“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বহুভাষাবিদ মনীষী হরিনাথ দে

।। সুনীতি দেবনাথ।। 
(C)Image:ছবি
নিশ শতকে ভারতে রেনেসাঁ চলার সময়ে এই রেনেসাঁর কেন্দ্র হয়ে  উঠেছিল বলা যায় বাংলা। আর বাংলায় তখন এমন এক অদ্ভুত আশ্চর্য সময় অদ্ভুত উত্তাল আর উদ্বেল হয়ে ওঠে। এ সময় আশ্চর্য নক্ষত্রের মত সব মানুষেরজন্ম ও জীবন ভারত তথা বাঙালির নবজাগরণকে সার্বিকভাবে বিপুল গতিতে অন্য এক দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এক বিস্ময়কর সময়, যখন বিপুল প্রাণশক্তিতে বাংলাকে বাংলা সমৃদ্ধ জীবন ও ইতিহাসকে ভিন্নতর মাত্রায় পৌঁছে দিতে যেন আশ্চর্য সব মানুষ এক মহাপ্রাণতায় আবির্ভূত হচ্ছিলেন। এতো নক্ষত্রের সমাবেশ এর আগে বা পরে বাংলা দেখেনি। বিশেষ করে উনিশ শতকে জন্মে বিশ শতক অবধি জীবনের ব্যাপ্তিকালকে প্রসারিত করে বহু বহু প্রতিশ্রুতিবান মনীষী জীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা মাত্রা ও পরিধি সংযোজন করে যেভাবে বাংলার সর্বকালের জীবনযাত্রায় আশ্চর্য সময়কালের পত্তন করেছিলেন, সেই প্রেক্ষিতে আজকের বাংলার দিকে তাকালে হতাশায় বিদ্ধ হতে হয়। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় উনিশ শতকের ১৮৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৮৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণদীপ্ত বেশ কজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে বাংলাকে বিশ্বদরবারে পরিচিতি দিলেন বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 
            এই বিচিত্র সময়েই বাংলার চিরবিস্ময় এক বঙ্গসন্তান মহামনীষী,বহুভাষাবিদ্, আশ্চর্য প্রতিভাধর সুপণ্ডিত, শিক্ষাবিদ্ ও ভাষাবিজ্ঞানের বঙ্গভাষায় উদ্গাতা হরিনাথ দে জন্মগ্রহণ করেন। হরিনাথ দের প্রতিভা ও কর্মময়তা আর অবদান সম্পর্কে বলা যায় বাঙালি আলোচক, সমালোচক ও লেখকেরা কিছুকাল সরব আলোচনা করে গেলেও, পরবর্তীতে যথোচিত বিচার - বিশ্লেষণ তেমনভাবে করেছেন বলে মনে হয় না। অথচ এই বিস্ময় মানুষটি তাঁর অপরিসীম জ্ঞানবত্তা,বহুভাষাবেত্তা, নিষ্ঠা ও প্রতিভা নিয়ে একসময় সারা পৃথিবীতে প্রভূত সম্মান লাভ করেছিলেন এবং পৃথিবীবাসীকে স্বল্পস্থায়ী জীবনে চিরস্থায়ী বহু সম্পদ দান করে বিস্মিত করে গেছেন। বঙ্গভাষায় তাঁর পারঙ্গমতা ও কৃতিত্ব বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে, বিশেষ করে ভাষাবিজ্ঞানের ভারতীয় পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর কার্যকলাপ অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি দিতে পেরেছে। এই বঙ্গবাসী ও সম্মানিত বঙ্গসন্তানের জন্য আমরা যুগপৎ সম্মান ও গৌরব অনুভব করি। আর বহু ভাষাবিদ হিসেবে অপার বিস্ময়।
            হরিনাথ দে পশ্চিমবঙ্গের কামারহাটির আড়িয়াদহ গ্রামে ১২ আগস্ট ১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার কাছাকাছি এই গ্রাম বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত। তাঁর পিতা ভোলানাথ দে রাইপুর সেন্ট্রালের ( বর্তমান ছত্তিশগড়) ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের একজন পদস্থ অফিসার ছিলেন।। রাইপুরে যে বাড়িতে শৈশবে হরিনাথ দে বসবাস করেন, সে বাড়িতে ১৮৭৭ সাল থেকে ১৮৭৯ সাল অব্দি তরুণ নরেন্দ্র নাথ দত্ত বাস করেন। নরেন্দ্র নাথ দত্ত পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ রূপে বিশ্ব বন্দিত হন।
            হরিনাথ শৈশবের পড়াশোনা রাইপুর হাই স্কুলে করেন এবং পরবর্তী পড়াশোনার জন্য কলকাতা যান। এখানে এসে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে পড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে  হরিনাথ প্রেসিডেন্সির ছাত্র হিসেবেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাটিন ও ইংরেজি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে ষাণ্মাসিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং এই বছরই তিনি কলিকাতা  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাটিন ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান নিয়ে পাশ করে সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষালাভের জন্য বিলাতে গেলেন। সেখানে ক্রাইস্ট'স কলেজে ভর্তি হন। কেম্ব্রিজে পড়ার সময়েই হরিনাথ গ্রীক ভাষায় এম.এ.-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। এই পরীক্ষা তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে দিয়েছিলেন। ঠিক একই সময়ে হরিনাথ প্যারিসে গিয়েছিলেন, সেখানে সরবোনস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা শেখেন। এরপর ইজিপ্ট গিয়ে আরবি ভাষা শেখা শেষ করেন। 
            আরবি ভাষা শেখা শেষ করে হরিনাথ জার্মানির মারমুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য গেলেন। এখান থেকে তিনি সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ এবং আধুনিক ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান আহরণ করেন। ১৯০০ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ' ক্লাসিক্যাল ট্রাইপস্ 'পরীক্ষার প্রথম ভাগ দিলেন এবং এই পরীক্ষায়ও প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন। পরবছরই তিনি মধ্যযুগীয় আধুনিক ভাষায় ট্রাইপস্ পরীক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করলেন।কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরিনাথ দে গ্রীক, লাতিন, হিব্রু ভাষায় শিক্ষা লাভ করে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন।
            ১৯০১সালের শেষ দিকে হরিনাথ দে দেশে ফিরে এলেন। সে সময় পর্যন্ত ভারত সরকারের শিক্ষাবিভাগে উচ্চপদের বৃত্তিতে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হতোনা। হরিনাথ বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পর তাঁকে ঢাকা সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এক নীরব বিপ্লবে নিজের যোগ্যতা দিয়েই সেদিন জয়ী হলেন এই বহুভাষাবিদ ভারত সন্তান। তিনি বিদেশী শাসকের শিক্ষা বিভাগে উচ্চপদে নিযুক্ত প্রথম ভারতীয়।
  ১৯০৫ সালে হরিনাথ বদলি হলেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক রূপে। অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত থাকলেও তিনি ছিলেন এক চিরপিপাসু এক শিক্ষার্থী। বিশ্বের বহু বিচিত্র ভাষা, তাদের উদ্ভব, গতি ভঙ্গিমা আর সম্পদের প্রাচুর্য হরিনাথকে একদিনের জন্যও আকর্ষণ বিমুক্তি করেনি। এই মৌলভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি একটার পর একটা ভাষা নিয়ে প্রতিনিয়ত চর্চায় নিরত থেকেছেন,একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে গেছেন, সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোধহয় একটা সত্যের কাছাকাছি আমরা যেতে পারবো ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে তিনি কেন বারবার পরীক্ষার সামনাসামনি হলেন, কেনইবা সেসব পরীক্ষায় সর্বোত্তম হতে চাইলেন, এই বিষয়টা। ভাষাচর্চা কি তাহলে কেবল পরীক্ষা নির্ভর মাত্র? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় ভাষাচর্চা ব্যক্তির স্বকীয় প্রয়াস, নিষ্ঠা এবং নিরলস সাধনার উপর উৎকর্ষতার জন্য নির্ভরশীল হতে পারে সত্য, তবে পরীক্ষার মাধ্যমে যখনই এই চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তখন পূর্বজদের সমৃদ্ধ চিন্তা ভাবনার নিরিখে একটা সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে সেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা একটা গণ্ডীরেখার মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যপথে আরো সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হতে পারে। প্রসঙ্গত আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড.রণেন্দ্রনাথ দেবের একটা মূল্যবান কথা মনে পড়ছে। তিনি একদিন নানা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, " প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি কোনদিনই মানুষের শিক্ষার ব্যাপারে শেষ কথা বলতে পারেনা। আসলে পরীক্ষা মানুষের মনের দরজা জানালাগুলো খুলে দেয় মাত্র। এই খোলা পথে বিচরণ করে আমরা বিশ্বব্যাপ্ত শিক্ষালয়ের অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পাই মাত্র। পরীক্ষার শেখাটা হচ্ছে পাসপোর্ট এ নিয়ে মানুষ জালনার জগতে, জ্ঞানের উন্মুক্ত জগতে একা চলার, সংগ্রহ করার অধিকার অর্জন করে। আর তখনই সে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের, সাঙ্গীকরণের সুযোগ পায়। 
  
            হরিনাথ দে সম্পর্কে আলোচনাকালে আনুষঙ্গিকভাবে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. দেবের কথা বারবার মনে পড়ছে। ১৯০৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনাকালে হরিনাথ আবারো পরীক্ষার্থী হয়েছেন। সংস্কৃত, আরবি ও ওড়িয়া ভাষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এমনকি সরকারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পারিতোষিক লাভ করেন। আজকের দিনে এই টাকার মূল্য হাস্যকর। কিন্তু যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন তা বিশাল।পরবছরই ১৯০৬ সালে প্রাইভেট ( স্বাধীন) পরীক্ষার্থী হয়ে হরিনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ.পাশ করেন। ১৯০৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুনভাবে শুরু হলো ভাষাবিজ্ঞানীদের ( "Linguistics)এই বিভাগেও মনীষী হরিনাথ দে-কে প্রথম অধ্যাপকরূপে নিয়োগ দেওয়া হলো। কলকাতায় ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী স্থাপিত হবার পর এতে বিলাত থেকে জন ম্যাকফারসন প্রথম লাইব্রেরিয়ান হয়ে যোগদান করেন। তিনি লন্ডনে ব্রিটিশ  মিউজিয়ামে সহকারী গ্রন্থাগারিক ছিলেন। কলকাতার ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরী এখন " ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ ইণ্ডিয়া "। জন ম্যাকফারনেল পরলোকগত হলে দ্বিতীয় লাইব্রেরিয়ান হলেন হরিনাথ দে। সেকালের ও একালের সম্মানিত এই লাইব্রেরী অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডার যেখানে স্তরে স্তরে সজ্জিত থেকে জ্ঞান মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার গভীর নির্ঘোষ উচ্চারণে মুখরিত। ভারতীয় হিসেবে পরাধীন দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি শ্লাঘার। কারণ হরিনাথ দে হচ্ছেন সেই বিদগ্ধ ভারতীয় যিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই বিরল সম্মান পেলেন। আরেকটু ব্যাখ্যা করে  বলা যায়, হরিনাথ দের মত বহুভাষাবিদ, অগাধ পাণ্ডিত্যের সমুদ্র, ভাষাবিজ্ঞানীরই উপযুক্ত এই পদে নিয়োগ পদটির সম্মান যেমন বাড়ালো, তেমনি ভারতীয় প্রতিভা বিশ্ববিদ্বদ্ সমাজে স্বীকৃতি পেলো। 
            ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরীতে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করার সময়েও হরিনাথ কলিকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত ভাষার দুটি বিভাগে এম.এ.পরীক্ষা দেন। দুটিতেই প্রথম বিভাগে প্রথম হন। একজন ইতিহাসবিদ, বিদ্বান ও বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে তখনকার ইম্পিরীয়্যাল লাইব্রেরি আর বর্তমান ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইণ্ডিয়ার প্রথম লাইব্রেরিয়ান হয়ে ১৯০৭ সাল  থেকে ১৯১১সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। চৌদ্দটি ভাষায় এম.এ.পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। চৌদ্দটি ভারতীয় ভাষা, এশীয় ও ইউরোপীয় ভাষাসমূহের ২০টি ভাষায় ছিলো তাঁর পারদর্শিতা। অর্থাৎ সর্বমোট চৌত্রিশটি ভাষায় তাঁর কিংবদন্তীতূল্যঅধিগম্যতা ছিলো। ভারতে প্রথম ভাষাবিজ্ঞান বা Linguistics-এর পথিকৃৎ ছিলেন হরিনাথ দে।  "এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের সঙ্গে ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠতা। বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে সম্পর্কে একটা কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, তিনি যেসব ভাষা শিখেছিলেন, সেসব ভাষার মর্মস্থলে তিনি প্রবেশও করেছিলেন। মাতৃভাষার মত প্রতিটি ভাষায় সাবলীলভাবেই তিনি বার্তালাপ,লেখালেখি ও চিন্তাভাবনায় সক্ষম ছিলেন। মোদ্দা কথা প্রতিটি ভাষার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তাঁকে ভাষার অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। আরও উল্লেখ করতে হয় অতীত ভাষাসমূহের উৎপত্তি, বিকাশ ও সমৃদ্ধির বিষয়েও তাঁর জ্ঞান ছিলো অপরিসীম। বলতে হয় তিনি শুধু ভাষাবিদ ছিলেন না ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানীও, আর এ বিষয়ে তিনি ভারতীয়দের পথিকৃৎ।

  সুপণ্ডিত হরিনাথ দে ম্যাকুলে'স এসে অন মিল্টন ( Macaulay's Essay on Milton)গ্রন্থের. একটি নতুন সংস্করণ ১৯০২ সালে প্রকাশ করলেন। পরের বছর তিনি আরেকটি বিস্ময়কর প্রকাশনার ক।জ সম্পন্ন করলে প্যালগ্র্যাভস্ম গোল্ডেন ট্রেজারি ( Palgrave 's Golden Treasury) বইটির নবরূপায়ন করে সম্পাদনা ও প্রকাশনা দুটিই করলেন। এরপর হরিনাথ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইবন বতুতা রচিত বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী " রিহলা ( Rihla) - এর ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ। তিনি জালালউদ্দিন আবু জাফর মোহাম্মদের গ্রন্থ "আল্ ফাকরি " ( Al Fakhri) -এরও ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি আরবি ভাষার ব্যাকরণ নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লেখেন।
            হরিনাথ দের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির অন্যতম হচ্ছে "ইংরেজি –পার্শি অভিধান রচনা। তিব্বতি ভাষারও একটি অভিধান তিনি রচনা  করেন। হরিনাথ ঋকবেদের একটা অংশ উপনিষদ ও মূল শ্লোক সহ টীকাভাষ্য ভাষ্য সহকারে তিনটি  ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন। 
            হরিনাথ দে এছাড়াও বহু বিখ্যাত গ্রন্থের টীকাকরণ, সম্পাদনা  ও অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। বহু গ্রন্থ ও সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ক পার্শি,চীনা, তিব্বতিরাও ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত রচনাসমূহের সম্পাদনা, টীকাভাষ্য রচনা ও অনুবাদ কর্মেও সাবলীলভাবে করেছেন। বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত " "লঙ্কাঅবতার সূত্র" ও " নির্বাণ ব্যাখ্যা শাস্ত্রম্ "সম্পাদনা করে তিনি প্রকাশ করেছিলেন। বহু আরবি, ফারসি, পার্শি, পালি ও বাংলা গ্রন্থেরও পূর্ণ বা আংশিক অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন।কয়েকটি সংস্কৃত নাটকেরও ইংরেজি অনুবাদ করে তিনি প্রকাশ করেন। যেমন সংস্কৃত নাট্যকার সুবন্ধু রচিত 'বাসবদত্তা ' নাটক। মহাকবি কালিদাস রচিত 'অভিজ্ঞানম শকুন্তলম 'ইত্যাদি। তাঁর স্বকীয় সৃষ্ট সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞানীদের, ও হিন্দুধর্ম বিষয়ক নানা রচনায় অষ্টাশিটি ভল্যুম "Harinath Details Collection " নামে পরিচিত এবং তা কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ ইণ্ডিয়াতে সংরক্ষিত অতি মূল্যবান সম্পদ। বহু  পত্রপত্রিকায় হরিনাথ দে রচিত অনেকানেক মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো।  তার কিছু সংখ্যক ১৯৭২ সালে সংকলিত ও সম্পাদনা করে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার থেকে প্রকাশ করেছেন। এই সংকলন গ্রন্থটির  নামকরণ করা হয়েছে — "Select Papers, Mainly Idiological " — ইংরেজিতে রচিত এই সংকলন অত্যন্ত মূল্যবান সংগ্রহ। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ কলকাতায় সংরক্ষিত, 'সেন্টিনারী ভল্যুম, হরিনাথ দে, জাতীয় গ্রন্থাগার, ১৯৭৭ ',অত্যন্ত মূল্যবান ও তথ্যসমৃদ্ধ সংগ্রহ, যা কৌতূহলী পাঠকের কাছে মনীষী হরিনাথ দে সম্পর্কে মূল্যবান আকর গ্রন্থ বলে পরিগণিত হয়। 
            জাতীয় গ্রন্থাগারে কর্মরত অবস্থায় ১৯১১ সালে ৩০ আগস্ট তারিখে বাংলা তথা ভারতের এই মহিমান্বিতর্ক প্রতিভার বিমূর্ত মূর্তি হরিনাথ দে মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে পরলোকগত হন। একটা কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স চৌত্রিশ বছর, আর পৃথিবীর উন্নত ভাষাসমূহের চৌত্রিশটি ভাষা সম্পর্কে তাঁর কিংবদন্তীতুল্য অপার জ্ঞান!
  এই প্রবাদপ্রতীম বহু ভাষাবিদ্ কেবলমাত্র বাংলা বা ভারতের সীমানায় তাঁর খ্যাতি নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বিশ্ব জোড়া ভাষার বিস্তৃত পরিসরে ও বিশ্ববাসীর নিকট অভূতপূর্ব ভাষাজ্ঞানী, বহুভাষাবেত্তা এবং অপার পাণ্ডিত্য নিয়ে সম্মানের আসন লাভ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পরম শ্রদ্ধায় উচ্চারণ করেছিলেন,
             'যাচ্ছে পুড়ে নতুন করে সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থমালা'
  হরিনাথ দের প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানাতে কবি সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে আমরাও কণ্ঠ মেলাবো।

কাজরী,
২৫ আগস্ট, ২০১৭ 
  
   
  
  

  

কোন মন্তব্য নেই: