“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭

সব লোকে কয় লালন কী জাত


সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে

আজ বারুণী স্নান ৷ জলদেবতা বরুণের নাম থেকে এর উৎস ৷ বারুণী স্নান তাই জলের উৎসব ৷ চৈত্রমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিথে এই উৎসব হয়ে থাকে ৷এদিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নদীতে স্নান ও তর্পণ করে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান করেন ৷ উদ্দেশ্য পূণ্যার্জন ও পাপমুক্তি ৷ এক কথায় প্রাচীন মানুষের পূর্বপুরুষ পূজারই একটি ধারা এটি ৷ এ ধরণের পিতৃতর্পণকর্ম মহালয়াতেও আচরিত হওয়ার বিধি আছে ৷ আবার কোনো কোনো সম্প্রদায়ের বিশেষ ধর্মীয় কারণেও এই পার্বনটিকে বিশেষ মান্যতা দেন ৷ যেমন মতুয়া সম্প্রদায়ভূক্তরা তাঁদের ধর্মীয়গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতে, পশ্চিমবঙ্গে ঠাকুরনগরে এবং দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুমের পশ্চিমদিকের গ্রাম বড়খলাতে এই তিথিতে মেলার আয়োজন করেন ৷  ত্রিপুরারাজ্যের দক্ষিণের সীমান্ত শহর সাব্রুম  সংলগ্ন ফেনি নদীর পাড়েও প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে হয়ে থাকে বারুণী স্নান ও মেলা ৷ ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির বহু আগে থেকেই এই মেলা চলে আসছে ৷ ভারতভুক্তির পর যখন দুই দেশের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় তখন থেকেই এই মেলা এক মানবিক আবেদনের রূপ নেয় ৷ এই মেলাতেই দেখা দেশের বাড়িতে ফেলে আসা মানুষজনের সাথে এপাড়ে উঠে আসা মানুষের ৷ নদীর বুকে এদিন দুপারের আত্মীয় স্বজনের গলা জড়িয়ে কান্নার রোলে বাতাস ভারি হয়ে উঠত ৷ এই প্রতিবেদকেরও ওপারের আত্মীয়স্বজনের সান্নিধ্যে এই করুণ আবহের অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ কালক্রমে বয়স্ক আত্মীয়স্বজনরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ৷ তাই এ দৃশ্য বর্তমান প্রায় বিরল ৷ পুরোণোদের যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেলেও বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যাঁরা এদেশে রয়ে গেছেন তাঁদের কেউ কেউ এদিনটাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন ৷ তাছাড়া এখানকার ত্রিপুরি ও মগ জনজাতি অংশের মানুষের অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছে দুপারে ৷ তাঁরাও এদিন মিলিত হওয়ার সুযোগ নেন ৷

সম্প্রতি সাব্রুমের বারুণী মেলা আগের চেয়ে অনেক বড়ো আকারের  আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে ৷ সেই ধর্মীয় বাধাবন্ধ আজ আর নেই ৷ কারণ বাঙালির রক্তেই আছে সম্প্রীতির বার্তা ৷ বাঙালিরই পূর্বসূরী চন্ডিদাস, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ৷ যাঁরা মানুষে মানুষে সম্প্রীতির কথা বলেন ৷ সেই অসাম্প্রদায়িক বার্তা বুকে নিয়েই এদিন দুপারের হাজার হাজার লোক মিলিত হন ৷ নদী কোনো সীমানা হয় না ৷ কাঁটাতার কোন প্রতিবন্ধক হয় না ৷ ভূখন্ডের রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ব্যবধান থাকে না ৷ দুই ভূখন্ডের মানুষ এক বন্ধনে বাঁধা পড়েন কিছুক্ষণের জন্যে ৷ কিছু ব্যবসায়িক বিষয়বুদ্ধিকে বাদ দিলে কোন অপ্রীতিকর ঘটনার উদাহরণ পাওয়া যায় না এদিনের মহামিলনে ৷ শৃঙ্খলাটা যেন মানুষের মন থেকেই বেরিয়ে আসে ৷ কোনো জাতপাত ধর্মান্ধতা এখানে মাথা তুলতে পারে ৷ শুধু মানুষ আসে মানুষের কাছে আন্তরিকতা নিয়ে ৷ এবছরও তার ব্যতিক্রম হয় নি ৷ বিরাটপুরুষ অন্তর্যামী অলক্ষ্যে হাসেন আনন্দে ৷ 'তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর ৷'

কোন মন্তব্য নেই: