“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১৭ মে, ২০১৭

নিভৃত ছায়া

 ।। রণবীর পুরকায়স্থ।।


       রা আর সোহাগকে সামনাসামনি দেখলে কেউ ভাববে না ওরা দুইবোন নয়। দুজনেই দীর্ঘাঙ্গী পাঁচ-চারের কাছাকাছি। মফসসল শহর শিলচরের  কলেজে লাক্স হিমানি কান্তা সেন্ট এর ভুরভুরে গন্ধে যতটুকু আকর্ষণীয় থাকা যায়,থেকেছে  এখন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে কত কী, চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অপর্যাপ্ত সুন্দরের তেলমশলা। তাই এখনও দুরন্ত সুন্দরী। রাইএর বর দয়াশঙ্কর তো মস্তবড় ডাক্তার। কলকাতা এলে থেকেছে এবার পিয়ারলেসএ, গ্র্যান্ড তাজ বেঙ্গল গেটওয়েতে থাকতে পারে, কিন্তু নিউ মার্কেটের কাছাকাছি থাকা আর আহেলির খানা এই লোভেই থাকে। সোহাগের ফ্ল্যাট বাইপাসের হাইল্যাণ্ড পার্কে, নিজের গাড়ি ডাটসুন গো আর বর অভিজিতের সাদা গাড়িতে লেখা ভারত সরকার। সাদা গাড়ি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে কোন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, রাই বলল আরো বড় গাড়ি চাই। আসলে এ সব স্নায়ুর যুদ্ধ, অর্থবল যার বেশি সেই জেতে। সোহাগ সবসময় হেরেই যায় দয়াদার কাছে, আবার দয়াশঙ্করই মধ্যস্থতা করে সমাধান দেয়। বলে,
 ---গাড়িটা প্রধান নয়, মেন হল চালক। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে সুলতান, তোমরাও তো দেখেছ, ভাল লাগবে। দেখে নিও।
       কথামতো, সোমবার সকাল সাতটায় সোহাগ আর অভিজিৎ রেডি হয়ে বসে থাকেঅভি বলেছে বেল বাজলেই কফি বসিয়ে দিতে, সে দরজা খুলে দেবে। বেল বাজে দুটো, একটা ডোরবেল আর একটা মোবাইলের রিংটোন, দরজাঘণ্টির মতোই বাজে। ধরার আগে অভিজিৎ সোহাগের দিকে অনুনয়ের তর্জনী দেখিয়ে বলে, প্লিজ। মানে কথা মতো কাজ হয় না, তাই সোহাগ কফি বসিয়ে দরজা খুলে দেয়, অভি মোবাইল হাতে ব্যালকনিতে। লোকটাকে নিয়ে এই  এক ঝামেলা, মোবাইল বাজলে আর কিছুর ঠিক থাকে না। সর্বক্ষণ মোবাইল আর ল্যাপটপ। দুক্ষেত্রেই অনুরোধের আঙুল তুলে বলবে, এক্সকিউজ মি। সোহাগ রাগ করলে বলে, কী করব বল চাকরি বাঁচাতে হবে।
       বন্ধুর বাড়িতে কফি খেয়ে কাপ ধুয়ে মুছে দুর্গা স্মরণ করে যাত্রারম্ভ করে রাইসোহাগের ওসব বালাই নেই, ড্রাইভার সুলতানের জিম্মায় স্যুটকেস দিয়ে বলে, সুলতানভাই নিউ কেলিনওয়ার্থে যাবে, ব্রেকফাস্ট তুলব। খাবারের কথায় ডাক্তার দয়াশঙ্কর মিশ্র যেন গোলকিপার রাইর ভুলে দার্বি হেরে যায়। রাইকে কানে কানে বলে,
 --- তোমার না কিছু খেয়াল থাকে না।
সোহাগ বন্ধুর পাশেই ছিল, বলে,
  --- সবে শুরু দয়াদা, খর্চা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
দয়াশঙ্কর উজ্জীবিত হয়ে বলে,
---তাহলে ড্রিংক্স আমার, হার্ড কোল্ড সব। টিচার্স আনি, কী বল অভিজিৎ?
--- লাগবে না মাইফ্রণ্ড। এই পেটিকা আমার বুকের পাঁজর যে রে...।  সব আছে ওতে, ,  শ্যাম্পেন আছে ওয়াইন আছে সোডা আছে। শটগ্লাস আছে ডিকান্টার আছে টম্যাটো জুস আছে, নুনের প্যাকেট আছে, শুধু গুছিয়ে বসতে দাও।
--- টম্যাটো জুস আর নুন দিয়ে কী হবে? স্কচ নেই? আমি আনব?
---মাংকি শোল্ডার আছে সেভেন ফিফটি, ম্যাক্সিকান সিলভার টাকিলাও আছে।          ব্রেকফাস্ট প্যাকেট নিতে সুলতান একা গেলেই হয়, তবু সকালের কলকাতা দেখতে অভিজিতের সঙ্গে দয়াশঙ্করও নামে, রাই নামতে সোহাগও নামে। অভিজিৎ রিসেপশনের শাড়িপরা যুবতির বুকের দিকে ঝুঁকে চোখ উঠিয়ে নেয়, পকেট থেকে পাওয়ার গ্লাসটা বের করে চোখে লাগিয়ে আবার ঝুঁকে, আবার খুলে চশমা, বলে,
 --- তো শ্বেতা আপনি নন, সামবডি। মে বি অলিভিয়া, বলেছিল ফুড রেডি।
 --- ইয়েস স্যার। টেক অ্যাওয়ে।
    বিল প্যামেন্ট করে হাসিমুখে শেষ সৌরভের দৃষ্টি দিয়ে ফেরে অভি। পেছনে পেছনে দয়াশঙ্করকে দেখে অভিজিৎ বলে,
 --- ফোরস্টার।
 --- তাতে কী হয়েছে?
 --- না তোমরা তো আছ ফাইভে। তবে পিয়ারলেসএর  ফুড দারুণ।
 --- না না পিয়ারলেসও চার, কিজানি তিনও হতে পারে  কিন্তু ভাই অভি আমরা তো দুপুরের আগেই পৌঁছে যাব ডেস্টিনেশন। কোথায় বসব, খাব এসব?
 --- হবে হবে। প্রথম যাব দেউলটি, রূপনারায়ণের পারে রিসর্ট আছে, ওখানে ব্রেকফাস্ট। কাছেই শরৎচন্দ্রের বাড়ি সামতা গ্রাম।  
   ঘুরপথের পরিকল্পনা শুনে রাই আপত্তি জানায়
--- সে তো বুঝলাম অভিদা, উল্টো পথ হয়ে গেল না?
--- তা তো হল। প্ল্যানিং তোমার বন্ধুর।
--সোহাগের সবতাতে পাকামি  শক্তিগড়ে থামব না ? ল্যাংচা?
--- যাওয়ার সময় হবে না।
   ওদের কথোপকথন শেষ হলে সোহাগ অভির লুই ফিলিপ স্যুট এর মসৃণ হাতা খামচে ধরে মিঠে ছুরিতে টান দেয়,  যাতে অন্যরা বুঝতে না পারে। বলে,
--- মেয়েটার বুকে কী শুঁকছিলে?
    অভিজিৎও তৎপর জবাবে জানায়,
--- চালসে হওয়ার পর কাছের জিনিষ ভাল দেখি না, পাওয়ার তিন। নাম পড়ছিলাম, নামে ডাকলে রেসপন্সটা ভাল হয়। শ্বেতার ফিগারটা কিন্তু দারুণ।
--- আর অলিভিয়ার?
--- ও তো টপ পরা।
--- এরকম প্যাশনেটলি আমাকে দেখেছ কখনও?
--- তোমাকে দেখব বলেই তো ওদের দেখি।
--- দেখ, না হামলে পড়।
--- না ম্যাডাম, তুমি আমার শূন্যবুকে নৃত্যময়ী তুমি  যে আমার অচল সিকি।
--- ওসব ভাবের কথা। সত্যি বলছ, ভালবাস?
ভালবাসার কথাটা রাই হঠাৎ এসে শোনে ফেলায় সোহাগ থামে। রাই-সোহাগের গসিপ না হলে চলে না। ভ্রমণের ইটিনিনারি তছনছ করে শৌচালয় যাওয়ার অছিলায় শক্তিগড়েও নামে অভিজিৎ ল্যাংচার সাইজ দেখায় দয়া ডাক্তারকে, মাঝে মাঝে দুএকটা খায়ও দুই পেটুক। ওদের পেছন ঘুরার কোন মানে হয় না তাই সোহাগ রাইকে টানে। বলে,
 --- কুছতো গড়বড় হ্যায়। আমি ভেবেছি আমার কপালেই ওরকম, এখন দেখছি দয়াদাও কম যায় না। আমি ওদের যত বলছি ল্যাংচা প্যালেসে যাও, ওরা বলেছে ল্যাংচা হাউসটা বিশাল, কোয়ালিটিও ভাল, ডাক্তার দয়া তো এর আগে এদিকে এসেছে বলে শুনিনি।
---আমিও শুনিনি, তবে ইদানিং পূর্বজন্মের স্মৃতিকথা বলে।
--- দেখ না কেমন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মেয়েগুলোর সঙ্গে হাসি মস্করা করছে, সাইজ দেখাচ্ছে, উফ্‌তবে ডাক্তারবাবু তো আমারটার মতো ইডিয়ট নয়, কথা বলছে না জরিপ করছে।
--- বুক মুখ পশ্চাৎ। কী করবে বল, শিলচরে তো সুনাম রক্ষা করতে হয়। হাইওয়েতে এসে ছাড়া গরু।
--- তুই সাপোর্ট করিস? রিরি করে না গায়ে, মনে হয় না কষে লাগাই?
--- আমার তো মনে হয় ছেড়ে চলে যাই।
--- যাস না কেন?
--- পটাতে জানে, বলে ভালবাসে।
--- তখনও তোকে বলেছিল ভালবাসে। ঝুট।
--- মানে?
--- অভিদা কী ন্যাকা কথা বলতে পারে রে টেলিফোনে।
--- কোথায় শুনলি?
--- তোকে ফোন করে নাকি?
--- মোবাইল ধরার পোজ দেখেই ধরতে পারি, এমনি এমনি পাছাভারি হয় নি। তুই কফি করতে গেলি সকালে, একটি মেয়ে। মেয়েটিকে বলছে নতলার ব্যালকনি থেকে কলকাতা দেখতে কী সুন্দর।
 --- সুন্দর বলেছে?
 --- না, বলেছে মনোরম। বলল তোমার গলাটা ভারি লাগছে কেন? ঠাণ্ডা লাগিয়েছ? কড়া করে চা খাওয়ার পরামর্শ দিল।
 --- ধুর, ও তো সুব্রত, ওর জুনিয়র, মেয়েদের মতো গলা।
 --- আমি চিনি না? দেখিস কেস আছে, রাই মিশির নতলা থেকে পাখির পালক গুণতে পারে।
       সুলতান সব চেনে, পাকা ড্রাইভার। শান্তিনিকেতন যে তার চেনা জায়গা বুঝাই যাচ্ছে। কাউকে কিছু না বলে তো বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাও অভিজিৎ একবার জেনে নেয়,
--- কোন দিকে যাবে সুলতান, বর্দ্ধমান দিয়ে তো?
--- হ্যাঁ স্যার গুসকরা দিয়ে যাব। শর্টকাট হবে, পানাগঢ় দিয়ে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ৫০ কিলোমিটার বেশি, তিনটে বেজে যাবে।
--- খড়িমাটি হোটেল কোথায় জান?
--- জেনে নেব স্যার, শান্তিনিকেতন ডানদিকে হোটেলটা শুনেছি বাঁদিকে। হাইওয়ে থেকে কখন যে শালবনের ভিতর ঢুকে গেছে গাড়ি, কয়েক মাইল চলেও এসেছে শুকনো পাতায়।  দয়াশঙ্করের হিসি পায় না গাড়ি থেকে নেমে দেখার ইচ্ছে হয় কে জানে, সে রাইকে  সংকেতে জানায় ইচ্ছে, রাইও সুলতানকে গাড়ি থামাতে বলে। এই ফাঁকে সবাই নেমে যায় শালবন দেখার আনন্দে। হঠাৎ সুলতান আতঙ্কিত হয়ে বলে,
 --- গাড়িতে উঠুন তাড়াতাড়ি।
      বেচারি দয়া বিড়ম্বনায় মাঝামাঝি থামিয়ে গাড়িতে ওঠে। ব্যস সুলতানের মুখে এবার স্বস্তি, গাড়ি পিছিয়ে নেয়, দেখায় পথের পাশে এক শুকনো সর্পচর্ম। সবাই ভয় পায় আবার, যদিও দয়ার রাগ কমে না  বলে,
 --- তুমিও না সুলতান,  কী ভিতু!  এখন শীতকাল ওরা বেরোয় না।
      অন্যরা কিন্তু সমবেত জানায়,
 --- তাও বাবা।
       সোহাগের মনটা একটু দমে যায়। শান্তিনিকেতন বেড়াতে এসে এতদূরে থাকা, কোন মানে হয়। তবে সরাইখানাটি খাসা। গাছগাছালি ফুলে ফলে ঘেরা কী প্রশস্ত খাওয়ার ঘর খোলামেলা। হোটেল ভেতরে। ওয়াও, স্যুইমিং পুলও আছে, এত এত হরিণ, ক্যাম্প ফায়ারের ধুনিও আছে। দয়া ডাক্তারের চয়েস আছেতবে শান্তিনিকেতনের আটপৌরে রতনকুঠির কাছে কিছুই নয় সরকারি কাজে থেকেছে অভিজিৎ পূর্বপল্লী অতিথিশালায়ও থেকেছে সোহাগ। সোনাঝুরিতে থেকেছে অভি-সোহাগ। রাই আর দয়াশঙ্করের চোখে সবই নতুন। হোটেলের রুম সার্ভিস এ খেতে চাইল না দুই পুরুষ। অভি বলল,
 --- আ! বেগুন ভাজার সাইজ দেখে প্রেমে পড়ে গেছি।
     রাই টিপ্পনিতে বলল,
 --- রুমে এলেকি সাইজ ছোট হয়ে যেতো অভিদা ?  
 --- তা নয়, তোমরা না হয় একটু রেস্ট নিয়ে এসো, আমরা মেনু ঠিক করি, আধঘণ্টা তো লাগবে।
    সোহাগ চেনে তার মালখোর বরকে, এখন নতুন বন্ধু দয়াশঙ্করকেও বশ করে নিয়েছে। বুঝতে পারছে কিছু একটা আছে আঠা। হয় মদ নয় নারী। প্রথমটাই হবে। রাইও বলল,
 --- আমি শিওর মদ খাবে। কিন্তু বার তো দেখলাম না।
   --- তুই ওদের চিনিস না। দয়াদাও অভির ব্যাগ এর ড্রিংকস এখন খাবে না, এখন খরচ করবে দুহাতে, শিলচরে তো শুধু রোজগার। আর আমার জনও যে কোন রসে মজেছে ধরতে পারছি না।
   --- ফোন করছে না তো?
   --- সে কি আর থামে, ওর চাকরির তো ছুটি হয় না।
   --- ওরে ভোলুরাম এত ভোলেবাবা হইও না, তুলেমূলে যাবে বলে দিচ্ছি।
       খাওয়ার জায়গা যত সুন্দর, ড্রিংকস এর ব্যবস্থা ততোধিক খারাপ। একটা ছোট এসিরুম, লুকিয়ে খেতে হবে। একটা করে করোনা এক্সট্রা লেজার মেরে বাইরে আসতেই বাঘিনীর মুখে। ঢুলুঢুলু মুচকি হাসিতে টেবিলে বসে তো অবাক, ওরা খাবার অর্ডার দেয় নি,  তাহলে। ধবধবে ফুঁইফুলের মতো কোহিনূর চালের ভাত, পাহাড়ের উপর বিশাল বেগুন ভাজা। ঘি, সুক্তো, সোনামূগের ডাল। অভিজিৎ মুগ্ধ চোখে বলে,
--- ম্যাজিক।
      ইলিশ চিংড়ি চিতল মাছের মুইঠ্যা আর খাসির মাংস দেখে ডাক্তার দয়া বলে,
--- এতো ?
      কেলিন ওয়ার্থের খাবারের অর্দ্ধেক পড়ে আছে গাড়িতে সুলতানের জিম্মায়, দয়াশঙ্কর বলেছে খেলে খেও। বলে ভোজন দক্ষিণা দিয়েছে পাঁচশ টাকার নোটখাওয়ার পর সুলতানকে পাঠিয়েছে বোলপুর পান আনতে। সুলতান ফিরে এসে বলে,
--- পৌষ মেলায় যাবেন তো ?
   সোহাগ বলে,
--- কোথায় মেলা? শেষ হয়ে গেছে কাল।
   আফসোষ হল।
--- তাহলে কী করা যায়, কোথায় যাবে?
    ডাক্তার সোহাগকে প্রশ্ন করে। অভি বলে,
--- আমি আর নাড়তে পারব না এখন। শপিং টপিং করে নাও তোমরা। শাড়ি বাটিক ব্যাগ স্যুভেনির।
    সুলতান মুখের উপর কথা বলে না। ঠিক সন্ধেবেলা নতুন মেলার মাঠে নিয়ে যায়। মেলা শেষ হয়ে গেলেও ভাঙা মেলা তো আছে।
       একেবারে গ্রামীণ মেলা, কিন্তু এতবড়। মেলার মাঠে জিলিপি বাদামভাজা, হাওয়া মিঠাই, কী নেই, হাতাখুন্তি খেলনা শীতের কাপড়। দয়াশঙ্কর মেলার এ মাথা থেকে ও মাথায় ঘুরে   বেড়ায় রাই এর হাত ধরে। কিছু খুঁজছে, হারানো কিছু যেন ফিরে পেয়েছে। সে তার যৌবনের গল্প করে যাচ্ছে একা একা, রাই এর হাত ছুঁয়ে। অভিজিৎ সোহাগও শুনছে। দয়া আপনমনে   বলে,
---ডাক্তার হওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না, শান্তিনিকেতনে পড়ব বলে চলে আসি তবলা দুটো ঝোলায় ভরে। একটা হোটেল অভিজিৎ, বনবানী, হোটেলও নয় বাড়িও নয়, মালিক সৌমেন গুহ ঠাকুরতা। আমাদের কেন যে থাকতে দিলেন, পিলুআর আমি, মানে বিপুল শঙ্কর ভৌমিক, আমার বন্ধু, দুজন এসেছিলাম। কেন এসেছিলাম, তিনমাস কাটিয়ে গেলাম অমিতা সেন এর প্রতিবেশি হয়ে, জানি না। ট্রেনে এসেছি ট্রেনে গেছি, জানি না কোথায় আছে হোটেলটা, এতদিনে তো সব পাল্টে যাওয়ার কথা। সোহাগ বাদাম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বলে,
 --- সুলতান বলেছে, বাংলার সব পাল্টে গেলেও শান্তিনিকেতন পাল্টায় নি।
অভিজিৎ বলল,
 --- যাক শান্তিনিকেতন এসে একটা কাজ তো জুটল। দয়াকে বনবানী ফিরিয়ে না দিয়ে আমি  খড়িমাটি ছাড়ছি না বলে দিলাম।
     রাই সোহাগের কোমরে চিমটি কাটে। বলে,
 --- খড়িমাটির মেয়ে গুলো কালো হলেও স্বাস্থ্যবতী, জহুরি বটে অভিদা, বলছে হোটেল ছাড়বে না।
       কাজের মেয়ে রানীর জন্য দুশো টাকা দিয়ে চাদর কেনার পর থেকেই সোহাগের চোখে জল। বড় কেরোসিনের কুপির মতো গ্যাসের আলোয় চোখ জ্বালা করে। সোহাগ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওরা তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে আসে। খড়িমাটির রুমগুলি বেশ বড়, রাই বলে,
    --- আমরা এক ঘরেই তো থাকতে পারি।
     সোহাগ বলে,
      --- না রে আজ পারব না। ট্রিপটা নষ্ট করব না। সুস্থ হয়ে নিই, কাল থেকে তো যেমন ইচ্ছে। তখন একসাথে।
       সোহাগের মনে উচাটন। সবাই বলে অভির কথা, অভি মেয়ে দেখলেই আকর্ষিত হয়। এতে সোহাগের কিছু হয় না, বরং দেখেছে বাইরের আকর্ষণ তাকে ঘরের প্রতি আকৃষ্ট করে বেশি। ওদের কাছে পাওয়ার কল্পনাও করে না তার ভিতু স্বামী। কিন্তু ইদানীংকার কানুঘুষোটা ভিন্ন। অভিজিত কোন একটি মেয়ের সঙ্গে নাকি কথা বলে সর্বক্ষণ। বলে অফিসের কাজে। পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সোহাগ কখনও ভাবতেও পারেনি অভিজিত সিরিয়াসলি কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবে, ভাবতে পারে। সোহাগ জানে ওদের সম্পর্ক নিয়ে ঈর্ষা করে অনেক কাছের মানুষ। সোহাগের মন মানতে চায় না, অভিকে কখনও একান্ত কথা কারো সঙ্গে বলতে শুনেনি। বাড়ি থেকে বেরোলেও ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে। বোম্বে দিল্লি গেলে পারফিউম আনে ডিজাইনার নাইটি আনে। বোম্বের  কলিগ নাগচেতনের বউ কথায় কথায় দুটো নাইটি কেনার কথা বলে সন্দেহ ঢুকিয়েছিল মনে, একটাই তো এনেছ। এরকম প্রমাণহীন অনেক তথ্য অনেকে তার কানে দিয়েছে। ভারি হতে হতে বিমর্ষ হয়ে থেকেছে, কিন্তু অভিজিতএর কোন হেলদোল নেই, যেমন ছিল তেমনই আছে, তার প্রিয় একান্ত। এখনও বর্ষার রাতে ব্যালকনিতে ওকে জড়িয়ে গায় অতুলপ্রসাদের গান। এত স্ট্রেস সহ্য হচ্ছিল না, কেমন এক সন্দেহজনক শীতলতায় আক্রান্ত হচ্ছিল সোহাগ। তাই একটা আকাশ চাইছিল একা একা। শান্তিনিকেতন ওদের প্রিয় জায়গাও বটে। তবে রাইকে নিয়ে তার সমস্যা নেই, রাইকে তো স্কুলকলেজ জীবন থেকেই চেনে,  বন্ধুরা বলে ক্লোন কপি। কাউকে তো বলতে হবে মনের কথা, যদি দরকার হয় রাইকেই খুলে বলবে মনোব্যথা। দয়াদাও কুচুটে মানুষ নয়, অভির বন্ধু হয়ে গেছে মাত্র দুবারের দেখায়। তবে রাইও মাঝে মাঝে আনতাবড়ি কথা বলে, সোহাগের রাগ হয়। তখন হোটেলের কালো মেয়েদের কথা বলায় ওর রাগ হয়। শুধু অভির কথা কেন বলল। ওরা তো এডাল্ট ভ্রমণেই এসেছে, ডাক্তার বলে কী দয়াদা গাছের গোটা। চোখ জ্বালাটালা কিছু নয়। রাগে শরীর খারাপ হয়। অভির সঙ্গে খুব একলা থাকার সাধ হয়। তাই তাড়াতাড়ি রুমের দিকে পা বাড়ায় যাওয়ার আগে রাইকে বলে,
---রুম সার্ভিস বলে দিস।
     দয়াশঙ্কর অভিজিতকে ঈশারায় থেকে যেতে বলে। সোহাগ বলে,
--- তুমি থেকে যাও ওদের সঙ্গে। রাই, ও থাকুক, বাট হেণ্ডেল উইথ কেয়ার।
    সোহাগ জানে উল্টো কথায় কাজ হয় তার গৃহপালিত প্রভুর। দয়াশঙ্করকে কাটাতে বুদ্ধি খাটিয়ে বলে,
--- স্যুইমে যাবে দয়া?
     এক ঘণ্টায় ফ্রেশ। ওদের স্যুইম স্যুট নেই, অভি সোহাগের আছে। আবার জোর দিয়ে বলে,
--- ওয়ান আওয়ার প্লিজ।
       সোহাগের উত্তেজনা হলে ভুল ভাল হয়। লক কার্ড উল্টো ঢুকিয়ে বিরক্ত হয়ে অভিজিতকে দেয়, দরজা খুলেই জাপটে ধরে চকাশ করে স্বামীকে দেয় এক চুমু। অনেকক্ষণ পর শ্বাস ফেরাতে মুখ খুলে বলে,
--- ইউ লাভ মি? অভিজিত তার ভুবনমোহন মুচকি হাসি বিকশিত করে। সোহাগ আবার বলে,
--- বলো, ভালবাস কি না?
--- ও, ইয়েস।
   বলে অভিও নিবিড় হয়।
--- ওকে,  তাহলে চলো।
--- চলো। কোথায় যাবে এই রাতে?
--- রাত কোথায়? এখন চান করব, ড্রেস করব, তারপর তো। কী পরব বল, টুনাইট ইজ ইওরস, সে।
--- ঘরে তো রাতের পোষাকই পরবে।
--- নো, মনে করো বাইরে যাবো। রুবিকন পরব? পিচ কালারটা? অফ শোল্ডার?
--- ওহ নাইস। কোল্ড শোল্ডার এনেছ ? পি কা বুএকটু বডিহাগিং হলে ভাল লাগবে।
--- গট ইওর পয়েন্ট, মোটা হয়েছি? আর তুমি কী পরবে? ওরেঞ্জ প্রিন্টেড শর্ট এনেছি, ফুল স্লিভ হেনলে টি-শার্টটা পরবে?  
--- ওকে ম্যাডাম।
--- দুঘণ্টার জন্য হারিয়ে যাব আমরা। ওয়ান আওয়ার গ্রেস টু ডক্টর দয়াশঙ্কর।
       সুলতানকে ডিনারের জন্য পাঁচশ টাকা নাচিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা নৈশ অভিযানে। শান্তিনিকেতন ওদের চেনা জায়গা বলে প্রান্তিক পৌঁছে যায় পাঁচ মিনিটে। প্রিয় সোনাঝুরি ক্লাব এর নিরিবিলিতে। একই আছে দক্ষিণের জানালা  সামনের আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে ইস্টিশনের দিকে। শুক্লপক্ষের চাঁদ আর ভেপার আলোয় কাঁচের জানালা কথা বলে। ইচ্ছে না হলেও হারিয়ে যাওয়ার কথা বলে। ড্রিংকস এর ব্যাপারে সোহাগ অভির উপর কথা বলে না, তাই রাজকীয় ঢংয়ে বসে দুটো হাই বল দিতে বলে। কিন্তু সোহাগের মন আজ শুধু স্কচ আর সোডায় মানছে না সামান্য পরিবর্তন চেয়ে বলে,
  --- একটু লুকোচুরি হোক না। ভোদকা উইথ লাইম?
     অভিজিত উদারতায় মুক্ত হস্ত। বলে,
  --- না হয় তাই হল। কিন্তু এই গন্ধ বিধুর সমীরণে কেন নির্গন্ধ হতে চাইছ বউ?
  --- রবিঠাকুর আছেন না পথ রুধি? তাঁর বাড়ির উপর দিয়ে ফিরতে হবে যে।
  --- আর ইউ শিওর ম্যাডাম?
  --- কী?
  --- তিনি খেতেন না?
 --- কী জানি? ঠাকুর হয়েছেন যখন ও ব্যাপারে সন্দেহ না রাখাই ভাল। আচ্ছা,  বললে না তো হাও আই লুক?
--- এক দু পাত্র চড়ুক, একটু বিবশ হই।
--- বিবশ! রাইট ওয়ার্ড। এর জন্যই না তুমি একমাত্র। ওনলি ওয়ান। তুমি কার সঙ্গে এত কথা বল? বল তো ?
--- হঠাৎ।
--- তোমায় সন্দীপের কথা বলিনি?
--- তোমার লাভার বয়।
--- আমাকে দেখত আর প্রশংসা করত।
--- আমি পারি না।
--- মুখে বলতে হয় না, বডি টক।
--- কথা বলে কতটুকু হয়, মাত্র সাত শতাংশ, বেশিটাই শরীর ভাষ্য।
--- তোমার পুরুষালি ব্যাপারটা দারুণ। চোখ মুখ মাংসপেশী কথা বলে। তোমার ড্রেস, কেন যে সিগারেট ছেড়ে দিলে।
--- বাট ডোন্ট রেজিস্ট মি টুনাইট টু টক। ইউ আর জাস্ট র‍্যাভিসিং।  
--- বুড়ি হয়ে গেছি বলছ।
--- নো
---ও।
--- একটু ফ্ল্যাবি। ওটাও একটা রূপ। আর এই পরিধানও তোমার শরীরকে চায়।
       কথা না বলার কথা বলে ওরা অনেক কথা বলে। কথা বলা শেষ করে ওরা মুখোমুখি বসে থাকে। পেখম মেলা সোহাগ অভির দিকে তাকায় না। কাঁচের জানালা দিয়ে নীচের মায়াবি আলোর আঁধার দেখে। সোহাগ চাইছে তাঁর বর তাকে দেখুক অপার্থিব একান্ত সুন্দর পরিবেশে। ফিরে পেতে চাইছে তার রহস্যময় মানুষকে। দু পাত্র শেষ করে ওরা নীরবে। সোহাগ মুখোমুখি থেকে অভিজিতকে কাছে ডাকে। বলে,  
---তুমি তো শুনেছি তোমার অফিসের রবিন হুড। কত কিছু করতে পার।                             --- বাড়িতে কী আমি হিটলার?
--- হলে তো ভালই ছিল, তুমি এত কেয়ারিং? অন্যরকম ভাবতেই পারি না। রাই আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড, সব কথা বলতে পারি না ওর সঙ্গে, দম আটকে আসে। তুমি কি জানো আমি কত একা। কতক্ষণ আর একসঙ্গে থাকি আমরা। তুমি তোমার ইমেজ বাঁচাতে অফিস অফিস কর বাড়িতেও। ফোনে কথা বল।
--- ইন্সট্রাকশন থাকে কতরকম।
--- গভীর রাতেও ইন্সট্রাকশন, আজ সকালেও কথা বলেছিলে।
--- কখন?
--- বেরোনোর আগে।
--- সুব্রত, তুমি চেনো।
---রাই বলল মেয়ে।
--- তোমার বন্ধুটি কি সিআইডিতে কাজ করে?
--- ব্যালকনি থেকে কলকাতার দৃশ্য বলছিলে, তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে বললে।
--- মধুমিতা। সুব্রতর স্ত্রী।
--- তোমার সব ভাল। মেয়েদের প্রতি অগাধ কৌতূহল ভাল। ছোঁকছোঁক ভাল। সব কথা যে বলে দাও সেও ভাল। কার বাস্টলাইন সুন্দর, কার পাছা... ধুর চড়ে গেছে দেখছি। ইদানীং কেন মনে হচ্ছে তুমি ভার্চুয়াল থেকে রিয়েল হয়ে যাচ্ছো, যেন কেউ আছে, আমি হেরে যাচ্ছি আমি কি তোমার লাভ ইন্টারেস্ট নই আর? ফ্ল্যাবি হলে সেক্স ইন্টারেস্ট থাকে না? চলো, ওরা অপেক্ষায় আছে। ফিরতে ফিরতে একটা গান গাইবে?
--- গাইব। আজ হু হু হু।
--- বা, জ্যোৎস্নারাতে  আমাকেও গাইতে হবে।
       ঝড়ের বেগে শান্তিনিকেতনের ধারা বিবরণী শুনিয়ে যায় সোহাগ। আসলে বাল্যবন্ধুকে  জ্ঞান দিতেও একটু ভয় ভয়। দয়াশঙ্কর ডাক্তারের সামনে কী বলতে কী বলে ফেলবে। খুব রহস্যময় মানুষ। বলছে ওরা প্রথম এসেছে, রাই ঠিকই বলেছে, দয়াশঙ্কর নিজেকেই অস্বীকার করছে। বলছে বনবানী হোটেলে ছিল তিন মাস। তাও রাইকেই বলে দেবেন ঠাকুরের কুড়ি বিঘা জমির ইজারা নেওয়ার কথা। মহর্ষির শান্তিনিকেতন নামে ভুবনডাঙার অতিথিশালার নির্মাণকথা। রবীন্দ্রনাথের বাড়ি উত্তরায়ণ কমপ্লেক্সের ভিতর যে  উদয়ন কোনার্ক শ্যামলী পুনশ্চ আর উদিচি। ওদিকে নতুন বাড়ি দেহলি আম্রকুঞ্জ ছাতিমতলার ব্রাহ্মমন্দির। মাটি ভাঙা খোয়াই এ মেলা বসে সকাল থেকে। এগিয়ে গেলেই কোপাই নদী। শ্রীনিকেতন ছাড়িয়ে আমার কুঠিতে বাটিক সিল্ক আরও নানান ধরণের শাড়ি। ঘর সাজানোর সামগ্রী। বিশ্বভারতীর ভিতরে শুধু ভবন। চিনা হিন্দি নিপ্পন সঙ্গীত বিদ্যা শিক্ষা বিনয় পাঠ আর সবার সেরা কলাভবন। রামকিঙ্করের বিখ্যাত কলের বাঁশি সাওতাল পরিবার বুদ্ধ আর সুজাতা।
 --- উত্তরায়ণ বুধবার বন্ধ বলেই আমরা বৃহস্পতিবার এসেছি।
      সোহাগ দেখাতে দেখাতে মন্তব্য করে।
 --- বুধবারে এলেও ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হতো না।
      সেমসাইড  টিপ্পনি কাটে আবার সোহাগ।
       শান্তিনিকেতন এসে অমর্ত্য সেন এর বাড়ি দেখা হবে না, এ হয় নাকি। তার উপর অভিজিত যখন কথা দিয়েছে দয়াশঙ্করের লুপ্ত সরাইখানা বনবানী ফিরিয়ে দেবে। শান্তিনিকেতনের সব বাড়িই প্রায় যেমন ছিল তেমন আছে। রবীন্দ্রনাথ এলেও চিনতে অসুবিধে হবে না। বনবানীও পাওয়া গেল, সংকেত ফলকটি একই আছে, ছোট দোতলা বাড়ির সিঁড়ি ঘরের অফিসে নাকি হুবহু ওরকম বসে থাকতেন সোমেন কাকু। এখন অন্যজনও অনেকটা উনার আদলে। দয়াশঙ্কর লোকটাকে বলল,
 --- দুই ছেলে খুব উৎপাত করত, তবলা বাজাতে হত তাকে,  কী দারুণ গাইত দুভাই
লোকটি হাসে, বলে,
 --- আমি বড় ছোটটা এখন বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক বনবিহারী গুহঠাকুরতা। বনবিহারী নাম শুনে  রাই সোহাগ এর মুখ উজ্জ্বল হয়, দয়া ভাবলেশহীন। বনবানী আবিষ্কারের ধাক্কা এখনও সামলাতে পারে নি, অভিজিত তৎপর হয়ে বলে,
    --- চা খাওয়া যাবে? কিংবা প্রাতরাশ?
   --- না, এখন আর আবাসিক থাকে না, বোলপুর স্টেশন রোডে চলে যান, অদ্বৈত হোটেলে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব পাবেন।
     সোহাগ হাল ছাড়তে রাজি নয়, বলে,
 --- তাহলে হোটেল খোলা রেখেছেন কেন?
 --- এখন বাড়ি। বাবার আমলের আদলটা রেখেছি।  
 --- ও, তা বনবিহারীর ক্যাসেট পাওয়া যাবে?
 --- না। সুবর্ণরেখায় পাবেন, রতনকুঠির কাছেই।
      অভিজিত তাও নাছোড়বান্দা, বলে,
 --- বাথরুম যাওয়া  যাবে?
      লোকটা আর না করে না, ঐ দূরে বারান্দা দেখিয়ে দেয়।  রাই আবার সোহাগের জামদানির আঁচল ধরে টানে,
 --- বুঝলি তো দুই পাগলে চিবিয়ে খেয়েছে এক পাগলের মাথা। চল চল পালাই।
       ছেড়ে দেওয়া আঁচলটা আবার সজোরে টানে রাই,  বলে,
 --- আমি বেট ধরে বলতে পারি ঐ মেয়েটিই।
 --- কোন মেয়েটি?
 --- যাকে নতলা থেকে কলকাতা দেখিয়েছিল অভিদা। ঐ দেখ মোবাইল কানে।
       দুদিন তো ভালই কাটল।  রাই দয়া তৃতীয়বারের জন্যও পাকা কথা দিল, আসছে বছজ্র আবার হবে। তবে অন্য ভেনু, ঠিক করবে অভিজিৎ। বনবানীর বাথরুম থেকে ফেরার পর অভির মোবাইল চেক করেছে সোহাগ,  রাইর  ধারণা ভুল, সুব্রতকেই ফোন করেছে অফিসে। রাইটার সব ভাল, কিন্তু ছোট থেকেই মানুষের পিছনে লাগার, গোয়েন্দাগিরি করার অভ্যাস গেল না। তাই  রাইকে  তার জয়ের খবর জানাতে ভোলে না। রাইও  খুশি হয়ে বলে,
 --- যাক। তবে বন্ধু, শত্রুকে দুর্বল ভাবিও না। তইকিকাত জারি রেখো। রাই  মিশ্রর এত ভুল হয় না, এমনও হতে পারে কথা বলেই হিস্টরি ডিলিট করে দিয়েছে, সুব্রতকে একটা ফলস রিং করে দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। কিংবা সেই বৃন্দাবন বিলাসিনীর মিথ্যে নামই সুব্রত।
--- সে আমি কল করে দেখেছি, সুব্রতদাকে চিনি।
--- তাহলে আর কী, মনকলা খাও।
       সোহাগ বিশ্বাস করে  রাইর  পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। জিরো ফেইলার। তাই নতলার ফ্ল্যাটে ফেরার পর অভিজিৎ এর দেখাশোনা খাওয়া দাওয়ার উপর তীক্ষ্ণ নজর দেয়, সব নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ায়। স্বামী সেবা হয়, কিন্তু কিজানি কি একটা হারিয়ে ফেলে সোহাগ। অভিজিৎ এর এসবে সুখ হয়, তার মোবাইল কথা বলার সময়ও যায় বেড়ে। এখন আর সে স্বাভাবিক ভাবেও কথা বলে না ফোনে, ফিশফিশিয়ে বলে। সোহাগ আড়ি পাতে না, এমনকি মোবাইলও চেক করে না। ওদের বিবাহবার্ষিকীর দিনও যখন টেরেসে গিয়ে ফিশসিশ করল অভিজিত, তার পরদিনই সে একটা কাজ করল,  ভোডাফোন স্টোরে অভির সই নকল করে একটা কললিস্ট চেয়ে চিঠি দিয়ে এল, এখন অপেক্ষা কললিস্টেরবলেছে দুদিনেই হার্ড কপি পৌঁছে যাবে। বুদ্ধিটা কিন্তু তার নিজের। যদিও জানে না কললিস্ট আনিয়ে সে কী করবে। সত্যি সত্যি কি  কোন ঘুণপোকা আছে কোথাওথাকলেও দুদিন অপেক্ষায় থাকা যাবে না। এর চেয়ে ভাল অভির সইটা আবার নকল করে বলে দেওয়া লাগবে না। ডাটসুন গো র  চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে  সোহাগ সিটি সেন্টারের দিকে।





দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকা
৩০/০৪/২০১৭। 



***** 

কোন মন্তব্য নেই: