একজন মেজদি আছলা, আমার ঠাকুমার ছোট বইন। বাবার মেজ মাসি কিরণশশী। দেশভাগের সময় কিরণশশী রিফুজি অইয়া গেছইন না ইণ্ডিয়াত। তে তাইন কই গেলা? কেউ জানতও চায় না কোন বাড়ির বিবি অইয়া তাইন থাকি গেলা? তান নাম শুনত পারে না কেউ আবার পরিবারর হক্কলেউ জানে তাইন আছইন শেরে বাংলার লাখান নেতাজির লাখান। সবে জানে তাইন আইবা। কিরণশশীর বয়স অখন কম করিয়া একশ দশ।
--- অত বড় দেশ অইল, ছোট ঘটনা দুই একটা অইতউ পারে।
--- ইতা ছোট ঘটনা নায়রেবা। আমার বাবায় কইতা দেশভাগ না অইলে তারা বুঝতেউ পারতা না হিন্দু মুসলমান কিতা। ইতাও আমি মানি না, অত মুক্তোমনা অইলে সমাজ চলে না। আমার মায়ে হাসি-পিসিরে নিয়া বাবার  লগে মজা করতা, পুইমাসির বিয়াত তানে লই যাওয়ার কথা কইতা বাবায়। কও চাইন সামাজিক অনুষ্ঠানো মিলমিশ রাখলে কিতা অইত? হারিচ চধরির পুড়ি হাসিনার লগে রজনী দেবর পুয়ার বিয়া অইলে কিতা অইত? ভুলুমামা আর রঞ্জু কাকু যে মিয়া বাড়ির কাকা মামা বুঝছি বড় অইয়া। তারারেও হারাই লাইছি। মালেকুল তোমারে ধন্যবাদ একটা মস্ত বড় শিক্ষা দিছ আমারে। তোমার কথা শুনিয়া মনো অইল স্বপ্ন স্বপ্নর মাঝে থাকলেউ সুন্দর থাকে, বড় হয় দিনে দিনে। কাইল মার বাড়ি খুজাত গিয়া বুঝছিকিচ্ছু মনো করিও না, রাউলি আর  যাইতাম নায় আমি।

       যাইনি পিতৃভূমি রাউলি। গোবিন্দগঞ্জ থেকে আর গাড়ি ঘুরিয়ে ছাতকের পথে যাইনি। জুনাইদের খুব মন খারাপ হয়। বলে,
--- ভাবছিলাম একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইমু। আপনার ভিটাত পাও রাখার লগে লগে গাইমু ভাবছিলাম ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
       কী বলব জুনাইদকে, মালেকুলকে, দীনকে। সুখের একটা উপলব্ধি নিয়ে ফিরছি যে। আমার পিতৃভূমির নবীন প্রজন্মের মনোরাজ্যে কোন জটিলতা নেই। তাই নিশ্চিত মনে জুনাইদ মালেকুলকে আমার রাউলিবাড়ির স্বপ্ন-স্বত্ব দিয়ে দিই, দীনকে দিই দাড়িয়াপাড়ার দামবাড়ি। স্বপ্নের রক্ষণা-বেক্ষণ করবে ওরা। বাগি দিয়ে এসেছি।

       শেওলা বর্ডার পার হয়ে দেশের মাটিতে পা রেখেই সিদ্ধান্ত নিই একটা কিছু  মিথ্যা বলব দাজানকে, আসলে দাজানের দেওয়া দলিলের কপিটা কোথায় রেখেছি তাও তো মনে নেই আমার। মায়ের বধিরতার জন্য অনেক সাজানো গল্প-বলার যন্ত্রণা থেকেও রক্ষা পাওয়া গেল।







*****  

কোন মন্তব্য নেই: