“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৮

আন্দামান কবিতাগুচ্ছ














।। শিবানী দে।।



পক্ষীদর্শন


ব্লু-ব্ল্যাক নীলের খাড়াই থেকে ঝর্ণাধারার মত
সূর্যের কিরণধারা পড়ছে শুভ্র মেঘের আকাশহ্রদে       
সাত রঙ-এ গলে যায় মেঘ 
এই রঙ বুঝি ঝরে পড়ে নিচে সাগরের বুকে,
তখন জলের ভেতর অজস্র প্রবাল রঙ্গিন হয়,  
ফিরোজাকমলাহলুদ মাছের ঝাঁক ঝিলিক মেরে খেলে বেড়ায় নীল জলে,
রামধনুরঙা ঝিনুকের গর্ভে মুক্তোরা জন্ম নেয়

          
দিগন্তে মেঘের উচ্চচূড় পাহাড়,
কোথাও বা বুড়ো তপস্বীর জটা চুড়ো করে বাঁধা,  
কোথাও বা ধুনুরির পেঁজা তুলো ডাঁই করে রাখা,
কোথাও বা টানটান সাদা চাদরপাতা বিশাল বিছানা  
আবার কোথাও চাদরের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে নীল জল   
বড় শান্তযেন কোনো বিক্ষোভ জানেনা
মেঘ ও আকাশের মধ্যবর্তী একটানা গুঞ্জরন---   
বিমান চলছে আন্দামান

          
ধীরে ধীরে বিমান নামছে নিচে, রঙ বদলায়
দিগন্তের কাছাকাছি মেঘের সীমায় আকাশের ঘননীলে
হাল্কা তুলি বুলিয়ে কে এঁকেছে ফিরোজার পাড়!
নেভি ব্লু-র নানা আকৃতির টুকরো টুকরো অবস্থিতি দেখা দেয় নিচে
সাদা ফেনরেখায় তার বিস্তৃতি চিহ্নিত সাদা রেখা ঘিরে
অগভীর সবুজরঙের মোটা তুলির টান দর্শনীয়     
কালচে-নীল সবুজ হতে থাকে। ওই দেখা যায় 
পাহাড় ও ঘন বনভূমি, পৃথিবীর প্রত্যূষের দেশ
আন্দামান, সাগরের বুকে কটি মকরত মণি

 -------------------

 সভ্যতার চোখ


জারোয়া রমণীটির কটিমেখলায় গোলাপি সুতোর ঝুল ঘন       
লেহেঙ্গার মত আজ গোড়ালি ছুঁয়েছে বুকে চোলি আবরণ  
পাশে হাফপ্যাণ্টে সভ্য’ ঢং-এ বসে থাকা ছোট এক ছেলে,     
কোলে তার নগ্ন শিশু কিন্তু সেই আদিকাল থেকে খেলে   
সাজানো জারোয়া নারীদাঁড়িয়ে পথের পাশে দেখে অপলক  
বিস্ময় সবুজ চোখে হতাশ উলঙ্গদেহ-লালায়িত পর্যটক    
হয়তো বা ভাবে বনচর,
মানুষ দেখতে আসা এইসব মানুষেরা তাদের ভূমিতে এলে পর   
কেন বা ঢাকতে হয় দেহগাছপালা ঢাকেনা শরীর,
পরে না কাপড় পশুপাখিযারা নিজস্ব সন্তান বনানীর   
জন্মজ চর্মের ‘পরে কৃত্রিম পরত চড়ানোর কোন প্রয়োজন!   
ঢেকেরাখা সভ্যতার নিচে চাপা আদিম প্রবৃত্তিতার লালসা নয়ন  
নগ্নতার সামনে এসে ভণ্ডামির হাত দিয়ে চাপা দেয় চোখ  
পরায় স্বরুচিমত লজ্জাহীন লজ্জার নির্মোক      
যে সভ্যতা জারোয়াকে আজ পরিয়েছে আপাদলম্বিত আবরণ,   
বস্ত্রভেদী দৃষ্টি দিয়ে প্রতিদিন ধ্বস্ত করে বস্ত্রাবৃত নারীর বসন
বিশ্বাসে ধর্ষণ করেপাশে রেখে সভ্যতার একান্ত মুখোশ
সভ্যতা তো পৃথিবীর কালসন্ধ্যাজারোয়া এখনো সেই আদিম প্রত্যূষ



 ---------------------------------------



 চ্যাথাম ব্রিজ

চ্যাথাম ব্রিজ, তোমার কোনো ছবি তুলে রাখিনি
ভোরবেলা সমুদ্রের সুগন্ধ নিয়ে একাকী চলতে চলতে
পৌঁছে গেলাম যেখানে তুমি জুড়ে দিয়েছ দুই দ্বীপকে  
অবিশেষধারকরা নাম কোনো এক আগন্তুকের স্মৃতি,    
তবুও অনন্য তুমি শুয়ে আছ দুই কালের মাঝখানে
তোমার এক দিকে রক্তিম পুব, সূর্য ওঠার ভোর,
ওধারে তাকিয়ে দেখি পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে পাণ্ডুর চাঁদ    
নিচে দুধারের দুই কালো সাগরের ঢেউ কল্লোল করে
প্রণালী দিয়ে আসে আর যায়, আসে আর যায়অবিরাম
একহাতে জীবন, অন্যহাতে মৃত্যু নিয়ে আমারো পথ চলা
জীবনের দেঁতো হাসির ফাঁদ, মৃত্যুর দাঁতকপাটি ভয়
সবই অজানা কালোতে মিলায়, সাঁকোর কাছেই যত কলরব
উপর দিয়ে চলে পদাতিকযান, দিনের পর দিন,
তাদের চিহ্ন শরীরে ধরে ক্ষয়ে যাওয়া তিলে তিলে
কত স্মৃতি ছদ্মবেশী তেতো, মিষ্টি, কটু
এইতো ছবি, আলোছায়া বুকের মাঝে, চিরদিনের সাঁকো









কোন মন্তব্য নেই: