“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১২ মার্চ, ২০১৭

উজানের উদ্যোগে কালিকাপ্রসাদকে স্মরণ করলেন তিনসুকিয়ার শিল্প-সাহিত্য জগতের মানুষজন




বাংলা লোকগানের দল দোহারের প্রতিষ্ঠাতা তথা শিল্পী অকাল প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশে আজ ১১ মার্চ সন্ধ্যা বেলা  স্মরণ করে তিনসুকিয়ার ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’ । ঝড়ো হাওয়া এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্যে লোকজন সামান্য কম হয়েছিলেন। কিন্তু তারই মধ্যে সুবচনী দুর্গামণ্ডপের দ্বিতলে শিল্পনীড়ে অনুষ্ঠিত হয় একটি শোকসভা। কালিকাপ্রসাদের প্রতিকৃতিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে  সূচনা করেন কালিকার শৈশবের অন্যতমা সঙ্গীত শিক্ষিকা,তিনসুকিয়ার বর্ণালি শিশু কল্যাণ সংস্থার সম্পাদিকা বর্ষীয়ান গীতা দে। পরে উপস্থিত সুধীজন কালিকাপ্রসাদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। সভার শুরুতে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ভারত- বাংলা যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বাংলা ছায়াছবির জন্যে কালিকার লেখা গান ‘আমি তোমারই নাম গাই’ গেয়ে শোনায় কিশোরী শিল্পী পৌষালি কর।
কালিকার স্মৃতিচারণ করেন গীতা দে। তিনি বলেন, স্বামীর চাকরি সূত্রে তাঁকে একধিকবার শিলচরে যেতে হয়েছিল। তখনই কালিকাদের বাবা-কাকা-পিসিদের সঙ্গে প্রায় আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাঁদের কারো কারো থেকে তিনি শিখেছেন, আবার তাঁদের সঙ্গে মিলে অন্য আরো অনেককে শিখিয়েওছেন। কালিকারও শৈশবের সঙ্গীত শিক্ষার অনেকটাই তাঁর কাছে। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে বহু সময় তাঁকে থাকতেও হয়েছে, তখন তাঁর কাছে কালিকা এবং বাড়ির শিশুদের ছিল গল্প শোনার আবদার। বড় হয়ে যোগাযোগ কমলেও যখনই দেখা হয়েছে, তিনসুকিয়া, গুয়াহাটি বা কলকাতাতে কালিকা সেইসব দিনের কথা স্মরণ করত। তিনি বলেন, সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে সাধকের মত কাজ করে গেছেন।
সদ্য গঠিত ব্যতিক্রম সাংস্কৃতিক মঞ্চের সম্পাদিকা শতাব্দী গাঙুলি সম্প্রতি গুয়াহাটিতে  ব্যতিক্রম আয়োজিত ‘ভাষামিলন উৎসবে’ কালিকার পরিচালিত ধামাইল কর্মশালার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি একটি ব্রহ্মসঙ্গীতও গেয়ে শোনান।
সুশান্ত কর ছাত্র জীবনে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনে থাকলেও এক সঙ্গে করা বহু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করেন। গুরুচরণ কলেজে তাঁরা প্রায় একই সময়ে পড়েছেন, কালিকা  যদিও তাঁর কনিষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন। সেখানেও এক সঙ্গে বহু ছাত্র আন্দোলন করেছেন, দেয়াল পত্রিকা খড়ম করেছেন, পথ নাটক করেছেন, সেই সব স্মৃতিচারণ করেন। কলেজের বাইরে  কালিকার সঙ্গে একত্রে কোনো সাংস্কৃতিক কাজকর্ম না করলেও তাঁকে এক দক্ষ তবলাবাদক হিসেবে দেখেছেন। গণনাট্যের শিলচর শাখার সঙ্গে  কালিকার সংশ্রবের কথা উল্লেখ করে বলেন, কালিকার তাঁর বাড়িতে বা শিলচর সংগীয় বিদ্যালয়ে অসামান্য সব প্রতিভাসম্পন্ন গুরুজনকে পেয়েছিল ঠিকই---কিন্তু সে যে ছাত্র এবং সংগঠন করত---সেই এস এফ আই বা গণনাট্য, বা পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মেধাবীদের সমাবেশ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেল তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে —সেখান থেকেও তিনটি গুণের তার মধ্যে সমাবেশ ঘটেছিল। সামাজিক দায়বদ্ধতা,সাংগঠনিক বুদ্ধি এবং প্রচণ্ড অধ্যয়ন স্পৃহা। অন্যথা ‘দোহার’ এবং আজকের কালিকাপ্রসাদের উত্থান অসম্ভব ছিল। তিনি বলেন,তাঁর অকালে চলে যাওয়াতে ক্ষতি অনেক হল, বেঁচে থাকলে হয়তো সে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতোই একদিন তাঁর অধ্যয়নের ফসলগুলো লিখেও রেখে যেত।  কিন্তু সে এক প্রত্যাহ্বানও রেখে গেল আগামীর, বিশেষ করে পূর্বোত্তরের শিল্পীদের, জন্যে। বহুজনকে সে প্রেরণা যোগাতেই থাকবে। তাঁকে কেবল জিটিভির শিল্পী বললে খাটো করে দেখা হয়। সেরকম শিল্পী আরো বহু আছেন,  আসামের একজন হয়ে বাকি ভারত এবং বাংলাদেশের মানুষজনের  এতো আপনার জন হয়ে ওঠা কেবল জিটিভির দৌলতে সম্ভব ছিল না। বরং যে সম্মান এবং দক্ষতা দোহার অর্জন করেছিল,তাতে জিটিভি তাঁদের পরম্পরার থেকে বেরিয়ে এক বিশেষ ঢঙে মঞ্চ দেবার কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছিল। সেই মঞ্চ কালিকাকে হয়তো আরো বেশি মানুষজনের কাছে পরিচিত করেছে, কিন্তু কালিকা একে ব্যবহার করেছেন লোকগান এবং শিল্পীদের মানুষের কাছে নতুন করে নিয়ে যাবার জন্যে। এই দায়বদ্ধতার জায়গাটি বুঝতে হবে। এই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সে ব্যতিক্রম মাসডোর সঙ্গে মিলে আসামে এবং পশ্চিমবাংলাতেও লোকগান এবং নৃত্যের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করত।   

           
এছাড়াও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সঙ্গীত শিক্ষক অমল মুখার্জি। কালিকার স্মরণে শ্রীজাতর লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান ত্রিদিব দত্ত। গোটা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।


অনুষ্ঠানে পৌষালি করের গাওয়া গানটি নিচে রইল...


কোন মন্তব্য নেই: