“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭

মেজাজ উদ্ভূত সমস্যা ও প্রতিকার

।। সুদীপ নাথ।।
(আজ দৈনিক সংবাদের ১৩ পাতায় প্রকাশিত হয়ছে। )




কটা কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো মানুষেরই মানসিকতা সবসময় স্থায়ী কোনো বিষয় নয় শত-সহস্র তথা অসংখ্য অতি সূক্ষ্ম সব বিষয়বস্তুর সমন্বয়ে একজনের মানসিকতা গড়ে উঠলেও তা যেকোনো সময় পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। নূতন নূতন উদ্দীপনা বা সংকেত বা ভাষার মাধ্যমে, নূতন তথ্যের আগমনে মানসিকতা ধীরে বা দ্রুত পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। যেখানে পরিবেশ তথা সমাজ, যত দ্রুত পরিবর্তিত হয়, সেখানে মানসিকতাও তত দ্রুত পরিবর্তিত হয়। ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে , তার স্থান পরিবর্তনে, তা আমাদের চোখে বেশি ধরা পড়ে। তথ্য আহরণও মানসিকতা পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এক কথায় বলা যেতে পারে, মানসিকতা পরিবর্তনশীল, তা ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রেই হোক আর সমাজের সবারই হোক। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সমগ্র মানবজাতির সংগৃহীত জ্ঞানের মোট পরিমাণ প্রতি দশ বছরে মোটামুটি দ্বিগুণ হয়। তাই এই দ্রুতলয়ে তথ্যের বৃদ্ধি ও এসবের প্রতিফলন, আমাদের মানসিকতাকে দ্রুত পরিবর্তন করে চলছে, তা সহজেই অনুমেয়। তবে এটাও ঠিক একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট মানসিকতা অনুমান করা যায়। সেটাও হয় প্রতিটা বিষয় ভিত্তিক। একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে একজন একটা নির্দিষ্ট আচরণ প্রদর্শন করে। এইভাবে ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়েই আমরা এগুতে থাকি। কিন্তু তার পরেও কয়েকটা প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্নটা উঠেছে শারীরিক দিক থেকে। শারীরিক দিক থেকেও বিষয়টার ভাগ আছে। একটা হল, জন্মগতভাবে সমস্ত শিশুর কি মস্তিষ্কের এবং স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপের বৈশিষ্ট্য একরকম কিনা। আর অন্যটা হল, জন্মকালীন সময়ে মস্তিষ্কের ও স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপের বৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালে পালটে যায় কিনা। দীর্ঘ দিনের অধ্যয়ন, অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে এ পর্যন্ত চব্বিশটিরও বেশি ধরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিশুরা জন্মগ্রহণ করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই চব্বিশটির বেশি বৈশিষ্ট্যকে মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদির দ্রুত ও নির্ভুল প্রসেসিং মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণে মস্তিষ্ককে সাহায্য করে। যদিও সমস্ত মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ একই ধরণের, কিন্তু তা সত্ত্বেও মস্তিষ্কের জৈবিক গঠন বিভিন্ন কারণে সবার একরকম হতে পারে না। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠে উত্তেজনা ও নিস্তেজনা প্রক্রিয়াগুলোর অনুপাত, ঐসবের দ্রুততা এবং শক্তিমত্তার উপর নির্ভর করে। এই তিনটি মৌলিক স্নায়ুপ্রক্রিয়াকে, উত্তেজনা-নিস্তেজনার তিনটি ধর্ম হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে উত্তেজনা-নিস্তেজনার ভারসাম্য (balance), দ্বিতীয়টি হচ্ছে গতিময়তা (mobility), আর তৃতীয়টি হচ্ছে শক্তি (strength) ভারসাম্য বলতে এখানে যা বলছি তা হলো, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল বা কেন্দ্রে উত্তেজনা কেন্দ্রীভূত হওয়া বা নিস্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার সমতা অর্থাৎ মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতা। গতিময়তা বলতে যা বলতে চাইছি তা হল, উদ্দীপনা বা সংকেত গৃহীত হলে, তার কারণে কোন অঞ্চল বা কেন্দ্রের, উত্তেজনা থেকে নিস্তেজনায় অথবা নিস্তেজনা থেকে উত্তেজনায় রূপান্তরিত হবার মাপকাঠি। শক্তি বলতে যা বলছি তা হল, আগত উদ্দীপনার চাপ মস্তিষ্ক কোষ কতটুকু সইতে পারে তার ক্ষমতা তথা মাত্রা। এই শক্তি মাত্রার ভিত্তিতে সমস্ত প্রাণীর ক্ষেত্রেই দুটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। একটি শ্রেণিকে বলা হয় সবলও অপরটিকে বলা হয় দুর্বলশ্রেণির বৈশিষ্ট্যের মস্তিষ্ক। একটি কথা আগেই বলেছি যে, জন্মের পরই শিশুর চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই চারটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তিনটি সবল শ্রেণিভুক্ত, আর একটি মাত্র দুর্বল শ্রেণির মধ্যে পড়ে। 

এই চারটি বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
 ১। সবল শ্রেণির প্রথমটিকে বলে অতিচঞ্চল বা CHOLERIC, অনেকে বলে রগচটা
 ২। সবল শ্রেণির দ্বিতীয়টিকে বলে প্রাণচঞ্চল বা SANGUINOUS, অনেকে বলে হাসিখুশি
 ৩। সবল শ্রেণির তৃতীয়টিকে বলে PHLEGMATIC, অনেকে বলে আত্মপ্রতিষ্ঠ
 ৪। দুর্বল শ্রেণির একমাত্র বৈশিষ্ট্যকে বলে বিমর্ষ বা MELANCHOLIC
            এবার এই চারটি বৈশিষ্ট্যের ব্যবহারিক দিকটা একটু আলোচনা করা যাক। যে সকল শিশু অতিচঞ্চল মেজাজের অধিকারী, তারা সাধারণত চঞ্চল ও লড়াকু হয়ে থাকে এবং দ্রুত ও সহজেই উত্তেজিত হয়ে উঠে। তারা খুবই চটপটে ও আবেগপ্রবণ, তারা সহজে নিজেদের বাসনা দমন করতে পারে না এবং পরিকল্পিত কাজ ত্যাগ করতে পারে না। যখনই স্থায়ী বাধা নিষেধের সাহায্যে, এই ধরণের শিশুদের সক্রিয়তা দমন করার চেষ্টা করা হয়, তখন সমস্যা দেখা দেয়। এই ধরণের স্নায়বিক ব্যবস্থার উপযোগী স্বাভাবিক চাহিদাগুলোর সাথে মা বাবার ধারণার আপসহীন বিরোধ দেখা দেয়। কারণ মা-বাবারা তাদের সব সন্তানের কাছ থেকেই লক্ষ্মী ছেলের মত ব্যবহার, চালচলন আশা করে বসে থাকে। যে সকল শিশুর এই ধরণের মেজাজ আছে, তাদের পক্ষে যথেষ্ট শারীরিক চাপ, ছুটাছুটি এবং খেলাধুলা খুবই প্রয়োজনীয়। তবে শিশুর স্বাস্থ্য দুর্বল হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে দ্রুত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে, নতুবা পরিণাম খুব খারাপ হবে। শারীরিক চাপ, ছুটাছুটি ও খেলাধুলায় তারা তাদের অসামান্য শক্তি ব্যয় করতে পারবে এবং তার দ্বারা তারা অধিকতর স্থির ও শান্ত হয়ে উঠবে। এই ধরণের ছেলেমেয়েরা যদিও তারা সহজেই উত্তেজিত হয়ে উঠে, তথাপি তারা মৌখিক শাস্তি এবং তিরস্কার সইতে পারে। বিশেষ কোন মানসিক জখম এদের মধ্যে দেখা যায় না। তবে ছুটোছুটি বন্ধ করার মত শাস্তি দিলে অর্থাৎ তার বৈশিষ্ট্য সঞ্জাত স্বাধীনতা থেকে সে বঞ্চিত হলে, সেই ধরণের শিশুরা খুবই যন্ত্রণা ভোগ করে। এদের মধ্যে উত্তেজনা-নিস্তেজনার সমতার অভাব বিশেষভাবে প্রতীয়মান হয়। নিস্তেজনার ক্রিয়া এদের খুবই দুর্বল, নিস্তেজনার উপাদান এদের কম। কোলেরিক টাইপের মানুষ সাধারণত অতিমাত্রায় উৎসাহী হয় তাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। তারা যেন সবসময়ই প্রাণশক্তি ও কর্মশক্তিতে টগবগ করছে। এরা স্বভাবতই অসহিষ্ণু, অসংযত এবং অস্থিরমতির হয়। এই টাইপের মানুষ সাধারণ নতুনত্বের সন্ধানী হয়। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে এরা বিপজ্জনক এবং সাধ্যের অতীত কাজে প্রণোদিত হয়। সেইজন্য এদের জীবনের পরিণতি প্রায়শই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরা অনেকসময় যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না এবং খেয়াল খুশিমতো অপরিকল্পিত কাজে জড়িয়ে পড়ে। এই ধরণের বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের মধ্যে, খুবই অল্পসংখ্যক যারা সাফল্যলাভ করে, তারা বিখ্যাত লোক হয়ে উঠে। এই ধরণের চরিত্রের প্রকাশ শিশুদের মধ্যে দেখা গেলে, মা বাবাকে শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়তির হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা শৈশবকালেই নিতে হবে। সঠিক লালন-পালনের মাধ্যমে এই বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনযোগ্য।
সবল শ্রেণির তিন রকম বৈশিষ্ট্য সমন্বিত মেজাজের তথা চরিত্রের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে প্রাণচঞ্চল বা স্যাঙ্গুইনাসএই বৈশিষ্ট্যের সাথে কোলেরিক টাইপের কিছু কিছু মিল থাকলেও পার্থক্যটাই বেশি। স্যাঙ্গুইনাস টাইপের লোকেরা একসঙ্গে অনেক কাজে মন বসাতে পারে। তারা কোলেরিকদের চেয়ে কম চটপটে হলেও, তারা সাধারণত প্রাণোচ্ছল, স্ফূর্তিবাজ, উদ্যমী ও মেহনতি হয়ে থাকে। তাদের মনখারাপ হতে দেখা যায় না। তারা আগ্রহের সঙ্গে তাড়াতাড়ি খেলাধুলায় মত্ত হতে পারে। তারা খুবই অধ্যবসায়ী এবং সহজেই বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। কান্নাকাটি এবং কোনপ্রকার আবেগ উচ্ছ্বাস ছাড়াই তারা সবরকম শাস্তি ভোগ করতে পারে।
স্যাঙ্গুইনাস মেজাজের অধিকারী ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কে উত্তেজনা থেকে নিস্তেজনা এবং নিস্তেজনা থেকে উত্তেজনা সহজেই ঘটে থাকে। তাদের মস্তিষ্কের গতিময়তা খুবই বেশি। উত্তেজনা-নিস্তেজনার রূপান্তর সহজেই ঘটে বলে এবং তাতে একটা সমতা থাকায়, পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে খুব সহজেই এরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে মনোনিবেশ করতে পারে অবলীলাক্রমে। এরা অল্পেতে সাড়া দেয় এবং তা উৎসাহেরই সঙ্গে। কোলেরিকদের সঙ্গে এদের মূল পার্থক্যটা হচ্ছে, এরা সংযমীএরা উত্তেজিত ও নিস্তেজিত সহজেই হয় বটে কিন্তু আত্মসংযমের ক্ষমতা এদের যথেষ্ট বেশি।
স্যাঙ্গুইনাসরাও কোলেরিকদের মত উচ্চাভিলাষী, প্রাণশক্তিতে চঞ্চল, কিন্তু তারা কোলেরিকদের মত মাত্রাজ্ঞানহীন নয়।এরাও আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু হঠকারী নয়। এরা নিজেদের ক্রোধ ও আবেগ দমন করতে পারে। স্থান কাল পাত্র বিচার করতে পারে এবং সুসংহত আচার আচরণ প্রদর্শন করতে পারে।নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে এরা সজাগ, কিন্তু বাস্তবের বাধা বিপত্তি সম্পর্কেও এরা সচেতন। কাজেই কোলেরিকদের মত অপরিকল্পিত বিপজ্জনক কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে, অসফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা এদের খুব কম। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক তথা মন্ত্রীদের, এই ধরণের মেজাজ দেখা যায়। এই ধরণের মেজাজের অধিকারী ছেলেমেয়েদের নিয়ে মা-বাবাদের খুব বেশি ভুগতে হয় না। তবে এমন ধারণা পোষণ করা উচিৎ নয় যে, এ ধরণের ছেলেমেয়েরা নিজে থেকেই জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারবে। যেকোনো ছেলে মেয়ে যেকোনো সময় পরিবেশের কোনো নেতিবাচক আনুকূল্যে বিপথগামীতার শিকার হতেই পারে, বিশেষত কিশোর বয়সে। তাছাড়া সুস্থতা এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপার তো আছেই। আবার অনেক মা-বাবাও, অজ্ঞানতার কারণে অনেকসময় নেতিবাচক পরিস্থিতি তথা বিষয়বস্তুর আমদানি করে এবং ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
এবার আসি নির্বিকার তথা ফ্লেগমেটিক টেম্পেরামেন্ট বা মেজাজের অধিকারী ছেলে মেয়েদের কথায়।এক কথায় অনেকে এদের শান্ত প্রকৃতির মেজাজের অধিকারীও বলে থাকে।যে শিশুরা স্যাঙ্গুইনাস শিশুদের চেয়েও অধিকতর শান্ত, তাদের বাহ্যিক আচরণেও থাকে সংযমী ভাব এবং স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয় বাহ্যিক মন্থরতা। এই শিশুরা অতীব অধ্যবসায়ী এবং খুবই কর্মক্ষম। কিন্তু সমস্তকিছুই করে অত্যন্ত ধীরে এবং আপন মনে। অন্যান্য শিশুদের ভিড়ের মধ্যে শান্ত স্বভাব ও গাম্ভীর্যের জন্য এদের সহজেই চেনা যায়। এই ধরণের শিশুদের অনেকসময় সক্রিয় করে তুলতে হয়। বিভিন্ন কাজের প্রতি তাদের মধ্যে আগ্রহ বিকশিত করতে হয়। তবে তারা একবার যে অভ্যাস রপ্ত করে, তা শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে উঠে এবং সুদীর্ঘ বছর টিকে থাকে। ঠিক সেই কারণেই এদের জীবন ধারণের নিয়ম, অভ্যাস ও অনুরাগের ব্যাপারে খুঁটিনাটি সমস্ত কিছুই মা-বাবাদের ভালোভাবে ভাবা দরকার। ফ্লেগমেটিক চরিত্রের ছেলে মেয়েরা জীবনের দৌড়ে একবার পিছিয়ে পড়লে, তা থেকে পুনরুদ্ধার পাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু স্যাঙ্গুইনাসদের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই দেখা যায় কিশোর বয়সের, অতি অধঃপতন থেকেও নিজের চেষ্টায় চূড়ান্তভাবেই ফিরে দাঁড়িয়েছে এবং জীবনে অনেক বড় কাজ করেছে। এমতাবস্থায়, ফ্লেগমেটিক চরিত্রের ছেলেমেয়েদের মা-বাবারা যদি শৈশব অবস্থায় সঠিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব না নেন তবে সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং এই প্রশ্নে অবশ্যই বলা যায় সন্তানের ভবিষ্যৎ মা বাবারই হাতে।
ফ্লেগমেটিকরা প্রায়শই ঘাতসহ, অচঞ্চল এবং সংযমী। এরা উদ্যমশীল, অধ্যবসায়ী এবং অক্লান্ত পরিশ্রমী হয়। কিন্তু তাদের সবকিছুই খুবই সময় সাপেক্ষ। এই টাইপের মানুষের একই কাজে লেগে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ। একই উদ্দীপক অনেকক্ষণ ধরে মস্তিষ্কে ক্রিয়া করলেও প্রতিরক্ষামূলক নিস্তেজনা নেমে আসে না। এরা চট করে বিষয়ান্তরে যেতে পারেনা বটে, কিন্তু বিফলতা এদের উদ্যমকে কমাতে পারে না। নিজের কাজ করে চলে ধীরে সুস্থে, প্রতি পদে ভেবে চিন্তে।এরা অনেকদিন ধরে কষ্টসাধ্য কাজ করার শক্তি রাখে এবং এরা দীর্ঘস্থায়ী গবেষণার কাজের উপযুক্ত

এবার দুর্বল শ্রেণির একমাত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক। দুর্বল টাইপ তথা বিমর্ষ টাইপের মস্তিষ্কের মানুষের,  সহ্য ক্ষমতার বিশেষ অভাব থাকে। পরিবেশের সামান্য চাপে, উত্তেজনা কিছুটা বাড়লেই, তাদের ক্রিয়াকলাপে বিশৃঙ্খলা প্রকাশ পায়। উত্তেজনার উপাদান মস্তিষ্কে কম, তাই উত্তেজনার মাত্রা বাড়ার ফলে আত্মরক্ষামূলক নিস্তেজনা নেমে এসে, মস্তিষ্ক কোষের ক্ষয়ক্ষতি নিবারণের চেষ্টা করে। এদের মস্তিষ্কের মধ্যে নিস্তেজনা প্রবাহ সহজেই ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা থাকার দরুন, এরা সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে। এই টাইপের মানুষের বেলায় উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব দেখা যায়। স্বভাবতই এরা বিষণ্ণ, তাই এদের বলা হয় বিষণ্ণ বা মেলানকোলিকটাইপ। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীদের মধ্যে এই টাইপেরই আধিক্য দেখা যায়অপরদিকে, সবল টাইপের মস্তিষ্কে উত্তেজনার উপাদান বেশি থাকে, তাই তারা উত্তেজনার মাত্রা অনেকটা অবধি সহ্য করতে পারে। অনেকক্ষণ ধরে উত্তেজিত থাকলেও এরা ঘুমিয়ে পড়ে না, উত্তেজনার ফলে এদের মস্তিষ্ক-ক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না। দুর্বল টাইপের বিশেষত্ব এই যে,তাদের মস্তিষ্কে উত্তেজনা এবং নিস্তেজনা দুটোরই তীব্রতার অভাব পরিলক্ষিত হয় এবং স্নায়ু প্রক্রিয়ার মাত্রাও এদের কম। এদের সহ্যক্ষমতাও কমউত্তেজনা ও নিস্তেজনার মাত্রা একটু বাড়লেই এরা আর তা সইতে পারেনা। উচ্চ মস্তিষ্কের তথা কর্টেক্সের ক্রিয়া কলাপের বিশৃঙ্খলা এদের মধ্যে অতি সহজেই প্রকাশ পায়। নিউরোসিসের প্রধান উৎস হল এই দুর্বল টাইপের মস্তিষ্ক বিষাদ রোগের প্রাদুর্ভাব এদের মধ্যে বেশি। এরা অল্পতেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। এরা আত্মবিশ্বাস থেকে বঞ্চিত এবং সব কাজে উৎসাহের অভাব বোধ করে। এরা সবকিছুতেই ভয় পায় এবং সবসময় অতিমাত্রায় উৎকণ্ঠিত থাকে নতুবা ঘুমিয়ে থাকে। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে এদের খুবই অসুবিধা হয়। বিপদ আপদের সময় বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এরা পরিবর্তন ও নতুনত্বকে সন্দেহের চোখে দেখে।
মেলানকোলিক তথা দুর্বল স্নায়ু-ব্যবস্থার অধিকারী শিশুদের বেলায় মা-বাবাকে বিশেষভাবে বিবেচনা-শীল ও সতর্ক হতে হবে। অত্যধিক উত্তেজনাশীলতা , বদমেজাজ, কাঁদুনে স্বভাব এবং উচ্চ সংবেদনশীলতা অনেকসময় মা-বাবার ভুল লালন-পালনের জন্য, জটিল থেকে জটিলতর হয়। তার ফলে শিশু বয়সেই দেখা দিতে পারে নিউরোসিস নামে মানসিক রোগ। এই ধরণের শিশুরা প্রায়শই নিঃচেষ্ট, ভীরু এবং লাজুক প্রকৃতির হয়। তারা প্রবল স্নায়বিক চাপ সহ্য করতে কমবেশি অক্ষম। এদের যত বেশি সম্ভব অন্য শিশুদের সঙ্গে দল বেঁধে খেলাধুলায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এদের দ্বারা উদ্যোগ এবং আত্ম-নির্ভরশীলতা প্রকাশের ছোট খাট প্রয়াসও, দৃঢ়ভাবে সমর্থন করা উচিৎ। মা-বাবাদের পক্ষ থেকে সমস্ত ব্যাপারে তাদেরকে সবসময় অনুপ্রেরণা যোগানো অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যায়াম এবং হাইড্রোথেরাপিউটিক প্রসিডিওর, এই ধরণের শিশুদের জন্য অপরিহার্য। কেননা এইসব তাদের মজবুত করে তুলে, তাদের স্নায়ু ব্যবস্থা দৃঢ় করে এবং দেহযন্ত্রের শক্তি বৃদ্ধি করে।
অন্যান্য ধরণের মেজাজের ক্ষেত্রেও, শরীরচর্চা বলা বাহুল্য অনুরূপ ভূমিকাই পালন করে থাকে। তবে যে সমস্ত শিশুর স্নায়ু-ব্যবস্থা দুর্বল তাদের পক্ষে দৈনন্দিন জীবন যাত্রার সঠিক রুটিনে অভ্যস্ত হতে অনেক বেশি অসুবিধা হয়। তারা সবরকম দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। কারণ তা তাদের কাছে কষ্টকর ব্যাপার বলে মনে হয়। এমতাবস্থায় সন্তান লালন-পালনের সঠিক পদ্ধতি এবং সুবিবেচিত ব্যবস্থাই কেবল সুফল দিতে পারে।
মা-বাবার পক্ষে শিশুর স্নায়ুব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যাবলী বোঝা এবং লালন পালনের উপায় খুঁজে বের করাটা খুবই জটিল। তার জন্য চাই আন্তরিক সংবেদনশীলতা ও বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা। তবেই সন্তান লালন-পালনের কাজে যেকোনো প্রচেষ্টা সার্থক বলে প্রতিপন্ন হবে হতে                      


কোন মন্তব্য নেই: