“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

পাহাড়ি পথে একদিন


মুক্ত গদ্য  -


© সুনীতি দেবনাথ

(C)Image:ছবি
পাহাড় ডিঙিয়ে যাচ্ছি। পাহাড়টা দূর থেকে নীলচে, ধোঁয়াটে। কাছে এসে এ কী ! এক্কেবারে সবুজ ঘনঘোর। গাড়িটা ছুটছে ঝপ্পর ঝপ্পর। ভেতরে শুয়ে কাঁপছি, সে কী কাঁপুনি রে বাবা ! শুয়ে আছি তো গুটিয়ে। কাঁপুনিটা জোর। সুস্থ নেইতো। তাই পাহাড় ডিঙিয়ে যেতেই হবে। ডাক্তার দেখাতে হবে দু"শো কিমি দূরে রাজধানীতে। ফাঁকে পাহাড় দেখা। খুব যে উঁচু তা নয় ছোট্ট রাজ্যের পাহাড়ও ছোট্ট মাপের। এই দেখো ঘনঘোর অরণ্য গাছছাপা শাড়ি পরেছে যেন, গামাই, করই শাড়ির জমিন। শাল, সেগুন বডির প্রিন্ট। আর এই আঁকাবাঁকা সড়কটা হচ্ছে শাড়ির পাড়। গাড়ি চলছে পরম নিশ্চিন্তে। আমি নিশ্চিন্ত নই। কিভাবে হবোই বা ! ক 'দিন আগের কথাই বা ! এ রাস্তা, হ্যাঁ এই রাস্তা কী ভয়াবহ, ভাবা যায়? এ রাস্তা দিয়ে চলাচল? ধড়ে একটাই মাথা গো ! আর এই খাঁচার ভেতর, একটাই যে অচিন পাখি ' কমনে আসে যায় '! ঠিক বলেছো গো লালন সাঁই। তাই।  হ্যাঁ তাই সাখানটাং, আঠারোমুড়া, বড়মুড়া এমনতরো বহুত বহুত মোড়ায় মোচড় খেয়ে খেয়ে অন্নপ্রাশনের মহার্ঘ্য অন্নগুলি ওয়াক ওয়াক উগরে দিয়ে যেতে হতো ! রাজধানী আগরতলা শহরে। চুয়াল্লিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ( পাল্টে গিয়ে আট নম্বর) । এমদি এ। তবুও রক্ষা। পিতৃদত্ত পরাণডা তো রক্ষা পেতো ! সব সময় কি? না পেতো না।
     যা বলছিলাম পাহাড় ডিঙিয়ে যাচ্ছিলাম। এ পথ ভিন্ন পথ। আমার শহর থেকে ভায়া কৈলাশহর, কিংবা কুমারঘাট ফাঁড়ি পথে কমলপুর খোয়াই হয়ে আগরতলা ! লিচুবাগান প্রবেশপথ, এয়ারপোর্ট রাস্তা। ক' বছর আগে এপথে যাবার সাহস? ওরে বাবা ! বেশ কিছুদিন,  হ্যাঁ বেশ কিছু বছর কী দুঃস্বপ্নের ! এমন দিন যেন আমার রাজ্যে আর না আসে। উগ্রপন্থী সমস্যা ! দুর্বিষহ সে দিনগুলি। জীবন নিয়ে সে কী ছিনিমিনি ! রক্তগঙ্গা বয়েছিলো। এতো বেদনার প্রবাহ.! ঘরের ছেলে ঘর থেকে বেরোলে ফিরে আসবে ভরসা? উঁহু ছিলো না। এ পথেই পড়ে উগ্রপন্থীর মুক্তাঞ্চল !  খুব উঁচু পাহাড় না তো ! বলা যায় খুব উঁচু টিলা। নাম না জানা গাছের জটলা চেনা গাছও কম না। সেগুন গাছ। আমার দারুণ লাগে। শীতে নিষ্পত্র নিষ্প্রাণ শাখাবাহু ঊর্ধ্বোত্থিত যেন ' আলো চাই, প্রাণ চাই ...'। বসন্তে আহা নবাগত সুশোভন কচি পাতার সে কী নাচন ! বর্ষায় সঘন সবুজ বড় বড় পাতাগুলির কী দেমাকি আন্দোলন ! থোকা থোকা ঘিয়ে সাদা কুচি কুচি ফুলগুলির ফিকফিক হাসির ফোয়ারা !
    পথ চলে এঁকেবেঁকে, 'পথ চলেছে পথের টানে ...'! বহুদূর গিয়ে পাহাড়ি জনপদ। দু ' চারটে দোকান। বয়ামে বয়ামে বিস্কুট, চকলেট, ডালমুট, চানাচুর হেনতেন। ঝুলছে দড়িতে বাঁধা পুরুষ্টু কলার কাঁদি। চাল, ডাল মশলাপাতি একপাশে। টুকিটাকি কাপড়চোপড় রঙিন ঝুলছে দুলছে। দুয়েকজন খদ্দের আসছে, কেউ বসে গুলতানি মারছে। তাড়া নেই, তাগিদ নেই। ঝিমঝিম পাহাড়, ঝিমঝিম জীবন, যেন পাহাড়ি ছড়া। চলছে জল চলে না, যাচ্ছে জল যাচ্ছে না। জনজাতি আছে, বাঙালি আছে, মিলেমিশে একাকার। কিন্তু সেই সে দিনগুলি? সেই সব্বনেশে হানাহানির, খুনের, অপহরণের ভয়াল দিনগুলি ! আর যেন না আসে। আমরা পার হয়েছি ঘোরতর অমানিশা। এতো অন্ধকার, এতো রক্ত আমরা চাইনি, কোনদিন চাইবো না।
     এগিয়ে চলেছে গাড়ি, এগিয়ে চলেছি আগরতলার পথে। ডানপাশে একটা পিচ করা সড়ক গাছপালা ঠেঙিয়ে এঁকেবেঁকে নর্তকীর মত কেমন চলেছে। ড্রাইভার বললো ওপথে গেলে পৌঁছা যাবে সাখান । দেখলে ও পাড়া মনে হবেই কোথায় এলাম? ইউরোপের টুকরো শহর? এই পাহাড় - অরণ্য ঘেরা ভূখণ্ডে একী বিস্ময় !ওখানে নাকি এক ঝর্ণা আছে, এতো  সুন্দর, অপরূপ, অনবদ্য, স্বর্গীয় ! সুরনদী এমনি করেই বুঝি নেমে এসেছিল একদিন ধরাপৃষ্ঠে ! হায়, বেদনা থেকে গেলো এতো কাছে তবু কত দূরে !
     যাত্রাপথ এমনি করেই ফুরিয়ে গেলো বেদনার ঢেউ তুলে, স্মৃতিমেদুর ভাবীকালের ছবি সামনে রেখে।

কোন মন্তব্য নেই: