“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৭

জীবন ধর্ম : পর্ব এক

।। সুমন পাটারী ।।
   
(C)Image:ছবি
         
ক-এক সময় ভাবতে বাধ্য হয়ে যাই কী জীবন নিয়ে আছি। আশি শতাংশ যুবক যুবতীর মতো সাধারণ ছাত্রজীবন ও মধ্যবিত্ত নম্বর নিয়ে গ্রাজুয়েট।  আজ চার বৎসর হলো পড়ালেখা ছেড়েছি। কি করবো এখন-- মাটি সহায় চাষ করতে হচ্ছে। করছি। তত দুঃখ নেই ভাত তো খেতেই হবে। আমার যোগ্যতা নেই সর্বোত্তম কি চাকরি আর পাবো!তাই দাদুর বাড়ি যাইনি আর সরিসার তেল নিয়ে।দাদুও হয়তো বেঁচে গেছে, বাবা পঁচিশ বছরের পুরানো কমরেড, হয়তো প্রশ্ন করেছিলো কি দিয়েছেন আমায়? কিন্তু বাবাকে যেভাবে হোক বুঝিয়ে রেখেছে। এখন বাবার চোখে বিদ্রোহ দেখি। কলমকে যদি সত্যি বলতে হয় বাবার মতো ভালো মানুষ জীবনে দেখিনি। বাবা বলে বলছি না, আমি জীবনকালে কখনো দেখিনি কূটনীতিক চাল অথবা নারীসুলভ কোনো সংকীর্ণমনতা ওনার ভিতর। রাগি লোক, উলটপালট কিছু দেখলেই রেগে যান, এভাবেই সবার শত্রু একসময়। আমিও তদ্রূপ হয়েছি। উঁচু গলায় কথা বলা আমাদের বংশগত রোগ। আমিও বদরাগী, নিয়মের বাইরে,রাগ হয় খুব, অনেক রাগারাগি মারামারি ও করেছি একসময় পাড়ায় ক্লাবে ও পূজা কমিটির সাথে থেকে। কেন তা আমি জানি, বাবাও কোথাও না কোথাও জানে আমি কেন এমন, কখনো কখনো খুব রাতে এসে বসে আমার ঘরে-- সিগারেট জ্বালাই বলে সচরাচর আসেন না, যখন আসেন কান্না কে চোখে বেঁধে আসেন, বোঝান, আমার মতো হতে যাচ্ছিস বাপ-- চোর না হোস অন্তত সূক্ষ্ম বুদ্ধির লোক হতে শিখ, তোর মানসিকতা ওরা বুঝবে না, ওদের সেই ক্ষমতা নেই, এখানে প্রতিবাদ যার জন্য করবি সেই তোকে চোর বলবে প্রথম। কথাটা সত্য অনেকবার সত্যি হয়েছে এমন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তুমি যদি কাওকে বিপদে সাহায্য কর সে নচ্ছার ভাববে যা পেয়েছি তাই লাভ। স্বাভাবিক কৃতজ্ঞতা বোধটুকু হারিয়ে গেছে। এমন আরো অনেক কথা আছে যা আমার বলতে ইচ্ছে হয়। বলতে পারিনা। ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রাগ বেঁচে থাকে। যার জন্য কবিতা লিখি। কবিতা হয় না, আমি জানি, শৈল্পিক কোনো কলা কৌশল আমার জানা নেই, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনো বই পড়িনি। কি আর কবিতা লিখবো। আজ তিন-চার বৎসর যাবত ধারাবাহিক ভাবে দৈনন্দিন দিনযাপন ও রাতের কথা লিখে আসছি।
           চাষি বলেই সারাদিন ছুটতে হয়, নিম্নবিত্ত শ্রেণী থেকে সামান্য উপরে অনেকটা জোড় করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে নাম রাখার মতো পরিবার আমার, একদিন এমন ছিলো ভাতের প্রচণ্ড অভাব, প্রাণপণ চেষ্টা করেও যখন বাবা বিছানা থেকে উঠতে পারেনি তখন হাত পা ছেড়ে দিয়ে ওনাকে কাঁদতে দেখেছি দরজার আড়াল থেকে। সামনে যাইনা পাছে আরো কষ্ট পায়।  সেখান থেকে কোমর বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছি। আজ অভাব নেই অনন্ত নিত্য জীবন ধারণের। তিন বোন প্রতিষ্ঠিত সংসারের মালিক। সুখেই আছে। বাবাকে একসময় জিজ্ঞেস করেছিলাম স্বার্থপরের মতো আমরা গরীব এতো বেচা বিক্রি করে ধার দেনা করে আপনি বোনদের বিয়ে দিচ্ছেন আমি তো কানা হয়ে যাবো। বাবা বললেন বাবার ঘরে ওদের সুখ দিতে পারিনি তাই পরবর্তী জীবনে ওদের সুখের ঠিকানা কিনে দিয়েছি। ওদের আর অভাব এক জিনিস তাড়াবে না। তুই আপাদমস্তক আমার ছেলে তুই চলে যেতে পারবি। আর জীবনের জন্য বোকা পুরুষরা সুখ সঞ্চয় করে। বাঁচতে থাক বেঁচে থাকার প্রবল বিশ্বাসে। ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা খুব বেড়ে গিয়েছিলো। এবং নিজের প্রতি ও।
             রাত, এই শব্দটা শুধু শব্দ অথবা বারোঘন্টার একটা সময় নয়। এখানে আমি আমার থেকে বেরিয়ে আমার মধ্যে বাঁচি। একটা ভুল করেছি, ভুল কিনা জানিনা, আমি আজও ভুল মানিনা। সেই ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হন্য ছিলাম। কখনো রাত হলে ভাবতাম যে কখনো আমি সামান্য রেগে থাকলে একশোবার কল করে দিতো পরদিন ভাড়াবাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যেতো সে এখন অন্য কারো বিছানায়। এই স্বপ্নটা আমার ছিলো। এই যে আগুন টা জ্বলে যেতো তা আমাকে লিখতে বাধ্য করেছিলো। লিখে লিখে সমস্ত রোগ সারিয়ে নিয়েছি। তবু একটা ব্যথা যা যত্নে লালন করি সবসময়।
          লিখতে এসে নিজেকে অন্যভাবে চিনেছি। শ্রদ্ধেয়া মধুমিতা নাথ। বিশেষ কিছু কখনো বলিনি তেমন কথাও হয়নি কবিতা পড়ে দুয়েকদিন দিদির মতো এমন কিছু কথা বলেছিলে যা আমার জীবন বদলে দিয়েছিলো। কি সেই কথাগুলো তাও জানিনা শুধু জানতাম বছর দুয়েক আগে ভিতরে আগুন লালন করা একটি বখাটে ছেলে আজ অনেকটাই শান্ত। সামনাসামনি মাত্র একবার ১০ মিনিট কথা বলেছি ফোনে মনে হয় না কখনো বলেছি। ম্যাসেজে বিরক্ত করেছি  একমাসে একঘণ্টা। এতো সহজাত জীবনের বোধ ওনার। আমার এই জীবন কালে দিদি একটা কথা ভুলবো না। "তোর কথা লোকে কতদিন শুনবে? লোকের কথা বল নিজে হালকা হবি"।
        জীবনের সমস্ত আয়োজন থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেকে কবিতার জন্য খুঁজতে চাইছি, এক অন্য স্বত্বা যা আমাকে আমার চোখে সম্মানিত করে তুলবে যা আমাকে চরম সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাবে। যেদিন আমি মন থেকে এটা মেনে নিতে পারবো সত্যি আমি একা দুখী নই একা প্রেমহীন নই একা সংঘর্ষে নেই একা ক্ষুধাকাতর যুবক নই একা সাংসারিক দৈনন্দিন কষ্টে নেই। আমি আমার মতো একটি মানুষ খুঁজছি। এই যে নিজেকে উলঙ্গ করে এতো কথা আমি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছি-- কোনো সহানুভূতি চাই? একদম না তবু বলতে হয় না হলে হয়তো কোথাও মরে যাবো ভিতরে যাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।  আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সমালোচনা করা ছাড়া কোনোও ওষুধ নেই আমার মতো মনরোগীদের। আমরা সব জানি সব বুঝি তবু বাস্তববিমুখ ভণ্ড, অথচ চূড়ান্ত বাস্তবতায় নিজেকে আমের পোকার মতো একটু একটু করে খাই,  হয়তো কোথাও গোপনে স্বপ্নের খোঁজে স্বপ্নের মানুষের খোঁজে, সুখের খোঁজে।

কোন মন্তব্য নেই: